ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের কতটা আর্থিক ক্ষতি করে গিয়েছে
সেদিন ছিল মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের জন্মদিন। মুঘল ঐতিহ্য অনুসারে সম্রাটকে পাল্লায় তুলে ওজন করা হচ্ছিলো। এই বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ দূত স্যার থমাস রো।
চারপাশ পানিতে ঘেরা চতুষ্কোণ এক মঞ্চে অনুষ্ঠান চলছিল। মঞ্চের ঠিক মাঝখানে স্বর্ণে মোড়ানো বিশাল এক দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হয়।
পাল্লার এক পাশে উঠে বসেছিলেন চতুর্থ মুঘল সম্রাট নুর-উদ-দিন মোহাম্মদ সেলিম, যিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত। আর অন্য পাশের পাল্লায় রাখা হয় মূল্যবান জিনিসপত্র বোঝাই রেশমের থলি।
ভারী পোশাক, মুকুট ও গহনাসহ সম্রাট জাহাঙ্গীরের ওজন হয় প্রায় ১১৪ কেজির মতো। একদিকে সম্রাট বসে রইলেন, অন্যদিকে রেশমের থলিগুলো বারবার বদল করা হলো।
প্রথমে তাকে রূপার মুদ্রায় ওজন করা হয়, যা সঙ্গে সঙ্গেই বিলিয়ে দেওয়া হয় গরিবদের মধ্যে।
এরপর স্বর্ণ, দামি রত্ন, এরপর রেশমের কাপড় এবং শেষে অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী দিয়ে সম্রাটের ওজন মাপা হয়।
প্রায় ৪০০ বছর আগে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে দেখা ধনসম্পদে এই বর্ণনা নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন ব্রিটিশ দূত স্যার টমাস রো।।
এই অঢেল সম্পদ দেখে তার মনে সন্দেহ জেগেছিল যে সিল করা রেশমের ব্যাগগুলোর ভেতরে কি সত্যিই হীরা-মানিক ছিল, নাকি শুধুই নুড়িপাথর?
প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্রিটেনের মতো একটি ছোট দ্বীপের রাষ্ট্রদূত তখন ভারতে কী করছিলেন?
ইংল্যান্ডের সাথে ঐতিহাসিক চুক্তি
আসলে স্যার টমাস একটি বিশেষ মিশনে ভারতে এসেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে দিয়ে এমন একটি চুক্তি সই করানো যাতে একটি ছোট ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়।
স্যার টমাসের দীর্ঘ ডায়েরি থেকে জানা যায়, কাজটি এত সহজ ছিল না এবং কঠোর পরিশ্রমী ইংরেজ রাষ্ট্রদূতকে এ ব্যাপারে অনেক লড়াই করতে হয়েছে।
মুঘল সম্রাটরা তখন ইরানের সাফাভি এবং ওসমানীয় খেলাফত ছাড়া অন্য কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন না।
তাদের দৃষ্টিতে ইংল্যান্ড ছিল এক ছোট্ট অবহেলিত দ্বীপ। তাদের রাজাকে সমতায় এনে চুক্তি করা মুঘলদের মর্যাদার পরিপন্থী ছিল।
তবুও স্যার টমাস হাল ছাড়েননি। তিন বছরের চেষ্টা, কূটনৈতিক চাল এবং নানা উপহার দেয়ার পর তিনি সফল হন।
১৬১৮ সালের অগাস্ট মাসে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের উত্তরাধিকারী যুবরাজ শাহজাহানকে দিয়ে একটি চুক্তি করাতে সক্ষম হন।
মাইলফলক
চুক্তির মাধ্যমে সুরাটে অবাধে ব্যবসার অনুমতি পাওয়া কোম্পানিটির নাম ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই ঘটনা মুঘল শাসনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।
এটাই প্রথম ঘটনা যখন মুঘলরা কোনো ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি করে তাদের একটি কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেয়।
এটা অনেকটা বিখ্যাত ওই গল্পের মতো যেখানে এক বেদুইন উটকে তার তাঁবুতে মাথা ঢোকাতে দেয় আর শেষে পুরো তাঁবুই দখল হয়ে যায়।
স্যার টমাস রো বিস্মিত হয়েছিলেন যে সম্রাটের সাথে এই চুক্তির ফলে কী বিশাল সম্পদ অর্জিত হতে পারে!
