সাবেক দুই আইজিপিসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তার রিমান্ড, এ পর্যন্ত যারা গ্রেফতার হলেন
বাংলাদেশে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হকের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। এছাড়া ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফিকেও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে।
বুধবার সকাল পৌনে সাতটায় তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। একইসাথে প্রত্যেককে ১০ দিন করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হয়।
রিমান্ড আবেদনের শুনানি নিয়ে সিএমএম আদালত সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আট দিন এবং শহীদুল হককে সাত দিনের রিমান্ডে দেয়া হয়।
এছাড়া পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল কাফির আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
এর আগে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে শহীদুল হককে উত্তরা থেকে এবং ঢাকার তেজগাঁও থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন যে মামলায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ড
পুলিশ বলছে, কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার মিছিলে নির্বিচার গুলিবর্ষণে ঢাকার মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানি আবু সায়েদ হত্যা মামলায় সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বুধবার সকালে তাকে সিএমএম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছে পুলিশ। পরে আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৯শে জুলাই বিকাল চারটায় মোহাম্মদপুরে আন্দোলন চলাকালীন সময় রাস্তা পার হয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়।
তার মাথার এক পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। পুলিশের গুলিতে গরীব মুদি দোকানদার আবু সায়েদের মৃত্যু হয়।
পরে এ ঘটনায় মামলা করা হয়। এতে বলা হয়েছে কোন প্রকার উস্কানি ছাড়া আসামিদের নির্দেশে অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যরা গুলি করে আবু সায়েদকে হত্যা করেছে।
এ মামলায় অন্যান্য আসামীর মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান, গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ, পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার এবং সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আরো অনেকে।
রিমান্ড আবেদনে পুলিশ আদালতকে জানিয়েছে, রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকার তেজগাঁও থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মামলার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে তাদের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে বলেও আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের গনমাধ্যমে ডিএমপির বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সেনা হেফাজতে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় সেনা হেফাজতে থাকাবস্থায় আত্মসমপর্ণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
পরে তাকে পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। গ্রেপ্তারের পর তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০২২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর আইজিপি হিসেবে যোগ দেন। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরে তাকে অবসরে পাঠানো হয়।
শহীদুল হককে যে মামলায় রিমান্ড
ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় সাবেক আইজিপি শহীদুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সকালে তাকেও আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছে পুলিশ। পরে শুনানি নিয়ে আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার বিকাল পাঁচটায় আন্দোলন চলাকালে নিউমার্কেটের এক নম্বর গেটের সামনে শান্তিপূর্ণ মিছিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহনে হত্যার উদ্দেশ্যে নিরপরাধ মানুষের উপর শত শত সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল রাবার বুলেট ও গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলে অনেকে আহত হয়।
এদের মধ্যে আব্দুল ওয়াদুদ আসামীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মাথার পিছনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান।
মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পৌনে একটায় উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর থেকে অভিযান চালিয়ে শহীদুল হককে আটক করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিমান্ড আবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে তদন্তে আসামির এ মামলার ঘটনার সাথে জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। পরে সাত দিন মঞ্জুর করে আদালত।
শহীদুল হক ২০১৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফির রিমান্ড
পুলিশের সাবেক দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। এই প্রথম পুলিশের মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর বাইরে, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফিকে হাজারীবাগ থানার অপহরণ মামলায় আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
বুধবার সকালে পৌনে সাতটায় সাবেক দুই আইজিপির সাথে কাফিকেও আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে। শুনানি নিয়ে আট দিন মঞ্জুর করেছে আদালত।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার পদে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে বিকাল আড়াইটা থেকে চারটা থেকে ১০ ই অগাস্ট রাত দুইটা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পপুলার ও আনোয়ারা হাসপাতালের মাঝে ধানমন্ডি দুই নম্বর রোড থেকে বাদীকে অপহরণ করে।
এরপর হাজারীবাগ থানাধীন অজ্ঞাত স্থানে আটকে মুক্তিপন স্বরূপ বিপুল পরিমান অর্থ পরিবার থেকে আদায় করে বলে বাদী দরখাস্তে উল্লেখ করেছে।
এ মামলার পলাতক অন্য আসামিদের মধ্যে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, পুলিশ কর্মকর্তা মারুফ হোসেন সরদার, ইকরাম আলী মিয়াও রয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য আসামীও রয়েছে।
এদিকে, রাতে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়ই তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার মামলায় অনুসন্ধান শুরুর কথা জানিয়েছিল সিআইডি।
এ পর্যন্ত নেতা ও কর্মকর্তাদের যত মামলা এবং গ্রেফতার
পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচই অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত ১০০টির বেশি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা, গণহত্যা এবং অপহরণের মত মামলাও রয়েছে।
সর্বশেষ ২৯শে অগাস্ট সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাবার পরপরই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন তার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য।
সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়।
একই দিনে তার কিছুক্ষণ পর আটক হন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটকে দেয়।
তাদেরকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে বিমানবন্দর সূত্র বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছিল।
যদিও পরে আবার মি. পলক, মি. সৈকত ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে একই দিনে খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
তবে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সম্পর্কে এখনও কিছু জানায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সেসময় বিমানবন্দর থেকে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এবং ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদকেও আটকের খবর আসে গণমাধ্যমে।
তবে, তাদের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে কি না সে ব্যাপারে কোনও তথ্য মেলে নি।
এদিকে, সরকার পতনের পর আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, গুম ইত্যাদির মামলা করা হচ্ছে।
তাদেরকে অনেককে টিপু মুনশির মতো গ্রেফতার করা হয়েছে, অনেককে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এখন পর্যন্ত যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মণি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান।
এছাড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী রাশেদ খান মেননও গ্রেফতার হয়েছেন।
সরকারের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যেমন গ্রেফতার হয়েছেন, তেমনি সাবেক অনেক কর্মকর্তাও আটক হয়েছেন।
এদের মধ্যে অন্যতম আলোচিত সেনা কর্মকর্তা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। পাঁচই অগাস্ট সরকার পতনের পর তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সেইসাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, যিনি এক সময় র্যাবে কর্মরত ছিলেন, তাকেও আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
তবে বাংলাদেশে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় নিহতের ঘটনাকে ঘিরে যেভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে, তার সমালোচনাও করছেন অনেকেই।
আত্মগোপন এবং সেনা হেফাজত
বাংলাদেশে গত পাঁচই অগাস্ট গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দলের নেতা, বিচারক, সরকারি আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ৬২৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।
এর মধ্যে ৫১৫ জনই পুলিশের সদস্য, যাদের মধ্যে ২৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা।
আশ্রয়গ্রহীতাদের অধিকাংশই নিজ উদ্যোগে পরে সেনানিবাস ছেড়ে চলে গেছেন। এখন সেখানে রয়েছেন সাত জন।
এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে আশ্রয় গ্রহণকারীদের চারজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ইতোমধ্যেই হস্তান্তর করা হয়েছে।
অগাস্টের ১৮ তারিখে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনও সেনা হেফাজতে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় সেনা হেফাজতে থাকাবস্থায় আত্মসমপর্ণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই দেশের বেশিরভাগ জেলাতেই আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
এ অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দলটির শীর্ষনেতাদের অনেকেই গা ঢাকা দেন। বিদেশে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ বহু নেতা।