ইবোলা একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস
এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন :
ইবোলা ভাইরাস রোগ (Ebola Virus Disease বা EVD) একটি মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ, যা ইবোলা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট। ১৯৭৬ সালে প্রথম আবিষ্কারের পর থেকে এই রোগটি আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এর মৃত্যু হার অত্যন্ত বেশি এবং এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে।
ইবোলা ভাইরাস: পরিচিতি ও ধরন
ইবোলা ভাইরাস ফিলোভাইরিডি (Filoviridae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাইরাসের পাঁচটি প্রজাতি রয়েছে:
১) জাইরে ইবোলা ভাইরাস (Zaire ebolavirus)
২) সুদান ইবোলা ভাইরাস (Sudan ebolavirus)
৩) তাই ফরেস্ট ইবোলা ভাইরাস (Tai Forest ebolavirus)
৪) বুন্ডিবুগিও ইবোলা ভাইরাস (Bundibugyo ebolavirus)
৫) রেস্টন ইবোলা ভাইরাস (Reston ebolavirus)
প্রথম চারটি প্রজাতি মানুষের মধ্যে ইবোলা রোগ সৃষ্টি করে, যেখানে রেস্টন ভাইরাস প্রধানত বানরের মধ্যে পাওয়া যায় এবং মানুষে সংক্রমণের রেকর্ড নেই।
ইবোলা রোগের সংক্রমণ
ইবোলা ভাইরাস প্রধানত সংক্রমিত ব্যক্তির শারীরিক তরল (যেমন: রক্ত, ঘাম, মূত্র, বমি, লালা) বা সংক্রমিত পশুদের (বিশেষত বানর, বাদুড়) সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়াও, মৃতদেহের সংস্পর্শ ইবোলা ছড়ানোর আরেকটি বড় কারণ।
সংক্রমণের পর ভাইরাসটি দ্রুতগতিতে দেহের কোষে প্রবেশ করে এবং সেগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম ধ্বংস করে। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং রোগী মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
ইবোলার লক্ষণসমূহ
ইবোলার লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের পর ২ থেকে ২১ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো:
- উচ্চ জ্বর
- তীব্র মাথাব্যথা
- গলা ব্যথা
- পেশি ও গিঁটের ব্যথা
- দুর্বলতা
পরবর্তীতে উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বমি ও ডায়রিয়া
- র্যাশ বা চর্মরোগ
- অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রক্তপাত
ইবোলার চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
ইবোলার নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে, লক্ষণগুলোর ভিত্তিতে সমর্থনমূলক চিকিৎসা (যেমন: পর্যাপ্ত তরল সরবরাহ, রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ, অক্সিজেন সরবরাহ) রোগীর জীবন রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো একটি কার্যকর ইবোলা ভ্যাকসিন, “rVSV-ZEBOV”, ব্যবহারের অনুমোদন পায়। এই ভ্যাকসিন মহামারী নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো হলো:
১) সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়ানো।
২) সুরক্ষামূলক পোশাক পরিধান।
৩) জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
৪) স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ।
ইবোলার প্রভাব
ইবোলা শুধুমাত্র শারীরিক নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলে। এই রোগ মহামারীর সময়ে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটায়, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, এবং স্থানীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়।
বিশেষত, ২০১৪-২০১৬ সালের পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা মহামারী ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ। এই সময়ে প্রায় ২৮,০০০ জন আক্রান্ত হয় এবং ১১,০০০ এরও বেশি মানুষ মারা যায়।
ইবোলা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC), এবং অন্যান্য সংস্থা ইবোলা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন দেশে হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি বাড়ানো, গবেষণা ত্বরান্বিত করা, এবং ভ্যাকসিন উন্নয়ন এ সবই ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ।
উপসংহার
ইবোলা একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ। এটির প্রতিকার এবং প্রতিরোধে বিজ্ঞানীরা নিরলস কাজ করছেন। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সঠিক চিকিৎসা, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ইবোলার মতো প্রাণঘাতী রোগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন, শিক্ষার্থী (সেশন: ২০২০-২১), ব্যাচ: ইউএমসি ০৭, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