স্যার টমাস রো হয়তো মুঘল ধনসম্পদের প্রদর্শনী দেখে সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু তার করা চুক্তির পর ব্রিটেন যে পরিমাণ সম্পদ ভারত থেকে সাড়ে তিনশো বছরের মধ্যে নিয়ে যায়, তা দেখলে তার সেই সন্দেহ হয়তো চিরতরে মুছে যেত।
অর্থনীতিবিদরা এই লুটপাটের পরিমাণ হিসাব করার চেষ্টা করেছেন এবং এ নিয়ে পরে আলোচনা হবে।
তার আগে দেখা যাক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসন ভারতের ওপর যে প্রভাব ফেলেছে সেটা সম্পদ লুটপাটের চেয়েও কত বেশি ভয়াবহ ছিল।
ইতিহাসের চতুর্থ জঘন্যতম নৃশংসতা
আমেরিকান ইতিহাসবিদ ম্যাথিউ হোয়াইট তার বই “দ্য গ্রেট বুক অব হরিবল থিংস”-এ ইতিহাসের ১০০টি অন্যতম নৃশংস ঘটনা পর্যালোচনা করেছেন যে সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।
এর মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের সময় ভারতে ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষ ইতিহাসের চতুর্থ ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয় ছিল। ওই দুর্ভিক্ষে দুই কোটি ৬৬ লাখ ভারতীয় প্রাণ হারিয়েছিলেন।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪৩ সাল) বাংলার দুর্ভিক্ষকে লেখায় অন্তর্ভুক্ত করেননি হোয়াইট যেসময় প্রায় ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।
যদি এই দুর্ভিক্ষকেও হিসাবে নেওয়া হয় তাহলে দেখা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলে দুর্ভিক্ষের কারণে প্রায় তিন কোটি ভারতীয় প্রাণ হারিয়েছিল।
ভারত তখনকার এবং এখনও বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি, তাহলে কেন এত মানুষ ক্ষুধায় মারা গেল?
হোয়াইট এই দুর্ভিক্ষগুলোর পেছনে ‘বাণিজ্যিক শোষণ’-কে দায়ী করেছেন। এর ব্যাখ্যা দিতে ১৭৬৯ সালে বাংলায় ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষের উদাহরণ তুলে ধরা যায়।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা এক কোটি বলে অনুমান করেছেন। সেই সময়ের একটি ভয়াবহ দৃশ্য এক ইংরেজের ভাষায় তুলে ধরা হলো:
“লাখ লাখ মানুষ আর কটা দিন বাঁচার আশায় মারা যাচ্ছিল। তাদের চোখ ছিল ফসলের দিকে। কিন্তু ফসল পাকতে অনেক দেরি হয়ে যায়।”
এই দুর্ভিক্ষ এবং লুটপাট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, বরং ভারতীয় সমাজের গভীরে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছিল।
ফসলের পাশে জমে থাকা হাড়গোড়ের গল্প
ফসল সময়মতো প্রস্তুত হয়, কিন্তু ততক্ষণে সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যায়। প্রায় ২০০ বছর পরে ১৭৬৯ সালের সেই গল্পের পুনরাবৃত্তি হয় পূর্ব বাংলায় ।
টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকার ১৯৪৩ সালের ১৬ই নভেম্বরের একটি প্রতিবেদন বলা হয়েছে:
“পূর্ব বাংলায় তখন এক ভয়াবহ অথচ সাধারণ দৃশ্য ছিল, শতাব্দীর সবচেয়ে ভরা মৌসুমেও ফসলের পাশে পড়ে ছিল পচা-গলা মানব কঙ্কাল।”
সাহির লুধিয়ানভি এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যার দুটি পংক্তি হলো:
“পঞ্চাশ লাখ গলা-সড়া কঙ্কাল, অর্থব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।
নীরব ঠোঁট আর মৃতপ্রায় চোখ দিয়ে, মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।”
দুর্ভিক্ষকে সাধারণত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অংশ হিসেবে ধরা হয়। এতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দোষ কী? বিখ্যাত দার্শনিক উইল ডুরান্ট এ সম্পর্কে লিখেছেন:
“ভারতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল নির্মম শোষণ, শস্যের অসম বন্টন এবং দুর্ভিক্ষের সময়ও জোর করে উচ্চহারে কর আদায়। ফলে ক্ষুধার্ত কৃষকরা সেই কর দিতে পারতেন না। তবুও সরকার মরতে থাকা মানুষদের থেকেও কর আদায়ে ব্যস্ত ছিল।’
কীভাবে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল একটি ছোট কোম্পানি
একটি ছোট কোম্পানি কীভাবে এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠল যে হাজার হাজার মাইল দূরের একটি দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-মরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল?
