নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধান ও সরকারের বক্তব্যে ‘সমন্বয়হীনতা’ প্রকাশ পেল?
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এক থেকে দেড় বছর অর্থাৎ আঠার মাসের যে সময়সীমার কথা উল্লেখ করেছিলেন সেটিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ‘ব্যক্তিগত মত’ উল্লেখ করার পর এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সামাজিক মাধ্যমে।
কারও কারও কাছে বিষয়টি নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সেনাপ্রধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ‘ঐক্যমতের অভাব’ কিংবা ‘সমন্বয়হীনতার বহিঃপ্রকাশ’ বলে মনে হচ্ছে।
অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির একজন নেতা বলছেন বিতর্ক এড়াতে নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য সরকারের দিক থেকেই আসা উচিত। আর জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র বলছেন দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দিয়ে দিলেই এসব বিতর্কের অবসান হবে।
গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর সেনাপ্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার কথা জানিয়েছিলেন। পরে আটই অগাস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার শপথ গ্রহণ করে।
এরপর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন যে কখন নির্বাচন হবে সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এরপর দায়িত্ব নেয়ার এক মাস পর দেয়া আরেক ভাষণে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন।
সেই কমিশনগুলো আজ পহেলা অক্টোবর থেকে কাজ শুরুর কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা প্রেস সচিব জানিয়েছেন ছয়টি কমিশন কাজ শুরুর আগে আবারো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করবে সরকার। এরপর কমিশনের কাজ শেষে সুপারিশ পাওয়ার পর আরেকদফা সংলাপ হবে।
তবে বিএনপি বরাবরই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দাবি করে আসছে। অন্যদিকে জামায়াত নির্বাচনের আগে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিয়েছে।
সেনাপ্রধান যা বলেছিলেন
রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই হওয়া উচিত। তবে তিনি ধৈর্য ধারনের ওপরও জোর দেন।
“আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে সেটাই একটা টাইম ফ্রেম (সময়সীমা) হওয়া উচিত, যার মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারি,” বলছিলেন তিনি।
মি. জামান জানান, প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধান প্রতি সপ্তাহে সাক্ষাৎ করছেন এবং তাদের মধ্যে ‘অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক’ বিদ্যমান। দেশকে স্থিতিশীল করতে সরকারের প্রচেষ্টায় সামরিক বাহিনী সমর্থন দিচ্ছে। “আমি নিশ্চিত আমরা একযোগে কাজ করলে ব্যর্থ হবার কোনো কারণ নেই।”
ওই সাক্ষাতকারে তিনি এও বলেছিলেন যে নির্বাচন যাতে আগামী আঠার মাসের মধ্যে হতে পারে সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করতে ‘পরিস্থিতি যাই হোক না কেন’ তিনি মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাবেন।
“আমি তার পাশে থাকবো। যা-ই হোক না কেন। যাতে করে তিনি তার কর্মসূচি সম্পন্ন করতে পারেন,” সাক্ষাৎকারে বলছিলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব কী বলেছেন
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচনের সময় নির্ভর করবে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার ওপরে। তারপর সময়ের বিষয় আসবে যে নির্বাচন কবে হবে।
ওই সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে তিনি নিজস্ব মতামত হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন “এটা (নির্বাচন) কবে হবে? ১৬ মাস পর নাকি ১২ কিংবা ৮ মাস পরে সেটা এখনই নির্ধারিত করা যাচ্ছে না। আর আমার মনে হয় যে, সেনাপ্রধান এখানে ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন।”
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকার ও সেনাপ্রধানের বক্তব্যে মতবিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মি.আলম আজ মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এখানে মতবিরোধের কোন বিষয় নেই। সেনাবাহিনী সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান এবং সেনাপ্রধান তার ব্যক্তিগত মত দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা সবসময় বলে আসছেন নির্বাচন কখন হবে এটা জনগণ ঠিক করবে”।
তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগে সংস্কারের কিছু বিষয় আছে। এসব বিষয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন কাজ শুরুর আগে এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা হবে। সেখানে যেভাবে মতৈক্য হবে তার ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন সংস্কার ও পুনর্গঠন হবে। তারপরই কমিশন নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করবে”।
“সে কারণেই আমি বলেছি যে এটা ১২মাস , ১৬ মাস কিংবা দু বছর হতে পারে। এটা এখনি তো বলা যাচ্ছে না। এ জন্যই আবারো বলছি যে কখন নির্বাচন হবে সেটি ঠিক করবে জনগণ,” বলছিলেন মি. আলম।
মতবিরোধ নাকি সমন্বয়হীনতার?
