ধর্ষণ এখন আর কোনো অপরাধ নয় সু চি’র দৃষ্টিতে
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃসাবেক মানবাধিকার কর্মী অং সান সু চি মায়ানমার সরকারের নেতৃত্বে থেকেও দেশটির সেনাসদস্যদের ধর্ষণের মত ভয়ঙ্কর নির্যাতন থেকে রাখাইন অঞ্চলে নারীদের রক্ষার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। বরং রাখাইনে নারীদের নির্যাতনের কোনো বিকল্প নেই এমন ধারণাই সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর সু চি। সু চির মন্ত্রিসভার দুটি মন্ত্রণালয়- পররাষ্ট্র ও স্টেট কাউন্সিলরের অফিস অন্য যে কোনো মন্ত্রণালয়ের চেয়ে বরং জোর দিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে রাখাইনের নারীদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। গত শুক্রবার মায়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অফিস প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে রোহিঙ্গা নারীরা সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তাদের ধর্ষণের মত ঘটনার গল্প ফাঁদছে। ভুয়া ধর্ষণের দাবি করছে। গত ১৩ ডিসেম্বর দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অফিস ব্রিটিশ মিডিয়া গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণের অভিযোগকে অস্বীকার করে এবং রাখাইন অঞ্চলে যে সব গ্রামের নারীরা তাদের ধর্ষণের অভিযোগ করছে তা গুজব বলে অভিহিত করে। গত শনিবার মায়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের অফিস তাদের গঠিত তথ্য অনুসন্ধান কমিটির বরাত দিয়ে বলে, তারা রাখাইন অঞ্চলে কোনো গ্রামে নারী ধর্ষণের কথা শোনেনি। যদিও গত ২১ ডিসেম্বর দুই জন রোহিঙ্গা নারী গার্ডিয়ানের সাংবাদিকদের কাছে মায়ানমারের সেনাদের হাতে তাদের ধর্ষণের অভিযোগ করে। একদিকে মায়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও নির্যাতন চালাচ্ছে, অন্যদিকে এটি গুজব বলে অপপ্রচার করছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ও রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা নারীরা সাংবাদিকদের কাছে তাদের ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ করছে। এর পরেও রাখাইন অঞ্চলে কোনো মিডিয়াকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না, আন্তর্জাতিক কোনো তদন্ত সংস্থাকে সেখানকার পরিস্থিতি কি তা যাচাই করে দেয়ার সুযোগ দিচ্ছে না মায়ানমার সরকার। এমনকি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর রোহিঙ্গাদের গলা কেটে হত্যার ঘটনাও ঘটছে যা মায়ানমার টাইমসসহ দেশটির মিডিয়ায় খবর হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ মায়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আই আই সো আইআরআইএন’কে বলেছেন, তাদের হত্যা, নির্যাতন, বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগের অধিকাংশই বানানো গল্প। এটা বাড়াবাড়ি। আমাদের বিরুদ্ধে এধরনের অভিযোগ মিথ্যা এবং এধরনের নির্যাতনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। মায়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয় গত ৩ নভেম্বরে রাখাইন অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক তথ্য উপস্থাপন করে যেখানে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়া রাখাইন অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের কথা বলছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বানানো এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজসে এধরনের প্রচারণা চলছে। মায়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের বিবৃতি প্রকাশের আগে সু চি তা সযত্নে দেখে দিয়েছেন। অবশ্য সু চি মায়ানমারের সেনাবাহিনী যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নারীদের ধর্ষণ করে তা ক্ষমতায় আরোহনের আগে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে বারবার তা বলেছেন এবং অবিলম্বে তা বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সু চির এধরনের অবস্থান ও অভিব্যক্তি মায়ানমারের সেনাদের কাছে এই বার্তাই দিচ্ছে যে ধর্ষণ আর কোনো অপরাধ নয় এবং এধরনের ধর্ষণের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে সু চির চোখের সামনেই। যা তিনি অবহিত। ২০১৫ সালে মায়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে প্রচার অভিযান শুরু করার পূর্বে সু চিকে মনে হচ্ছিল নারী অধিকার রক্ষায় একজন আদর্শবান ও চ্যাম্পিয়ন যোদ্ধা। তিনি ইতোমধ্যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার হস্তগত করেছেন। তিনি মায়ানমারে পিতৃতন্ত্রের যথেষ্ট সমালোচনা করতেন, এমনকি সেনাবাহিনীরও। ২০১১ সালে অং সান সু চি নোবেল বিজয়ী নারীদের একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমার দেশে নারীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়, যারা শান্তিতে বাস করতে চায়, সেই সব নারী যারা শুধুমাত্র তাদের মৌলিক মানবাধিকার টুকু চায়। বিশেষ করে সেই সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের ধর্ষণ করা হয় এবং ধর্ষণ কেবলি বদলা হিসেবে বহুল প্রচলিত। ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সেনাবাহিনী কারণ তারা ধর্ষণ করে জাতিগতভাবে তাদের নিধন করতে চায় এবং আমাদের দেশকে বিভক্ত করে তোলে।’ সেই সু চি ধর্ষণ সম্পর্কে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন তা ভুলে গেছেন। অথবা তিনি যেন ধর্ষণের কথা আদতেই কোনোদিন শোনেননি, এমন ভাব করছেন। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সু চির অবস্থান পাল্টে যাওয়ায় তিনি খুব শীঘ্রই তার ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছেন যা নারীর অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় জয়গান গাইত। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সু চি মায়ানমার সংসদে সাংসদ নির্বাচিত হন এবং এর এক বছরের কম সময়ে তার রাজনৈতিক দল এনএলডি ক্ষমতায় আরোহন করে। তখন সু চিকে জিজ্ঞেস করা হয় তার দেশের সেনাবাহিনী নারী ধর্ষণকে একটি অমোঘ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যে উপভোগ করে এবং তা যে কোনো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না বলে তারা যে পার পেয়ে যায় সে ব্যাপারে তার কোনো উদ্বেগ অবশিষ্ট রয়েছে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তরে সু চি কি বলেছিলেন তা উইমেন লিগ অব বার্মার একটি প্রামাণ্যচিত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং এখন রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের ঘটনায় সু চি কেন নিশ্চুপ রয়েছেন তাও পরিস্কার হয়ে গেছে। এজন্যেই সু চি এখন বলছেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পুরুষরাও নারী ধর্ষণ করে। এটা তার ২০১১ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর নারী ধর্ষণকে জায়েজ করার জন্যে এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্যে বক্তব্য কি না তা অবশ্য এখনো তিনি পরিষ্কার করেননি। ইয়াঙ্গুনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সু চি বলেন, সেনাবাহিনী যা করছে তা আইনের শাসন রক্ষার জন্যে করছে এবং রাজনীতিতে এটাই করা উচিত। সেনাবাহিনীর অবস্থানও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই সঠিকভাবে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সাংবাদিকদের প্রতি লক্ষ্য রেখে সু চি বলেন, আপনারা ভালভাবেই জানেন, মায়ানমারের সেনাবাহিনী কেবল মাত্র সামরিক বাহিনী নয়, সংঘাতের প্রেক্ষিতে, দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়ে এ বাহিনীকে যৌন সন্ত্রাস বেছে নিতে হয়েছে। কিন্তু যখন রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের অভিযোগ তদন্তের দাবি উঠছে এবং সু চি যুদ্ধপরিস্থিতিতে ধর্ষণ জায়েজ মনে করেই তার নিন্দা করছেন না এবং তার এ অবস্থান নির্বাচন ও সরকার প্রধান হওয়ার আগের অবস্থানের চেয়ে ভিন্ন অবস্থানকেই সুস্পষ্ট করে তুলছে। অর্থাৎ অং সান সু চি রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণকে সহজ করে তুলছেন, এবং এ ধর্ষণের সঙ্গে সহজভাবে নিতে বলছেন। কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও বিবেচনায় হয়ত সু চি ২০১১ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর ধর্ষণ অস্ত্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু এখন কয়েক বছর পর সময় পাল্টে গেছে সুচির, এতে আমরা বিভ্রান্ত হতে পারি কিন্তু সু চি তার সেনাবাহিনীকে ধর্ষণ অস্ত্র ব্যবহারে দায়মুক্তি দিয়েই যাবেন এই মনস্থির করেছেন পরিস্থিতি বিবেচনায়। এটাই সু চির রাজনৈতিক পান্ডিত্য ও ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব যা রোহিঙ্গা নারীদের সম্ভ্রম লুটে নিতে সাহায্য করছে, তাদের পরিবারকে বিপন্ন করে তুলছে এবং সর্বোপরি মায়ানমারের উন্নয়নকে অনিশ্চয়তার পথে এক ভেল্কিবাজি হিসেবে উম্মোচিত করছে। ২০১১ সালে সু চি নোবেল বিজয়ী নারীদের অনুষ্ঠানে এও বলেছিলেন, প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনা আমাদের দেশকে বিভক্ত করে তোলে সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি করে। আমাদের কাছে আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে, অং সান সু চি বিভক্তির কোন পাশে অবস্থান নিয়েছেন। সূত্র: এমএসএন নিউজ