এর জন্য আমাদের ইতিহাসের আরো কিছু পাতা উল্টাতে হবে।
১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ অভিযাত্রী ভাস্কো দা গামা আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে একটি পথ আবিষ্কার করেন যা ভারতকে ইউরোপের সঙ্গে সমুদ্রপথে যুক্ত করে।
এরপরের কয়েক দশকে পর্তুগিজরা হুমকি, চক্রান্ত ও সংঘর্ষের মাধ্যমে পুরো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
অল্প সময়ের মধ্যেই পর্তুগালের ভাগ্যের তারা মধ্যাকাশে জ্বলজ্বল করতে শুরু করে।
পর্তুগিজদের দেখাদেখি ডাচরাও তাদের কামানবাহী জাহাজ নিয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে। দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ এবং লুটপাট চলতে থাকে।
এদিকে ইংল্যান্ড এই পুরো ঘটনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। তারা কেন পিছিয়ে থাকবে?
সেই চিন্তা থেকেই রানী এলিজাবেথ ১৬০০ সালের ডিসেম্বরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে একচেটিয়া বাণিজ্যের লাইসেন্স দিয়ে দেন।
কূটনীতিতে পূর্ণ মনোযোগ, স্থানীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ
তবে ইংরেজরা একটি কাজ করেছিল যা পর্তুগিজ বা ডাচরা পারেনি। তারা শুধু যুদ্ধ এবং লুটপাটেই নিজেদের শক্তি ব্যয় করেনি, বরং কূটনীতিতেও মনোযোগ দিয়েছিল।
এজন্যই তারা অভিজ্ঞ কূটনীতিক টমাস রো-কে মুঘল দরবারে পাঠিয়েছিল যাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বন্ধ দরজা খুলে দেওয়া হয়।
মুঘলদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমতি পাওয়ার পর, ব্রিটিশরা ভারতের বিভিন্ন উপকূলীয় শহরে একের পর এক বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করতে থাকে যা ফ্যাক্টরি নামে পরিচিতি পায়।
এসব কারখানা থেকে তারা মশলা, রেশম ও অন্যান্য পণ্যের বাণিজ্য শুরু করে, যা থেকে তারা প্রচুর লাভ করতে থাকে, কিন্তু এই কার্যক্রম কেবল বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রায়ই অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত এবং একে অপরের সম্পদ লুট করতো।
ইংরেজরা তাদের ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রচুর সংখ্যক স্থানীয় সৈন্য নিয়োগ শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই এই ফ্যাক্টরিগুলো দুর্গ এবং সেনা ছাউনিতে পরিণত হয়।
যখন কোম্পানির সামরিক ও আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন তারা স্থানীয় শাসকদের দ্বন্দ্বে হস্তক্ষেপ শুরু করে।
তারা আজ কোনো রাজার জন্য সৈন্য পাঠাচ্ছে তো কাল কারো প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে কামান সরবরাহ করছে।
আবার আর্থিক সংকটে থাকা ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আরও গভীরে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
পলাশীর যুদ্ধ: কোম্পানির ক্ষমতার মোড় ঘুরে যায়
কোম্পানির ক্ষমতা বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় হলো ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ।
যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সাধারণ কর্মচারী রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে মাত্র তিন হাজার সৈন্য, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজার সৈন্যকে পরাজিত করেছিল।
কীভাবে এই পরাজয় ঘটে, তার ব্যাখ্যা পাকিস্তান স্টাডিজের বইয়ে লেখা আছে। তবে যুদ্ধের পরে সিরাজউদ্দৌলার শত বছর ধরে সংগৃহীত ধন-সম্পদ জাহাজে লোড করে সমুদ্রপথে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন ক্লাইভ।
যেমনটা কিনা ১৮ বছর আগে নাদির শাহ করেছিলেন। তিনি দিল্লির সম্পদ লুট করে ইরানে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু ক্লাইভ পুরো ধনসম্পদ রাজকোষে জমা দেননি। তার একটি অংশ নিজের জন্য রেখে দেন, আজকের হিসেবে যার বর্তমান মূল্য প্রায় তিন কোটি ডলার।
এই অর্থ দিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে একটি বিলাসবহুল প্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং বিশাল একটি এস্টেট কেনেন, যার নাম দেন ‘পলাশী’।
শুধু তাই নয়, এই অর্থ দিয়ে তিনি নিজের জন্য এমনকি তার বাবার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আসন কিনে নেন এবং পরে স্যার উপাধি লাভ করেন।
‘আমি আরো বেশি লুট করতে পারতাম!’