গত ২৪শে সেপ্টেম্বর সেনাপ্রধানের সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার এটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলো। কারণ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকার কিংবা সরকার সংশ্লিষ্ট কারও দিক থেকে নির্বাচনের সময়সীমা উল্লেখ করে এটিই ছিলো প্রথম কোন বক্তব্য।
এর আগে শুরু থেকেই বিএনপি নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিলো।
কিন্তু অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের দিক থেকে কেউ নির্বাচন কত দিনে হবে বা হওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন তা নিয়ে কোন বক্তব্য আসেনি।
পরে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে মি. ইউনূস বলেছিলেন যে, কখন নির্বাচন হবে এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
চব্বিশে অগাস্ট ঢাকায় এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের পাশাপাশি দ্রুত সংস্কারের রোডম্যাপ দেয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহবান জানান।
এদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি আজ মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে।
ওই সাক্ষাৎকারে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করা হয় যে সামরিক নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ১৮ মাস ক্ষমতায় থাকা উচিত। আর বিরোধী দলগুলো নভেম্বরে নির্বাচন চেয়েছিল। আপনার যা করতে হবে, তার জন্য ১৮ মাস সময় কি যথেষ্ট?
জবাবে ড. ইউনূস বলেছেন, “কেউ কেউ বলছে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার করার জন্য, না হয় আপনি (ড. ইউনূস) যত দেরি করবেন, তত অজনপ্রিয় হয়ে পড়বেন। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ বলছে, না, আপনাকে অবশ্যই এই সংস্কার শেষ করতে হবে। তাই আপনাকে এই দীর্ঘ সময় থাকতে হবে। কারণ, সবকিছুর সংস্কার না করে আমরা বাংলাদেশ ২.০-তে যেতে চাই না। তাই এই বিতর্ক চলছে।”
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, একটি রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পর যারা দেশ চালাচ্ছেন তারা আগে কখনো একসাথে কাজ করেননি। ফলে তাদের মধ্যে ভিন্ন চিন্তা হতে পারে। নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের বিষয়গুলোতে আলাদা আলাদা বক্তব্য আসায় সমন্বয়হীনতার বিষয়টি উঠে আসছে।
“আমি মনে করি এ বিষয়ে দলগুলোর সাথে যেহেতু আলোচনা হবে এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে। তার আগে ব্যক্তিগত মতামত না দিয়ে সরকারের মাধ্যমে একটি সমন্বিত মতামত তুলে ধরলে ভুল বোঝার কোন সুযোগ থাকবে না,” বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকার ও সেনাপ্রধানের দিক থেকে যেসব বক্তব্য আসছে সেটিকে ঠিক সমন্বয়হীনতা বলা যাবে না।
“তবে সমন্বয় আছে সেটাও তো বলা যাবে না। সেনাবাহিনী সরকারের প্রতিষ্ঠান এবং সরকারকে দারুণভাবে সহযোগিতা করছে। কিন্তু নির্বাচন বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে সরকারের দিক থেকে। আবার নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ করতে অনেক কাজ শেষ করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন।
তিনি বলছেন, দেশ পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকবে কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধানের উদ্যোগে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে।
“তবে দ্রুত সংস্কার করে নির্বাচন দিলেই আর এমন বিতর্কের সুযোগ থাকবে না,” তিনি মত প্রকাশ করেন।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে নিছক ব্যক্তিগত মন্তব্য বলার সুযোগ নেই।
“সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সেনাপ্রধান আছেন। আর নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার মন্তব্য বা পরামর্শ বিশেষ গুরুত্ব বহন করাই স্বাভাবিক। সরকার যদি সেই গুরুত্ব না দেয় তাহলে সেটি তাদের মধ্যকার দূরত্বকেই প্রকাশ করে,” তিনি বলেন।