লন্ডনে বাঁচার আর্তনাদঃ শতাধিক মৃত্যু
বাংলাদেশি পরিবারের আকুতিঃ আমরা সবাই মরে যাচ্ছি, শুধু দোয়া করবেন যেন বেশি কষ্ট না-পেয়ে মরি!
বাংলা সংলাপ রিপোর্ট
লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে মোট কত জন মানুষ নিহত হয়েছেন তার সঠিক কোন খবর এখনো জানা যাচ্ছে না । ধারনা করা হচ্ছে ভবনটিতে শতাধিক মানুষের শরীর সমাধি হতে পারে । তবে বিবিসি এখন পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। ডেইলি মেইল বলছে শতাধিক মৃত্যুর কথা । লেবার এমপি ডেভিড লেম্মিও ধারনা করছেন মৃত্যুপুরি এই ভবনটি শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন । প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ও বিরোধী দল নেতা জেরেমি করবিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন । রাণী দ্বিতীয় এলিজাভেথ শোক প্রকাশ করেছেন ।
ভবনটিতে ৪ (চার) শতাধিক মানুষ বসবাস করতেন । এর মধ্যে ৭৮ জনকে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে সক্ষম হয়েছে । আবার কেউ কেউ নিজের চেষ্টায় ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন । তবে কতজন বের হয়ে এসেছেন অথবা কত জন ভিতরে আটকা পড়েছিলেন এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার সঠিক কোন ধারনা পাওয়া যাচ্ছে না ।
৩৬ ঘণ্টা পরও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে গ্রেনফেল টাওয়ার নামের সেই ভবনে।ধসে না পড়লেও পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে ভবনটি। সেখান থেকে জীবিত কাউকে উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে ভবনজুড়ে সারি সারি ভস্মীভূত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এখনও ভবনের বাসিন্দা অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের সন্ধানে হন্যে হয়ে খুঁজছেন স্বজনরা। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশী একটি পরিবারও। ওই পরিবারটি হলো কমরু মিয়ার। এ পরিবারে অগ্নিকাণ্ডের সময় উপস্থিত ছিলেন কমরু মিয়ার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে। অগ্নিকাণ্ডের সময় তারা একটি বাথরুমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় নি। একই অবস্থা আরো অনেকের। ফায়ার সার্ভিস বলছে এখন ভবনটিতে ‘আর কেউ বেঁচে থাকার আশা নেই’
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াতে এখনও পরিপূর্ণ উদ্ধার অভিযান চালানো যায়নি। তাই মরদেহেরসঠিক সংখ্যাও নিরুপণ করা যায়নি। ১৭ জনের নিশ্চিত প্রাণহানির বাইরেও নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে।হন্যে হয়ে তাদের খুঁজছেন স্বজনরা।
বুধবার রাতে পশ্চিম লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারে আগুন লাগে। রাত ১টা ১৫ এর দিকে আগুনের সূত্রপাতহয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগুনের তাণ্ডবে ভবনটি একদম ছারখার হয়ে যাওয়ায় ১৭ প্রাণহানিরপাশাপাশি শতাধিক মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে নির্মিত ভবনটিতে ১২০টি বাসা ছিলো। ওই ভবনে ৪০০ থেকে৬০০ মানুষের বসবাস করত বলে ধারনা। তবে আগুন লাগার পর ঠিক কতজন বের হতে পেরেছেন বা কত জন আটকা পড়েছেন সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি। ভবনের ভেতরে বহু মানুষের জিম্মিহয়ে থাকার খবর জানিয়েছিল প্রত্যক্ষদর্শীরা। একটা পর্যায়ে ঘরের ভেতরে আটকা পড়ে তারা জানালা দিয়ে জীবনের আর্তি জানাতে শুরু করে। তবে এখন আর কোনও প্রাণের আর্তি নেই ওই ভবনে।
বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যম ডেইলিং মেইলের বিশেষ ব্যবস্থায় নেওয়া ছবিতে দেখা গেছে, বিতর্কিত বৃষ্টি প্রতিরোধী প্রলেপে মোড়ানো ভবনটিতে এখন সারি সারি ভস্মীভূত বস্তু। পুড়ে যাওয়া আসবাব গুলোর এমন অবস্থা যে এখন বোঝার উপায় নেই কোনটা কী জিনিস। ভবনের বিভিন্ন কক্ষে ভস্মীভূত জানালা,গলে যাওয়া টেবিল আর বিভিন্ন আসবাবের সমাহার। দেখা গেছে অর্ধেক কাপড়ে ভর্তি ওয়াশিংমেশিন, যেনভবনের বাসিন্দাদের জীবনের আর্তির এক আধমরা সাক্ষী।
ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত রয়েছে ৪০টি ইউনিট ও ২০০ দমকলকর্মী। ডেইলি মেইল জানিয়েছে,ভবনের উপরের তলাগুলোতে উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। বুধবার সকাল পর্যন্তও ভবনে জীবিত মানুষছিলেন। উদ্ধার কর্তৃপক্ষের ধারণা, তাদের কেউ এখন বেঁচে নেই। ফায়ার সার্ভিসের দাবি অনুযায়ী, তারাএখনও জানেন না যে ভেতরে কতজন মৃত রয়েছেন।
ভঙ্গুর ও ভস্ম হয়ে যাওয়া ভবনে স্বতস্ফূর্ত উদ্ধার অভিযানকে বিপদজনক মনে করছে সে দেশের ফায়ারসার্ভিস। লন্ডন ফায়ার সার্ভিসের প্রধান ড্যানি কটন স্কাই নিউজকে বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমরা এখনকাউকে জীবিত উদ্ধার করার আশা করতে পারছি না। এরকম অগ্নিকাণ্ডে কেউ বেঁচে গেলে সেটাঅলৌকিক ব্যাপার হবে।’ অবশ্য কারও জীবিত থাকার সম্ভাবনা না থাকলেও ‘মিরাকল’ কিছু ঘটারআশায় ডগ স্কোয়াড পাঠানো হয়েছে ভবনের অভ্যন্তরে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উদ্ধারকাজ এখনও শেষ হয়নি। ভবনের অভ্যন্তরে আরও তৎপরতা চালাবেন তারা।পৃথক এক সাক্ষাতকারে লন্ডন ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কটন বলেন, এই মুহূর্তে ভবনের কিছু স্থানঅনিরাপদ। গতরাতে ভবনের উচতলায় আমাদের দমকলকর্মীরা উদ্ধার অভিযান চালিয়েছে। সেখানেথেকে প্রাথমিক তল্লাশি করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যদিও আমরা সেখানে গিয়েছি কিন্তু পুরোপুরি উদ্ধারঅভিযান চালানো এখনও সম্ভব হয়নি। ভবনটি পুরোপুরো নিরাপদ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত আমিদমকলকর্মীদের ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না।’
কটন বলেন, স্ট্রাকচারাল সার্ভেয়ার ও আরবান উদ্ধার বিশেষজ্ঞরা বৃহস্পতিবার ভবনটি পরীক্ষা করেদেখবেন। তারা নিরাপদ ঘোষণা করার পর উদ্ধার অভিযান চালানো হবে।
এবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবারের অগ্নিকাণ্ডের ১৮ মাস আগেই বসবাসরতদেরআগুনের ঝুঁকির ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একপ্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে ভবনটির অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলোগ্রেনফেল অ্যাকশন গ্রুপ। রিপোর্টে বলা হয়, বেসমেন্ট, লিফটের মোটর রুপ ও গ্রাউন্ড ফ্লোরের ইলেক্ট্রিকালরুমের অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র এক বছরেরও বেশি পুরাতন ছিলো। আর ২০০৯ সালের পর থেকে সেগুলোপরীক্ষাও করা হয়নি বলে দাবি করে গ্রুপটি। সেসময় তারা আরও জানায় যে টেনান্ট ম্যানেজমেন্টঅর্গানাইজেশন বাড়ি নির্মাণের সময় রাবিশ ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
গ্রেনফেল অ্যাকশন গ্রুপ নিজেদেরকে ল্যাঙ্কাস্টার ওয়েস্ট কমিউনিটর সেবায় নিয়োজিত বলে দাবি করে।২০১০ সালে গঠিত এই সংস্থাটি এর আগে ল্যাঙ্কাস্টার
আটকা পড়া বাংলাদেশী পরিবারঃ
“চাচাতো বোনের ফোন পেয়ে তখন সবেমাত্র ওই টাওয়ার ভবনের নিচে গাড়ি নিয়ে পৌঁছেছি। কয়েক মিনিট বাদেই দেখি আঠারো তলার ফ্ল্যাটের জানালা খুলে চাচা পরিত্রাহি চিৎকার করছেন আমাদের বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও। আগুন আমাদের ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে পড়ছে!”
“তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার চাচাতো বোন তানিমার ফোন এল, ওই শেষবারের মতো। বলল, আগুন পুরো ফ্ল্যাট ছেয়ে ফেলেছে – বাথরুমটা শুধু এখনও বাকি। আমরা সবাই মরে যাচ্ছি, শুধু দোয়া করবেন যেন বেশি কষ্ট না-পেয়ে মরি!
“ব্যাস – আর কোনও কথা বলতে পারিনি। আমার দুচোখ পানিতে ভিজে এল। তারপর যতবারই তানিমার নম্বর মিলিয়েছি, সেই কল শুধু বারবার ভয়েস মেলেই গেছে।”
লন্ডনের লাটিমার রোডের কাছে গ্রেনফেল টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে স্বজনদের হারানো কেনসিংটনের আবদুর রহিম এভাবেই বিবিসির কাছে বর্ণনা করছিলেন কীভাবে ভয়াবহ আগুন গ্রাস করে নিয়েছে তার চাচা কমরু মিঞার পরিবারকে।
ওই বহুতলের আঠারো তলার একটি ফ্ল্যাটে দশ-বারোমাস আগে সাময়িকভাবে এডমন্টন থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল বাংলাদেশি ওই পরিবারটিকে।
নব্বই-ঊর্ধ্ব কমরু মিঞার অত ওপরে চলাফেরায় কষ্ট হত, তিনি আর্জিও জানিয়েছিলেন নিচের তলার কোনও ফ্ল্যাটে তাদের সরিয়ে নিতে।
তার ভাতিজা আবদুর রহিমের ভাষ্য অনুযায়ী, তার আবেদনে ‘দেখছি, দেখছি’ বললেও কর্তৃপক্ষ শেষমেশ কিছুই করেনি।
হয়তো নিচের কোনও ফ্ল্যাটে থাকলে তারা বেঁচেও যেতে পারতেন, এই ভাবনাটাই এখন কুরে কুরে খাচ্ছে আবদুর রহিমকে। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে চাচাতো বোনটার বিয়ের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়াটা।
“জুলাইয়ের ২৯ তারিখ তানিমার বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল। ওর ভাল নাম হুসনা বেগম, তবে আমরা আদর করে সবাই তানিমা বলেই ডাকতাম। পড়াশুনো করত, সঙ্গে একটা মোবাইল ফোন কোম্পানিতে পার্টটাইম কাজও করত বাইশ বছরের মেয়েটা।”
“বিয়ের জন্য হল-টলও সব বুক করা হয়ে গিয়েছিল। পাত্র ছিল লেস্টারের – খুব ভাল ছেলে পেয়েছিলাম আমরা। বিয়ে নিয়ে গত কয়েকদিন তানিমার সঙ্গে আমাদের কত ঠাট্টা মশকরাও হয়েছে।”
“আগুন লাগার খবর পেয়ে সেই ছেলেও মাত্র দেড় ঘন্টার মধ্যে লেস্টার থেকে ড্রাইভ করে চলে এসেছিল লন্ডনে। বুধবার সারাদিন ধরে আমরা এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল খুঁজে বেরিয়েছি যদি তানিমাদের কোনও খবর মেলে। ছেলেটাও ভীষণ ভেঙে পড়েছে, জানেন!”
