হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলছে, আল–জাজিরাকে ড. ইউনূস
‘হাসিনা নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ভাবতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন’- এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৯) ফাঁকে কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল–জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল রোববার এই ভিডিও সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করেছে সংবাদ মাধ্যমটি।
গত ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) নিজেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। এমনকি ভারতও তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছে। সুতরাং আশ্রয়দাতাও তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কিছু বলছে না।’
ভারতে থেকে হাসিনার বিক্ষোভের ডাক প্রসঙ্গে ড. ইউনূস আরও বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশিল করার চেষ্টা করছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশে বিক্ষোভের ডাক দিচ্ছেন। এগুলো বাংলাদেশের জন্য উপকারী নয়। তাই ভারতের কাছে তারা এসব বিষয়ে বলছেন।’ তাকে আশ্রয় দিচ্ছে, ঠিক আছে। কিন্তু এমনটা হতে থাকলে ভারতের কাছে আবার অভিযোগ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা ও নির্বাচন
শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া চলছে। দোষী সাব্যস্ত হলে ভারতের কাছে তার (হাসিনার) প্রত্যাবর্তন চাওয়া হবে।
আগামী নির্বাচনের সঠিক সময় কখন হবে এ বিষয়ে ড. ইউনূসের কোনো ভাবনা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘না। আমার মাথায় এমন কিছু নেই।’
হাসিনার আমলে দুর্নীতি প্রসঙ্গ
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে বাংলাদেশ বিভিন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগও ছিল। তখনকার সমস্যাগুলো যেন এখন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অব্যবস্থাপনা, অপশাসন, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করা এবং আরও নানান অপকর্মে ভরে উঠেছিল বাংলাদেশের বিগত ১৬টি বছর। এই পরিস্থিতি থেকে দেশের উত্তরণে আমাদের বিশাল কাজ রয়েছে। প্রতিটি খাত ধরে ধরে আমাদের তা স্বচ্ছ করতে হবে। তবে এটা সাময়িক সময়ের জন্য করলে হবে না। পুরনো নীতিতে চলা প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে কাজ করছে তাতে জনগণ সরকারি কার্যালয়ে যেতে ভয় পায়, কেননা সেখানের কেউ টাকা চেয়ে আপনাকে নির্যাতন করতে পারে। যদিও এ বিষয়টি লজ্জার তবুও আমি এখানে তা উল্লেখ করলাম। সরকারকে জনগণের সহায়ক হতে হবে। এখন নাগরিকরা সরকারি অফিসগুলোকে নির্যাতনের চেম্বার হিসেবে দেখে। আপনি একবার সেখানে প্রবেশ করলে তাদের কেউ আপনার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য আপনাকে চেপে ধরবে। গোটা ব্যবস্থাপনাতেই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়সীমা
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়সীমা প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকার। স্থায়ী সরকার নই। নিয়মিত সরকার পাঁচ বছরের হয়। নতুন সংবিধানে সরকারের মেয়াদ সম্ভবত চার বছর হতে পারে। কারণ, মানুষ সরকারের মেয়াদ কম চায়। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ চার বছরের কম হওয়া উচিত, এটা নিশ্চিত। এটা আরও কম হতে পারে। পুরোটা নির্ভর করছে মানুষ কী চায়, রাজনৈতিক দলগুলো কী চায় তার ওপরে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি রাজনৈতিক দলগুলো চায় এটা (সংস্কার) ভুলে যাও, নির্বাচন দাও। তাহলে সেটা করা হবে।’ তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে চার বছর থাকছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি তা বলিনি যে চার বছর। আমি বলেছি, এটা সর্বোচ্চ মেয়াদ হতে পারে। তবে আমাদের উদ্দেশ্য তা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা।’
চলমান সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পুরো সরকার ব্যবস্থার সংস্কার হবে। মানুষ নতুন কিছু চায়। সেখানে সব ক্ষেত্রে সংস্কার হবে। এমনকি সংবিধানও সংস্কার হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দুটো প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলছে- নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সব সংস্কার শেষ করার প্রস্তুতি।
জলবায়ু প্রসঙ্গ
