সুনামগঞ্জের হাওরে হাহাকার

Spread the love

62930_f1সিলেট অফিসঃ এ মুহূর্তে ঘুমহীন রাত কাটানোর কথা ছিল হাওরে হাওরে। ধান কাটা, ধান ভাঙা, আর গোলায় ধান ভরার কাজে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল গ্রামের নারী-পুরুষ সকলেরই। ঘুমহীন রাত ঠিকই কাটছে তাদের, তবে তা স্বপ্ন খুইয়ে। হঠাৎ আসা বানের জলে ফসল তলিয়ে গেছে। যা কিছু বেঁচে গেছে তা রক্ষার্থে দিনরাত হাওরে হাওরে দিন কাটিয়েও রক্ষা করতে পারেনি। চোখে ঘুম নেই, পেটে দানা নেই। বাঁধ ভেঙে হু-হু করে পানি ঢুকছে হাওরের ফসলি জমিতে। পানি ঝরছে কৃষকের চোখেও। ঘোর এক অনিশ্চিত জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে তারা। মাঠের ফসল ভেসে গেছে। এরপর পচা জলে মড়ক দেখা দেয় হাওরের মৎস ভাণ্ডারে, মরতে শুরু করে হাওর পারের হাঁসগুলোও। হাওর পারের মানুষ কেউই মনে করতে পারছেন না তারা কোনো দিন এমন দুর্যোগ দেখেছিলেন কিনা। এত কিছুর পরও আশা হয়েছিল শনির হাওর আর পাকনার হাওর। প্রাণান্তর চেষ্টার পরও রক্ষা করা যায়নি এ হাওর দুটির ফসল। রোববার শনির হাওরে আর সোমবার পাকনার হাওরে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করতে থাকে। একে একে ভেসে যায় সুনামগঞ্জের কৃষকদের ভরসার শেষ আশা। শেষ স্বপ্ন।
ধান আর মাছ, হাওর পারের মানুষের জীবন মূলত এই দুইয়ের সঙ্গে বাঁধা। বছরের অর্ধেক সময় হাওরজুড়ে পানি থাকায় এসব এলাকার মানুষ একটি ফসল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। আর হাওরজুড়ে যখন পানির বিস্তৃতি থাকে তখন তাদের দিন কাটে মাছের সন্ধানে। বছরের অর্ধেক যদি হাওর ধান দিয়ে ভরিয়ে দেয়, বাকি অর্ধেক ভরিয়ে দেয় মাছ দিয়ে। মাছে-ধানে তাই হাওরপারের মানুষের দিন কাটে হাসি-গানেই। কিন্তু এবার হাওরপারের জীবন পুরো উলট-পালট হয়ে গেছে অসময়ের অতিবৃষ্টি ও উজান বেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে। সুনামগঞ্জের কৃষকরা ধান ঘরে তোলার জন্য বৈশাখের অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন। তাদের অপেক্ষাকে আশঙ্কায় পরিণত করে বৈশাখ আসার  দিন পনেরো আগে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। উজান থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢলও। বাঁধ ভেঙে সেই পানি ঢুকে পড়ে হাওরে হাওরে। মাটিয়ান হাওর, চন্দ্রসোনারথাল, ধানকুনিয়া, ছায়ার হাওর, দেখার হাওর, করচার হাওর, কালিকুটার হাওরের পুরো ফসল ভেসে যায় বাঁধভাঙা জলে। এ বছর  সুনামগঞ্জে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮১৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে চাষাবাদ করা হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে। ধানের চাষ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে ধানের চাষ হওয়ায় এবার বাম্পার ফলনের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন কৃষক। তবে পানির তোড়ে ভেসে গেছে কৃষকের স্বপ্নের সোনালি ধান।
