তত্ত্বাবধায়ক বিলুপ্তির বিধান বাতিল, গণভোট পুনর্বহাল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সন্নিবেশিত কয়েকটি বিধান অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে বাকি বিধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার আগামী সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ দুটি রিটে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে এ রায় দেন। এর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের যে বিধান করা হয়েছিল সেটি অবৈধ হয়ে গেল। আদালতের এই রায়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ সুগম হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। আদালত বলেন, ধারা দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে। ওই দুটিসহ পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক,৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। এ ছাড়া সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছিল। যে কারণে এটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল। আদালত আরও বলেন, সংবিধানের মূল কাঠামো হচ্ছে গণতন্ত্র। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই পারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। সংবিধানের সৌন্দর্য হচ্ছে জনগণের ক্ষমতায়ন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। রায় ঘোষণা শেষে পঞ্চদশ সংশোধনী মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে আপনারা একজন নারী বিচারপতির বেঞ্চে এসেছিলেন। একজন নারী বিচারপতির ওপর আস্থা রেখেছেন, এ কারণে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। এ রায় দিতে পেরে আমি গর্বিত। আমি মনে করি নারী জাতির জন্য এটি গর্বের বিষয়। এ রায় দেয়ার সময় আমরা জনগণের চাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছি। এ সময় আইনজীবীরাও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
আলোচিত এই রিটের রুল শুনানিতে সুজনের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপি’র পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ও সিনিয়র আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল। আর জামায়াতের পক্ষে ছিলেন এডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। ইনসানিয়াত বিপ্লব দলের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুর রউফ ও ইশরাত হাসান।
যেসব বিষয় বাতিল হয়েছে:
ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ আবেদনকারীর আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আনা বেশ কয়েকটি সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ এবং সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য সংক্রান্ত ৭ক এবং ৭খ বাতিল করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের বিধান নিয়ে হাইকোর্টের ক্ষমতা কমানো বিষয়ক ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধান বাতিল করার বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে। ফলে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধনে হাইকোর্টের এই রায়ে গণভোটের বিধান ফিরে আসলো। রায়কে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, ৭ক ও ৭খ, ৪৪ (২) ও ১৪২ অনুচ্ছেদ বিষয় এই রায়ের ফলে বাস্তবায়িত হয়ে গেল। সংসদের মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল- সেটির প্রতিবন্ধকতা আজকে পার হলাম।
বাতিল হওয়া অনুচ্ছেদে যা বলা ছিল: সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ সংক্রান্ত ৭ক অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদের (১) বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়- (ক) এ সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে; কিংবা (খ) এ সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে- তার এ কাজ রাষ্ট্রদ্রোহ হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। (২) কোনো ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত- (ক) কোনো কাজ করতে সহযোগিতা বা উস্কানি দিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করলে- তার এরূপ কাজও একই অপরাধ হবে। (৩) এ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য সংক্রান্ত ৭খ-তে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে।
মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ সংক্রান্ত ৪৪ (২)- এ বলা হয়েছে, এ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের মাধ্যমে অন্য কোনো আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওইসব বা তার যেকোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করতে পারবে। তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত ৫৮ক অনুচ্ছেদ বিলুপ্তি এবং ক পরিচ্ছেদ এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তি। এ ছাড়া সংবিধানের বিধান সংশোধনের ক্ষমতা সংক্রান্ত গণভোটের বিধান বাতিল সংক্রান্ত ১৪২ এর অনুচ্ছেদ। আদালত বলেছেন, গণভোট সংক্রান্ত ১২তম সংশোধনী এখানে বহাল হবে।
যা বাতিল হয়নি: সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটা আদালত বাতিল করেননি বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা কয়েকটি ধারা আদালত বাতিল করেছেন। বাকিগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে এবং সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে। একইসঙ্গে তখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা নিশ্চিত করার বিধান আনা হয়। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের ভাষণ, ছাব্বিশে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখল করলে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা ও সংরক্ষিত নারী আসন ৫০-এ উন্নীত করা এবং জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, আমরা পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চেয়েছিলাম। আদালত বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করলেও অন্যগুলো বাতিল করেননি। আদালত বলেছেন, বাকিগুলোর বৈধতাও তিনি দিচ্ছেন না। সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে। শরীফ ভূঁইয়া আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হলো। তবে সেটা এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না; কারণ, সেটা বাতিল করা হয়েছিল দুইভাবে। আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।
বর্তমান সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে পারে: এটর্নি জেনারেল