এত সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগেই এমন করুণ পরিণতির মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে গেল – এটা ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কেনসিংটনের বাসিন্দা আবদুর রহিম। আবারও চোখ ভিজে আসে তার, গলা ভারি হয়ে আসে।
বুধবার মধ্যরাতের পর ঠিক রাত ১টা ৩৭ মিনিটে চাচাতো বোন তানিমার ফোনেই ধড়ফড় করে ঘুম থেকে ওঠেন তিনি।
“আমাদের বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। আমরা বেরোতে পারছি না, কোন রাস্তায় যাব বুঝতে পারছি না। আপনে জলদি আসেন”, মেয়েটা ভয়ার্ত গলায় বলেছিল তাকে।
“আমি যখন গ্রেনফেল টাওয়ারের দিকে ড্রাইভ করছি, তখনও ব্লু-টুথ দিয়ে ফোনে ওকে বলছিলাম সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামো তোমরা। তানিমা খালি তখন বলল ধোঁয়ায় সব অন্ধকার – কিছুই ওরা দেখতে পাচ্ছে না!”
আবদুর রহিম ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি চালিয়ে সেখানে গিয়েও চাচার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেননি। অসহায়ভাবে তাঁকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে আগুন কীভাবে গ্রাস করে নিয়েছে ওই মানুষগুলোকে।
রাগে-দু:খে তার মনে হচ্ছে, দমকল বিভাগও হয়তো টাওয়ারের ওপরতলার বাসিন্দাদের বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট তৎপরতা দেখায়নি।
“হেলিকপ্টার থেকে ওরা ভিডিও তুলতে পারল, আর উপরের তলাগুলোয় পানি ছুঁড়তে পারল না? আসলে আমার ধারণা ওই টাওয়ারের ৮৫ শতাংশ বাসিন্দাই মুসলিম, তাই উদ্ধার অভিযানেও বর্ণবাদ করা হয়েছে!” – শোকে আর ক্ষোভে বিবিসিকে না-বলে পারেন না তিনি।
আর এই প্রবল শোকের মধ্যেও আবদুর রহিমের চোখে বারবার ভেসে উঠছে আদরের বোন তানিমার মুখটা – মাত্র দেড় মাস বাদেই যাকে কনের সাজে দেখার জন্য তারা সবাই অপেক্ষা করে ছিলেন।
।আগুন যখন ওই ভবনটিকে গ্রাস করে তখন এর ২০তম তলায় অবস্থান করছিল ১২ বছরের বালিকা জেসিকা উরবানো। শেষ যখন সে তার মাকে ফোন করেছিল তখন সে বলেছে, অন্য অনেকের সঙ্গে ভবনটির সিঁড়িতে আটকে আছে। কিন্তু এখন আর তার কোনো সন্ধান মিলছে না। এক নিকট আত্মীয় আনা ওসপিনা তার একটি চবি পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। তাতে তিনি লিখেছেন, আমার ভাতিজিকে এখনও খুঁজে পাইনি। দয়া করে এই ছবিটি শেয়ার করুন। কেউ কেউ বলেছেন তাকে পাওয়া গেছে। কিন্তু এখনও আমি তার কোনো খবর নিশ্চিতভাবে পাচ্ছি না। মোহাম্মদ নেদা’র স্ত্রী ও সন্তানকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তার কোনো হদিস নেই। সর্বশেষ তাকে দেখা গিয়েছিল গ্রেনফেল টাওয়ারের একদম উপরের তলায় অন্যদের সহায়তা করতে। ৬৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ নেদা ও তার পরিবার বসবাস করতেন ওই ভবনের ২০তম তলায়। তার কোনো খবর না পেয়ে বন্ধুরা এখন সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ার সহায়তা নিচ্ছেন। ফেসবুকে পারিবারিক বন্ধু আরিয়ানা নিউম্যান রজার লিখেছেন, আমরা এমন একটা পরিবারকে জানি যারা ওই অগ্নিকাণ্ডের শিকারে পড়েছিলেন। পরিবারটিকে বলা হতো নেদা’জ। আফগান বংশোদ্ভূত অত্যন্ত চমৎকার বৃটিশ পরিবার ইট। আমাদের সঙ্গে তারা দীর্ঘদিন