কিন্তু এর মধ্যেই বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং এর ফলে সেখানকার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মারা যাওয়ার খবর ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে শুরু করে।
লর্ড ক্লাইভের নীতির ফলে এমনটা হয়েছে বলে দায়ী করা হয়। ক্লাইভের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন হলেও, এটি পাশ হয়নি। কারণ, সেই সময় সংসদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সদস্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ছিলেন।
বিতর্কের সময় ক্লাইভ বলেন, “আমি নিজেই অবাক কেন আমি এত কম লুট করেছি! চাইলে আরও অনেক বেশি অর্থ সংগ্রহ করতে পারতাম।”
তবে এইসব সমালোচনা এবং ভারতে ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয়ের প্রভাব ক্লাইভের ওপর পড়তে থাকে এবং তিনি প্রচুর পরিমাণে আফিম সেবন শুরু করেন।
পরে ১৭৭৪ সালে তাকে তার কক্ষে রহস্যজনকভাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ক্লাইভ আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি আফিমের অতিরিক্ত সেবনে মারা গিয়েছিলেন তা আজও অজানা।
তবে এটা স্পষ্ট যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের যে কৌশলগত পথ অনুসরণ করেছিল তা ভারতের স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপ্রতিরোধ্য উত্থান, মুঘল সম্রাটের দাসত্ব
এ সময় মুঘলরা তাদের নিজেদের অক্ষমতা, বহিরাগত আক্রমণ এবং মারাঠা আক্রমণের কারণে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে তারা দূর থেকে ব্রিটিশদের প্রভাব দিনে দিনে বাড়তে দেখেও কিছুই করতে পারেনি।
এভাবে পলাশীর যুদ্ধের মাত্র ৫০ বছরের মাথায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যায় এবং তারা বাংলার সীমানা পেরিয়ে ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে কর্তৃত্ব স্থাপন করে।
পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ হয় যে ১৮০৩ সালে দিল্লির সিংহাসনে আসীন মুঘল সম্রাট শাহ আলম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
একটা সময় ছিল যখন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত টমাস রো সম্রাট শাহ আলমের পূর্বপুরুষ সম্রাট জাহাঙ্গীরের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাথা নত করে থাকতেন।
পরে অবস্থা এমন হয় যে শাহ আলমকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মচারীর সামনে নত হয়ে বাংলার সমস্ত অধিকার হস্তান্তর করতে হয়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এই পুরো কাজটি ব্রিটিশ সরকার করেনি, বরং একটি ব্যবসায়িক কোম্পানি করেছে।
যারা নিজেদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ কৌশল ব্যবহার করতো ও শোষণ করতো।
প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পরেও লন্ডনের একটি ছোট ভবনে মাত্র ৩৫ জন স্থায়ী কর্মচারী নিয়ে কাজ পরিচালনা করতো এই কোম্পানি।
তবুও ইতিহাসে এমন কোনো কোম্পানি নেই যারা এত ক্ষমতাধর ছিল।
আজকালকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা দেশের নীতিকে প্রভাবিত করে।
ভাবুন, যদি গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল, মাইক্রোসফট এবং স্যামসাং একসঙ্গে একটি কোম্পানি তৈরি করত।