নিক ক্লার্ক ড. ইউনূসের কাছে জানতে চান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে, আপনি বাকুতে বিশ্বের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শীর্ষ কপ২৯-এ যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে আপনি এই সম্মেলন থেকে কী আশা করছেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, প্রথমত জলবায়ুর নেতিবাচক দিক সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করা। বিশ্বের অনেক দেশই এ বিষয়ে অসচেতন। জলবায়ু সংকট একটি দেশের অস্তিত্বের সমস্য। বিশেষ করে দ্বীপ দেশগুলোর জন্য এই সংকট মোকাবিলা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে চাই। জলবায়ু সংকট নিয়ে সরব হওয়ার ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগতভাবে একটি প্রশ্ন উত্থাপনের চেষ্টা করি। তা হচ্ছে- জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিক্ষিপ্ত কোনো পরিকল্পনা কার্যকর হবে না। যেহেতু এটা বৈশ্বিক সমস্যা। সুতরাং আমি মনে করি বিক্ষিপ্তভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ না করে এই সংকট বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করা উচিত। তবে প্রকল্পের গুরুত্বও আমি অস্বীকার করছি না। অবশ্যই এই সমস্যা মোকাবিলা বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তবে এক্ষেত্রে আমাদের অব্যবস্থাপনা এড়িয়ে চলতে হবে। আপনি একদিকে পরিবেশের ক্ষতি করছেন আবার অন্যদিকে সে ক্ষতি সাধনের জন কাজ করছেন। কিন্তু আপনি পরিবেশ ক্ষতির যে ধারা গঠিত হয়েছে তা বন্ধ করছেন না, তাহলে তো হবে না। এ জন্যই আমি বললাম, যখন গোটা পদ্ধতিই ক্ষতির কারণ তখন কেন আপনি কিছু কিছু করে সমাধান করতে থাকেন। সুতরাং আমি নিজে নিজে একটি প্রস্তাবনা কল্পনা করেছি। তা হচ্ছে- জলবায়ু সংকট মোকাবিলার মৌলিক উপায় প্রকল্পের পরিবর্তে প্রকল্প দাঁড় করানো নয়। জলবায়ু আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত তাই আমি এ বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি। তাই আমার কথা হচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রার অভ্যাসের পরিবর্তন না হলে পরিবেশের মৌলিক সমস্যাটি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
জলবায়ুর পরিস্থিতি এবং অতি বন্যায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান কমিয়ে আনতে সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশের আগাম ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, এটি মোকাবেলা করার জন্য সংকট তৈরিতে সহায়ক সকল বিষয় বন্ধ করতে হবে। নইলে এ সমস্য ক্রমাগতভাবে হতেই থাকবে। আমরা এসব সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি বলছি, পরিকল্পনা গ্রহণ সাময়িক বিষয়ের জন্য ঠিক আছে। তবে মৌলিক নীতির দিক থেকে সাময়িক সমাধান এটি ভুল জিনিস কেননা আপনাকে চূড়ান্ত সমাধানের জন্য সমস্যাযুক্ত গোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমি বারবার আমাদের মূলে ফিরে যাওয়ার কথা বলছি। কেননা আমরা এই সমস্যার কোনো ইতি টানতে পারছি না। যা বাংলাদেশ সহ গোটা বিশ্ববাসীর জন্যই খারাপ হবে।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলা পুরোটাই হাজার হাজার কোটি টাকার বিষয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ এই অর্থের তহবিল কীভাবে সংগ্রহ করা হবে, তা জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, আমরা যা করতে চাই তার সঙ্গে তহবিলের সম্পর্ক খুব সামান্য। আমাদের জন্য একটি উপায় হচ্ছে- সরকারি সার্ভিসের ক্ষেত্রে জনগণকে যেন সরকারি অফিসগুলোতে স্বশরীরে উপস্থিত হতে না হয়। এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবশত ডিজিটাইজেশন আমাদের সাহয্য করতে পারে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব। আর্থিক সেবাসহ অন্যান্য আরও সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেওয়া সম্ভব। তাই আমরা কর ব্যবস্থার মতো সিস্টেমকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করার চেষ্টা করছি। অন্য কোনো পদ্ধতিতে হয়ত কাউকে আপনাকে অর্থপ্রদানে বাধ্য করা হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তন হলেও পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হয় না
ড. ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আচ্ছা আপনার ও তার (ট্রাম্প) মধ্যে তেমন ভালো সম্পর্ক যায়নি, তাই না? সুনির্দিষ্ট একটি টেনশন আছে। আমার মনে হয় আমি ঠিক বলতে যাচ্ছি। আপনার এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পরিকল্পনা নিয়েছেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এর আগে ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আমার কথা হয়নি। সুতরাং ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই। যদি আপনি রিপাবলিকান পার্টির বিষয়ে কথা বলেন, তাহলে আমি বলবো ডেমোক্রেট পার্টিতে আমার বন্ধু আছেন। রিপাবলিকান পার্টিতেও আমার বন্ধু আছেন। আমাকে দেয়া কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেলের জন্য ভোট দিয়েছিল হাউস (কংগ্রেস)। উভয় দল শতভাগ সম্মতি দিয়েছিল এতে। তাই সেখানে আমার কোনো সমস্যা নেই। সুতরাং রিপাবলিকান পার্টি অথবা ডেমোক্রেট পার্টি অথবা ট্রাম্প উদ্বিগ্ন হলেও এ পর্যন্ত আমার তাতে কোনো রকম সমস্যা হয়নি। তাই আকস্মিকভাবে নেতিবাচক কিছু ঘটবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, ট্রাম্প হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। আমি মনে করি কে প্রেসিডেন্ট তার ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হয়ে একবার সামনে, একবার পেছনে যায় না। এটা তাদের একটি স্থিতিশীল নীতি।
ড. ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে আপনি কি মনে করেন, এ অঞ্চলে তিনি (ট্রাম্প) ভিন্ন অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হবেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, একেবারেই না।