কাজ করতেন। তার ২২ বছর বয়সী ছেলে ফরহাদকে চেলসিতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। স্ত্রী ফ্লোরা শাকিলা রয়েছেন কিংস কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। আর মোহাম্মদ নেদা নিখোঁজ। তার ভাতিজা জিয়া পোপাল ফেসবুকে লিখেছেন, গ্রেনফেল টাওয়ারে আগুন লাগার পর আমার চাচা মোহাম্মদ নেদা নিখোঁজ। তিনি ভবনটির উপরের তলায় লোকজনকে সহায়তা করছিলেন। আমরা বড় ৫টি হাসপাতালে তার খোঁজ করেছি। কিন্তু তাকে পাই নি। ভবনটির ১৯ তলায় বসবাস করতেন মরিয়ম এলঘাহরি। তাকেও খুঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনার রাত আড়াইটার দিকে তিনি সর্বশেষ কথা বলেছেন বান্ধবী ইভান্সের সঙ্গে। তখন তিনি জানিয়েছিলেন নিরাপদে আছেন। কিন্তু তারপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। নিখোঁজ রয়েছেন ২২ বছর বয়সী হামিদ আলী জাফরি। মা ও বোনের সঙ্গে কথা বলার পর তার কাছ থেকে আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় নি। ২০তম তলায় বসবাস করতেন চিত্রশিল্পী খাদিজা (২৪)। এখন ভেনিস বেইনালিতে প্রদর্শিত হচ্ছে তার চিত্রকর্ম। কিন্তু তিনি নেই। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। তার সন্ধান পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ায় পোস্ট দিয়েছেন লেবার দলের এমপি ডেভিড ল্যামি। নিখোঁজ রয়েছেন মোহাম্মদ আবদুল হামিদ। তিনি বসবাস করতেন ১৭তম তলায়।
প্রাণ বাঁচাতে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হয় শিশুদের
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আগুন লাগার পর প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই জানালা দিয়ে নীচে লাফিয়ে পড়েছেন। এমনকি শিশু সন্তানকেও নিরাপদে রাখার জন্য জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
সামিরা লামরানি নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, অনেকের মতো এক নারীও তার শিশু সন্তানকে বাঁচাতে ‘নয় বা দশ তলা থেকে’ ছুঁড়ে ফেলেছিলেন।
“সে সময় নীচেও ভিড় জমেছিল, এক নারী জানালা থেকে চিৎকার করছিল যে সে তার সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলবে। কেউ যেন শিশুটিকে নীচে থেকে ধরে সেই আহ্বানও জানাচ্ছিল ওই নারী”।
“নীচের ভিড় থেকেই একজন দৌড়ে গেল এবং জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেলা শিশুটিকে ধরতে সক্ষম হলো ওই ব্যক্তি”-বলছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী সামিরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ভবনটির অনেক বাসিন্দা জানালায় দাড়িয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল।
“তাদের আশ্বস্ত করছিলাম যে যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করছি আমরা, ৯৯৯ -এ কল করেছি। কিন্তু তাদের চোখেমুখে আতঙ্ক আর মৃত্যুর ভয়তো ছিলোই”- বলছিলেন সামিরার মা মিস লামরানি।
একজনকে ঘরে তৈরি প্যারাসুট নিয়ে ভবনের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তেও দেখেছেন মিস লামরানি।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা তামারা জানান, তিনিও দেখেছেন এক নারী তার শিশুকে জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেলেছে।
