ভারতের বিরোধিতা ও সখ্যতায় বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার
বাংলাদেশ জন্মের আগে, সেই ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্মের সময় এবং এরও আগে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগের জন্মের সময় থেকেই ভারতের ইন্ধনে এসব দল গঠিত হয়েছে, ভারতের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ইত্যাদি তকমা পেয়ে আসছে। এসব মোটেও নতুন নয়। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মস্কোপন্থীরাও এই অভিযোগের নিশানা হয়েছেন।
একমাত্র বঙ্গবন্ধুই এসব কল্পিত অভিযোগকে তোয়াক্কা করতেন না। এজন্যই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু এতেও কিছু মানুষের চুলকানি আরও বেড়ে ঘা হয়ে গেছিল, এখন পচন ধরেছে। জন্মগতভাবেই আওয়ামী লীগকে ভারতের দালালের তকমা বহন করতে হচ্ছে। এমনকি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেও একই অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ও স্বাধীনতাবিরোধিরা।
গত ৫৩ বছরে একাধিকবার এই অভিযোগে আওয়ামী লীগকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনেও একই ট্রাম কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তথাকথিত প্রতিবাদী এবং ধর্মজীবী ও ধর্মবাদীরা এক ও অভিন্ন সুরে কথা বলে।
গত ৭৫ বছরে যত প্রগতিশীল মুভমেন্ট হয়েছে, সবগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে ভারতের গন্ধ লাগিয়ে। এমনকি স্বাধীনতাকেও। গত ৫৩ বছরে যত প্রতিক্রিয়াশীল মুভমেন্ট হয়েছে, সেসবেরও মূল অস্ত্র ভারত বিরোধিতার কার্ড। ১৫ আগস্ট, ৭ নভেম্বর, ৫ আগস্ট, এসব মুভমেন্টে উত্থিত প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির মনোজগতে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করা উপাদান হলো ভারত বিরোধিতা।
অথচ ৫৩ বছরের মধ্যে প্রায় ২৮ বছর দেশ শাসন করেছে এই প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তিরা, এখনও করছে। যাদের একমাত্র আদর্শ এবং ধ্যান-জ্ঞান ও তত্ত্ব, সবকিছু নিহিত একমাত্র ভারত বিরোধিতার গহ্বরে। এতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে কিংবা এই সরকারগুলো সত্যিই কি ভারত বিরোধী নাকি আওয়ামী লীগকে মিথ্যা অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোই আসল উদ্দেশ্য?
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভারত বিরোধিতা ও সখ্যতার কিছু নমুনা নিচে তুলে দিলাম।
৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করে ভারত পাঠিয়ে দেবার পরে ৮ তারিখে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার আসার পর থেকে দেশে বেড়ে যায় বিরত বিরোধিতা। যার অন্যতম কুশীলব প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং।
তখনও তিনি শপথ নেননি। ৬ আগস্ট এনডিটিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা হয়, তাহলে তা মিয়ানমারসহ চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সেভেন সিস্টার্সে (পূর্বের সাতটি রাজ্য) ছড়াবে।
শপথের পরে ৪ সেপ্টেম্বর, পিটিআইকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তার প্রত্যর্পণের অনুরোধ না করা পর্যন্ত ভারত যদি তাকে রাখতে চায়, তাহলে শর্ত হবে তাকে (শেখ হাসিনা) নীরব থাকতে হবে। হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং তিনি সেখান থেকে প্রচারণা চালাচ্ছেন এটি আমাদের প্রতি একটি ‘অবন্ধুসুলভ আচরণ। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলকে ভারত যে ইসলামিক দল মনে করে সেটিও ঠিক নয়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ভারতের উদ্বেগ প্রকাশ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, সংখ্যালঘুদের অবস্থাকে এত বড় আকারে চিত্রিত করার চেষ্টা করার বিষয়টি একটি অজুহাত মাত্র।
৮ সেপ্টেম্বর বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দরকার। কিন্তু সেই সম্পর্ক হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে।
১১ সেপ্টেম্বর ডয়েচে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী এবং আমাদের একমাত্র প্রতিবেশী বলা যায়। কারণ, চারদিক থেকেই ভারত আমাদের আছে। কাজেই তার সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক হওয়া উচিত এবং হবে। এ ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নাই, তাদেরও গত্যন্তর নাই। দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক রেখে কেউ লাভবান হবে না। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা হবে সবচেয়ে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। বন্ধুত্বের শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া—এটাই আমাদের উদ্যোগ।
৭-৮ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট হতে হবে। অর্থনীতি, নিরাপত্তা, জল-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একে অপরকে ছাড়া চলা আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে যাবে। কাজেই সব কিছুতেই দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকতে হবে। কেউ কারও উপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে এমন ধারণা যাতে না হয় সেটাও দেখতে হবে।
এরমধ্যেই একটা ইলিশ কূটনীতিও হলো।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বললেন, এবার ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হবে না। সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টারাও ভারতে ইলিশ মাছ পাঠানোর বিরোধিতা করেন।
কিন্তু ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকার ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি আদেশ জারি করে। এটা শোনে ফরিদা আখতার বলেন, ইলিশ রপ্তানির যে অনুমতি হয়েছে সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের না। আর পূজার সাথে ইলিশ রপ্তানির কোনো সম্পর্ক নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে কলকাতার ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করেছে।
এরপরেও তিনি বলতে থাকেন, আমি এখনও আমার আগের সিদ্ধান্তেই আছি যে আগে দেশের মানুষকে ইলিশ খাওয়াতে হবে, পরে রপ্তানি। তবে রপ্তানির সিদ্ধান্তের পর ইলিশের দাম বেড়ে গেলে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেবে মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এক ফাঁকে তিনি বলে ওঠেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ভারতের বিশেষ অনুরোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে।
ইলিশ নিয়ে সোচ্চার ছিলেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার ভারতে ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানি করা হয়েছিল। এই নিয়ে সেই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর আসিফ নজরুল ফেইসবুকে লিখেছিলেন, ‘৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ! বিপুল পরিমাণে ইলিশ ভারতে রপ্তানি করে তাদের কেন খুশি করা হচ্ছে? সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষ মেরে ফেলার জন্য? অভিন্ন নদীর পানি থেকে আমাদের বঞ্চিত করার জন্য? বাণিজ্য ভারসাম্য না রাখার জন্য? কথায় কথায় বাংলাদেশ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য?’
এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি খালেদ মুহিউদ্দীনের এক প্রশ্নের জবাবে এবার আসিফ নজরুল বললেন, যখন ইলিশ রফতানির স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, তখন আমি উপদেষ্টা ছিলাম না।
কী বুঝলেন?
এছাড়াও রাজাকার কন্যা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আলবদর বাহিনীর সদস্য মুহাম্মদ ফাওজুল কবীর খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব) এম সাখাওয়াত হোসেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল(অব) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রমুখ গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সকাল শুরু করতেন ভারত বিরোধিতার বুলি আওড়িয়ে। অবাক করা ব্যাপার হলো, অক্টোবরেই সবাই থেমে গেলেন।
কিন্তু কেন?
আওয়ামী লীগকে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোন উদ্দেশ্য কি আছে?
মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম ( Blogger, Digital creator and Human rights defenders)