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ব্যক্তিরা (অন্তর্বর্তী সরকারের) যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে চলে যাবেন, ওনারা তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবেন। এটার সাংবিধানিক সাংঘর্ষিক কোনো জায়গা নেই। এক প্রশ্নের জবাবে এটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, এই (অন্তর্বর্তী) সরকার রিনেমড (নতুন নাম) হবে। যেমন, জেলা ও দায়রা জজের নাম শুনেছেন। একই ব্যক্তি যখন সিভিল মামলা করেন, তখন তাকে বলা হয় জেলা জজ। একই ব্যক্তি যখন ক্রিমিনাল মামলা করেন, তখন তাকে বলা হয় দায়রা জজ। অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করার প্রক্রিয়া কেমন হবে, জানতে চাইলে এটর্নি জেনারেল বলেন, সেটা সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারণ করবেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে এটর্নি জেনারেল বলেন, এই সরকার যদি ১৩ অ্যামেন্ডমেন্টের (ত্রয়োদশ সংশোধন) রায়ের পরে আমরা দেখি, অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার কী সেটা করতে পারবে? জবাবে তিনি বলেন, কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে। আসাদুজ্জামান বলেন, রায়ে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিকভাবেই বৈধ সরকার। এর (অন্তর্বর্তী সরকার) সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংঘর্ষিক অবস্থান নেই। এটর্নি জেনারেল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসহ বিচার বিভাগ ধ্বংসে সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দায়ী করেন। আসাদুজ্জামান বলেন, জ্ঞানপাপী একজন জাস্টিস ছিলেন খায়রুল হক। উনি মূল রায় থেকে ডিভিয়েন করে (পথভ্রষ্ট) ১৭ মাস পর রায় প্রকাশের সময় উনি সেখানে বলেছেন, পরবর্তী দুটি নির্বাচন কোন ফর্মে হবে তা সংসদে ঠিক হবে। উনাদের থেকে দলছুট হয়ে সিনহা বাবু বলছেন (বিচারপতি এস কে সিনহা), আগামী দুটি নির্বাচনই হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্ডারে। খায়রুল হকের সঙ্গে তাল মিলালেন… ওই যে আরেকটার নাম… জুডিশিয়ারিকে যে ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। তখন একজন বলেন, মানিক (সাবেক বিচারপতি) সাহেব, এরপর এটর্নি বলেন, না না, জুডিশিয়ারি মানিক যতটুকু ধ্বংস করেছে, তার চেয়ে ধ্বংসের পেছনে দায়ী সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (সাবেক প্রধান বিচারপতি) নামে একজন জাস্টিস ছিলেন।
বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা যা বলেন: বিএনপি’র পক্ষের আইনজীবী দলটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলন, আদালতের আজকের রায়ের ফলে সংবিধান ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া যেই অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন সেই অবস্থায় ফিরলো। সিনিয়র আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর মোট ছয়টি বিধান বাতিল করেছে। ওই সংশোধনীতে ৫৪টি পরিবর্তন আনা হয়েছিল। বাকিগুলো পরবর্তী সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। পরবর্তী সংসদ এসে যৌক্তিক মনে করলে রাখবে, অথবা রাখবে না।
জামায়াতের পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, আদালত রায়ে বলেছেন- গণতন্ত্র হলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোয় পরিণত হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এমন কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল যাতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়। তিনি বলেন, রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক,৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। এডভোকেট শিশির মনির বলেন, রায়ে আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ রেখেছেন কিছু অংশ বাতিল করেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। কিছু বিধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার আগামী জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
২০১১ সালের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং প্রেসিডেন্ট ২০১১ সালের ৩রা জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ ছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়। এই সংশোধনী বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। গত ১৯শে আগস্ট হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে। পরে এই রুল সমর্থন করে সহায়তাকারী (ইন্টারভেনার) হিসেবে যুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণফোরাম, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা। তাদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও রিট করেন।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ সুজন সম্পাদকের
হাইকোর্টের দেয়া রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, রায়ে আমি খুব উৎফুল্ল, আনন্দিত এবং অত্যন্ত সন্তুষ্ট। আমি মনে করি এটা একটা ঐতিহাসিক রায়। এটা একটা সেমিনাল জাজমেন্ট। এই রায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচিত হলো বলে তিনি মনে করেন। মঙ্গলবার রায়ের পর বদিউল আলম মজুমদার এ মন্তব্য করেন।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দু’ভাবে কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। আরেকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংবিধানে ৭ (ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করার মাধ্যমে। সংবিধান সম্পর্কে কোনো রকম জনগণের আস্থা পরাহত করা এবং এই সংবিধান সম্পর্কে কোনো রকম সমালোচনা করা। এগুলো হলো রাষ্ট্রদ্রোহ। বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, আদালত বিষয়টি রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও নাগরিকের পক্ষে তারা লড়েছেন। তারা সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পথে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য রিট করেছেন। তিনিসহ বহু ব্যক্তি এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। আদালত তাকে এবং এ ব্যাপারে যারা সোচ্চার ছিলেন তাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ধন্যবাদ দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ই আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। গত ১৯শে আগস্ট প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এই রুলে ইন্টারভেনার হিসেবে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, সংস্থা, ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকজন যুক্ত হন। শুনানিতে রিট আবেদনকারী, বিএনপি, রাষ্ট্রপক্ষ, জামায়াত, গণফোরাম, ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য তুলে ধরেন।