বাবাকে এখনো আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি: ইলিয়াসপুত্র আবরার

Spread the love

সিলেট বিভাগীয় বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীকে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পুত্র ব্যারিস্টার আবরার ইলিয়াস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইলিয়াস আলী ফিরে আসার খবরকে ‘গুজব’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। বুধবার মানবজমিনকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব তথ্য জানান। ব্যারিস্টার আবরার ইলিয়াস বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের তিন আমলে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অসংখ্য নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। সোমবার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গুম হওয়া  কয়েকজনকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বন্দিশালা ‘আয়নাঘরে’ বন্দি ছিলেন। এ ঘটনার পর আমরাও আশাবাদী হয়েছি- আমার বাবাকে ফিরে পাবো। আমরা এখনো আমার বাবাকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইলিয়াস আলী ফিরে আসার খবর বিষয়ে জানতে চাইলে আবরার বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমি নতুন সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি- তারা যেন আমার বাবাকে খুঁজে বের করে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এ ঘটনাটি জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্ত করার দাবি জানাচ্ছি।

যেভাবে নিখোঁজ হন ইলিয়াস আলী
২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল। রাত তখন ১২টা। বনানী থানা থেকে একটি ফোন আসে জ্যেষ্ঠপুত্র আবরার ইলিয়াসের মোবাইলে। দৌড়ে মা তাহসিনা রুশদীর লুনার রুমে যান আবরার। কাঁচা ঘুমে আচ্ছন্ন মাকে ডেকে তোলেন। বলেন, পুলিশ জানিয়েছে আমাদের গাড়ি নাকি বনানী থানায়। তখনও স্বামী এম ইলিয়াস আলীর বিপদ আঁচ করতে পারেননি লুনা। অনেকটা স্বাভাবিক চিন্তা নিয়ে পুত্রকে বলেন, আমাদের ড্রাইভার আনসারকে ফোন দাও। পুত্র জানান, আনসারকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন লুনা বলেন, তাহলে তোমার বাবাকে ফোন দাও। উদ্বিগ্ন পুত্র জানান, বাবার ফোনও বন্ধ। পুত্রের জবাব পেয়ে দিশাহারা হয়ে যান লুনা। দু’জনের ফোন একসঙ্গে বন্ধ কেন? তখন থেকে নানা দুশ্চিন্তা তার মাথায় আসতে থাকে। লুনা বলেন, সঙ্গে সঙ্গেই বনানী থানার ঐ পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করি। জিজ্ঞাসা করি, গাড়ি থানায় গেল কীভাবে? তখন ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, টহল পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, বনানীর ২ নম্বর সড়কের সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে একটি গাড়ি পড়ে আছে। পরে আমরা গাড়ি থানায় নিয়ে আসি। কিছুক্ষণ পরই স্থানীয় একজন ছাত্রদল নেতা আসেন বাসায়। তিনি জানান, রাত পৌনে ১২টার দিকে গাড়িচালক আনসার আলী তাকে ফোন করে বলেন, তার মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। দ্রুত কিছু টাকা পাঠানোর আকুতি জানান। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই লাইনটি কেটে যায়।
এদিকে ঘটনার চারদিন পর র‌্যাব সদর দপ্তরের মোশতাক নামে এক কর্মকর্তা যোগাযোগ করেন স্ত্রী লুনার সঙ্গে। ফোন করে শোনান আশার বাণী। ওই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে, উনাকে (ইলিয়াস আলী) পাওয়া যেতে পারে, আপনারা প্রিপারেশন রাখেন। এরপর ওই র‌্যাব কর্মকর্তা আরও একদিন ফোন করে একই কথা শোনান। এর কিছুদিন পর ইলিয়াস আলীকে পাওয়ার আশার বেলুন ফুটো করে দেন ওই র‌্যাব কর্মকর্তা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমাদের কাছে যে ইনফেরমেশনটা ছিল সেটা এখন আর নেই। এই বিষয়ে আমরা আর কিছু বলতে পারছি না।  কয়েকদিন পর আমাকে জনৈক এক ব্যক্তি ফোন করে বলেন, ইলিয়াস আলী জীবিত আছেন। আপনি ইচ্ছে করলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। কীভাবে সাক্ষাৎ করা যায় সেটাও তিনি বলে দিলেন।

স্বামীর সন্ধান পেতে পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের সুযোগ চেয়ে আবেদন করেন তিনি। দুই পুত্র ও শিশুকন্যাকে নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় ইলিয়াসপত্নীকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরো, বিষয়টি দেখছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের কিছুদিন পর গাজীপুরের পূবাইল থেকে লুনার মোবাইলে একটি ফোন আসে। এক নারী ফোন করে জানান, ইলিয়াস আলীকে পাওয়া যেতে পারে, দ্রুত পূবাইলে আসেন। বেশ কয়েকজন দলীয় নেতা ও র‌্যাব কর্মকর্তা মোশতাকসহ দ্রুত যান পূবাইলে। সেখানে যাওয়ার পর স্থানীয়রা জানান, একজন লোককে মাইক্রোবাসে করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে ইলিয়াস আলীর সন্ধান আর পাননি।

ঘটনার সময় পাশের পার্কের বেঞ্চে ঘুমিয়ে ছিলেন ডাব বিক্রেতা সোহেল। চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। এরপর তিনি দেখেন, একটি লোককে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে চার ব্যক্তি। গাড়িতে উঠতে না চাওয়ায় ওই ব্যক্তিকে কিলঘুষি মারা হচ্ছিল। দীর্ঘ সময় ধস্তাধস্তির পর জোর করে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। এ সময় ওই ব্যক্তি ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিল। পরদিন সকালে জানতে পারি, বনানীর পার্কের পাশের সড়ক থেকে যে ব্যক্তিকে গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, তিনিই বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। গাড়িতে উঠিয়ে বনানী এক নম্বরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

ওই সময় ঘটনাস্থলের পাশের ভবনের একজন নির্মাণ শ্রমিক পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, ইলিয়াস আলীর গাড়ির পেছন দিকে কালো রঙের মাইক্রোটি ধাক্কা মারায় চালক ক্ষিপ্ত হয়ে নেমে যান এবং মাইক্রো চালকের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক ও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় মাইক্রো থেকে আরও ৪-৫ জন নেমে গিয়ে ইলিয়াস আলীর গাড়ির চালককে জোর করে ধরে মাইক্রোতে তুলে নিয়ে বেঁধে ফেলেন। পরক্ষণেই ৩-৪ জন নেমে গিয়ে প্রাইভেটকারে বসে থাকা ইলিয়াস আলীকেও ধরে গাড়িতে তোলার সময় ধস্তাধস্তির সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে ইলিয়াস আলীর আর খোঁজ মেলেনি।


Spread the love

Leave a Reply