তাদের নিজস্ব সশস্ত্র সেনাবাহিনী থাকত, যারা তাদের পণ্য কিনতে অস্বীকার করলে সেই দেশের ওপর আক্রমণ করত! ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা ছিল ঠিক এমনই ভয়ংকর।
আফিমের প্রভাব
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনের সঙ্গে ঠিক এমনটাই করেছিল। আফিমের প্রভাবেই লর্ড ক্লাইভের মৃত্যুর কথা আগেই বলা হয়েছে।
এই আফিম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে উৎপাদন করতো, তবে এর সবটাই কোম্পানির কর্মীরা ব্যবহার করত না। এর বড় অংশ চীন নিয়ে গিয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হত।
যখন চীনারা বুঝল তাদের সঙ্গে প্রতারণা হচ্ছে, তারা আর আফিম কেনা বন্ধ করে দিল।
এভাবে কোম্পানির মুনাফা কমতে থাকে। এখন কোম্পানি কীভাবে তাদের লাভের ঘাটতি সহ্য করবে?
১৮৩৯ সালে তারা কিছু যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে চীনের পুরনো নৌবাহিনী ধ্বংস করে দেয়। এরপর চীনের সম্রাট তার ভুল স্বীকার করে আফিম আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
শুধু তাই নয়, শাস্তি হিসেবে হংকং ব্রিটেনকে দিয়ে দেন। যা ১৯৯৭ সালে গিয়ে আবার চীনের হাতে ফিরে আসে।
এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের প্রভাব আরো বাড়াতে থাকে। একের পর এক রাজ্য ও রাজবংশ কোম্পানির দখলে আসতে থাকে।
১৮১৮ সালে তারা মারাঠা সাম্রাজ্য দখল করে। এর কয়েক দশকের মধ্যে শিখদের পরাজিত করে সমগ্র পশ্চিম ভারত, অর্থাৎ আজকের পাকিস্তান দখল করে নেয়।
এরপর খাইবার গিরিপথ থেকে বার্মা (মিয়ানমার) এবং হিমালয়ের বরফঢাকা পর্বত থেকে রামেশ্বরম পর্যন্ত কোম্পানির শাসন চলতে লাগল।
এভাবে উটটি পুরোপুরি বেদুইনের তাঁবুতে ঢুকে পড়ে এবং বেদুইন বাইরে ছিটকে পড়ে!
ব্রিটিশ রাজের উজ্জ্বলতম রত্ন
সবকিছু ঠিক চলছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য ধীরে ধীরে আসতে শুরু করে। ১৮৫৭ সালে কোম্পানির নিজস্ব বেতনভোগী সৈন্যরা বিদ্রোহ করে যার ফলে ব্যাপক রক্তপাত হয়।
সে সময় সংবাদপত্র বেশ প্রচলিত হওয়ায় এই বিশৃঙ্খলার খবর পৌঁছে যায় ইংল্যান্ড পর্যন্ত।
ধীরে ধীরে কোম্পানির ভাবমূর্তি ব্রিটেনে এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে শেষমেশ জনগণের চাপে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এতে ভারত সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে আসে, রাণী ভিক্টোরিয়ার ‘মুকুটের সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্ন’ হয়ে ওঠে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনোভাবে আরো কয়েক বছর টিকে ছিল, কিন্তু এভাবে আর কতদিন? অবশেষে ১৮৭৪ সালের ১লা জুন, ৩০০ বছরের গৌরবময় ইতিহাস শেষে কোম্পানিটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
টাইমস পত্রিকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিলুপ্তি নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে এভাবে:
“মানবজাতির ইতিহাসে যে অসাধারণ কাজ এটি (কোম্পানি) করেছে, তা অন্য কোনো বাণিজ্যিক কোম্পানি করতে পারেনি এবং আগামী বছরগুলোতেও কোনো কোম্পানি সম্ভবত এমনটা করার চেষ্টাও করবে না।”
না কোনও স্মৃতিসৌধ, না কোনও স্মরণচিহ্ন