হাওরে তলিয়ে থাকা ধানের গাছ পচে গিয়ে একপর্যায়ে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয়, পাশাপাশি পানিতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। সোমবার মৎস্য অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা হাওর পরিদর্শনের সময় পরীক্ষা করে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ০.০১ থেকে ১.১৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) দেখতে পান, যা স্বাভাবিক মাত্রার (৫ থেকে ৮ পিপিএম) চেয়ে আশঙ্কাজনকভাবে কম। একই সঙ্গে অ্যামোনিয়ার পরিমাণও ছিল মাত্র ০.০৪ থেকে ০.০৮ পিপিএম, যা অস্বাভাবিক। অ্যামোনিয়ার লিথাল মাত্রা পাওয়া গেছে ০.২ পিপিএম। গ্যাসের বিষক্রিয়া ও অক্সিজেনের সংকটে হাওর এলাকায় মাছে মড়ক দেখা দিয়েছে। মাছ মরে পানিতে ভেসে উঠতে থাকে।  দুর্গন্ধে ভরে উঠে হাওর ও আশপাশের এলাকা। সুনামগঞ্জ জেলায় সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ মৎস্যজীবী রয়েছেন। তারা এখন কর্মহীন হয়ে গেছেন। মাছ কেউ কিনছেন না। তাই মাছ ধরা বন্ধ। সুনামগঞ্জ থেকে আহরিত মাছ রপ্তানিও বন্ধ হয়ে গেছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, হাওরের পানিদূষণে প্রায় ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। এছাড়া মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস।
সব মিলিয়ে হাওরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারি উৎস থেকে রোববার পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই হিসাব বের করেছে হাওর নিয়ে কাজ করা ৩৫টি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম। এ হিসাবে বন্যায় নষ্ট হওয়া ১০ লাখ টন চাল, ২ হাজার টন মাছ ও ১১ হাজার ৩০৫ টন গো-খাদ্যের বাজারমূল্য ধরা হয়েছে। তবে সংগঠনটি বলছে, স্থানীয় হিসাবে মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে যাবে।
হাওরের এ ক্ষতির অধিকাংশই সুনামগঞ্জের বুক চিরেই ঘটে গেছে।
হাওরের এমন হাহাকারের মাঝেও সুনামগঞ্জে আশা হয়ে ছিল শনির হাওর ও পাকনার হাওর।  সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত শনির হাওরে এবার ২২ হাজার একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। অন্যান্য হাওরে যখন পানি ঢুকতে থাকে তখন শনির হাওর পারের বাসিন্দা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই দিন রাত বাঁধরক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৩ দিন তারা লড়াই করে হাওরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেও শেষরক্ষা আর হয়নি। রোববার সকাল থেকে অতিবৃষ্টির পাশাপাশি ভারতের মেঘালয় পাহাড় ঘেঁষে প্রবাহিত যাদুকাটাসহ সীমান্তের অন্যান্য ছোট নদী দিয়ে প্রবাহিত পাহাড়ি ঢলে শনির হাওরের লালুর গোয়ালা বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করতে থাকে। এরপর আর পানি আটকে রাখা যায়নি। তলিয়ে যেতে থাকে হাওরের ফসল। এরপরও আশা হয়ে ছিল জামালগঞ্জের পাকনার হাওর। বাঁধরক্ষায় স্থানীয়দের ২৪ দিনের লড়াইকে ব্যর্থ করে দিয়ে সোমবার ভোররাতে হাওরের উড়ারকান্দি এলাকার বাঁধটি ভেঙে যায়। এরপর হাওরে প্রবল বেগে ঢলের পানি ঢুকে পড়ে।
সুনামগঞ্জের হাওর থেকে এখন আর কোনো ধান উঠবে না কৃষকের ঘরে। সব ধরনের ফসল হারিয়ে হাওরনির্ভর ২০ লাখ মানুষ এখন ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে। হাওরের হাসিখুশি জীবনে চরম খাদ্যাভাবের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি যে সহায়তা মিলছে, বা মেলার আশ্বাস মিলেছে তা দিয়ে হাওর জীবনকে সচল করে তোলা কষ্টসাধ্য বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


Spread the love

Leave a Reply