টাইমস-এর নিবন্ধে কোম্পানির অসাধারণ পারফরম্যান্সের কথা বলা হলেও কোম্পানির পতনের পর, ব্রিটিশদের কাছে তাদের ‘উল্লেখযোগ্য কীর্তি’ নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু ছিল না।
কারণ আজকের দিনে লন্ডনের লিডেনহল স্ট্রিটে কোম্পানির সদর দফতরের স্থানে এখন একটি আধুনিক ব্যাংকের ঝকঝকে ভবন দাঁড়িয়ে আছে।
কোম্পানির নামে কোনো স্মৃতিসৌধ, মূর্তি, এমনকি কোনও স্মারকফলকও নেই। যেন এর কোনো শেষকৃত্য হয়নি, কোনো সমাধিও হয়নি।
যদিও কোম্পানির ভৌত অবকাঠামো নেই, তবুও এর কাজের প্রভাব এখনো অনুভূত হয়।
সমৃদ্ধ ভারত থেকে দারিদ্র্যের দেশ
অনেকের কাছে অবাক লাগতে পারে যে কোম্পানির আধিপত্যের আগে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল।
বিশ্বের মোট জিডিপির এক-চতুর্থাংশ এখানে উৎপাদিত হতো। অথচ একই সময়ে ইংল্যান্ডের অংশ ছিল মাত্র দুই শতাংশ।
ভারতের ভূমি ছিল উর্বর এবং সব ধরনের সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। দক্ষ শ্রমিক ও কারিগরদের জন্য ভারত ছিল বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র।
ভারতীয় সূতি কাপড় ও মসলিনের চাহিদা ছিল বিশ্বজোড়া। জাহাজ নির্মাণ ও ইস্পাত শিল্পেও ভারতের কোনও তুলনা ছিল না।
কিন্তু ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে কোম্পানি জয়ের পর এই পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারত ছাড়ে তখন আলেকজান্ডারের মতো তাদের ঝোলা পূর্ণ ছিল এবং ভারতের হাত ছিল খালি।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং বলেছিলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগের একটি শক্ত ভিত্তি রয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৭০০ সালে ভারত একাই বিশ্বের ২২ দশমিক ছয় শতাংশ সম্পদ উৎপাদন করত যা গোটা ইউরোপের মোট সম্পদের প্রায় সমান।
কিন্তু ১৯৫২ সালে এই সম্পদের পরিমাণ মাত্র তিন দশমিক আট শতাংশে নেমে আসে।
২০ শতকের শুরুতে ‘ব্রিটিশ রাজের সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্ন’ হয়ে ওঠা ভারত, আসলে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হয়ে পড়েছিল।’
দুশো বছরের লুটপাটের হিসাব
এখন আসি সেই প্রশ্নে যে ব্রিটিশদের ২০০ বছরের শোষণে ভারত ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল?
এ বিষয়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন অনুমান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হলো অর্থনীতিবিদ এবং সাংবাদিক মিনহাজ মার্চেন্টের গবেষণা।
তার হিসাব অনুযায়ী, ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতের মোট আর্থিক ক্ষতি ২০১৫ সালের বিনিময় হার অনুযায়ী ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার।
এক মিনিট থামুন এবং এই বিশাল পরিমাণ অর্থ কল্পনা করুন। এর তুলনায় নাদির শাহের মতো ব্যক্তিও শুধু ১৪৩ বিলিয়ন ডলারে সন্তুষ্ট ছিলেন।
ভারতের ধনসম্পদ এমন ছিল যে ৪০০ বছর আগে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে ভারত আসলেই এতোটা সমৃদ্ধ! সত্যিই কি মুঘল সম্রাটকে সোনা-রূপা ও হীরাতে ওজন করা হচ্ছে, নাকি থলিগুলোর মধ্যে শুধু নুড়ি পাথর রাখা হয়েছে!
যদি স্যার থমাস রোকে কোনোভাবে ফিরিয়ে এনে এই সংখ্যাগুলো দেখানো যেত, সম্ভবত তার সন্দেহ চিরতরে দূর হয়ে যেত।