“খুব সম্ভবত পাঁচ বা ছয়তলা থেকে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। শিশুটি হয়তো বেঁচে গেছে। আমরা দেখেছি মানুষ কিভাবে উড়ে উড়ে পড়ছিল জানালা দিয়ে’-বলছিলেন তামারা।
যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের ক’জনঃ
জেসিকা উরবানো রামিরেজ
আগুন লাগার পর ১২ বছর বয়সী জেসিকা পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।তাঁর খালা আনা ওসপিনা বলছেন জেসিকার খোঁজ তারা এখনো পাননি। তারা এখনো হাসপাতালে খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বজনদের ধারণা, জেসিকাকে হয়তো চিকিৎসার জন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।অভিনেতা নোয়েল ক্লার্ক যিনি ওই এলাকায় বেড়ে উঠেছেন, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় আহ্বান জানিয়েছেন জেসিকার কোনো খোঁজ পেলে তা যেন তৎক্ষণাৎ জানানো হয়।
এখনো নিখোঁজ
মোহামেদনুর ‘মো’ টুকু
মো টুকু,এরিত্রিয়ার বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। স্ত্রী ও তিন বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন গ্রেনফেল টাওয়ারে, সেখানে তার বন্ধু বা পরিবারের কারো বাসায় এসেছিলেন। ইফতারের দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন সেখানে।রেড পিআর কনসালটেন্সি নামের এক প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করতেন মি: টুকু, তার সহকর্মী জানিয়েছেন কোম্পানিতে তাঁর অবদানের জন্য একটি অ্যাওয়ার্ড পেতে যাচ্ছিলেন মি: টুকু।
খাদিজা সায়ে ও ম্যারি ম্যান্ডি
২৪ বছর বয়সী চিত্রশিল্পী খাদিজা সায়ে গ্রেনফেল টাওয়ারের ২০ তলার বাসিন্দা ছিলেন।বিবিসির একটি ডকুমেন্টারিও তৈরি করেছিলেন খাদিজা। তিনি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। লেবার পার্টির এমপি ডেভিড ল্যামির স্ত্রী-এর প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন খাদিজা। সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা নিখোঁজদের বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন, তথ্য নিচ্ছেন বা দিচ্ছেন তাদেরএকজন ডেভিড ল্যামি, তিনি খাদিজার বিষয়ে জানার চেষ্টা করছেন।টুইটারে তিনি লিখেছেন “কেউ যদি খাদিজার বিষয়ে কোনো খবর পান দয়া করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সে আমাদের ভালো বন্ধু, খাদিজা একজন দারুণ আর্টিস্ট ও চমৎকার হৃদয়ের মানুষ”।
সায়ে
টনি ডাইসন
৬৬ বছর বয়সী টনি ডাইসন একসময় লরি ড্রাইভার ছিলেন। তার পরিবার বিবিসিকে জানিয়েছে, গ্রেনফেল টাওয়ারের ২২ তলায় থাকতেন টনি ডাইসন। মি: ডাইসন ওই ভবনে আট বছর ধরে বাস করছেন। রাত সাড়ে তিনটার দিকে তাঁর ছেলেকে ফোন দিয়ে আগুন লাগার খবর জানিয়েছিলেন মি: টাইসনএবং তিনি এও বলেছিলেন যে তাঁকে তাঁর ফ্লাটে থাকতে বলা হয়েছিল। টনি ডাইসনের তিন ছেলে ও চার নাতি-নাতনি। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন হাসপাতালে মি: ডাইসনের খোঁজ করছেন।
মারিয়াম এলগাভরি
মারিয়াম এলগাভরি, বয়স ২৭। মার্কেটিং ম্যানেজার মারিয়ামের সাথে স্বজনদের শেষ কথা হয়েছে স্থানীয় সময় রাত আড়াইটায়। তাঁর বন্ধু সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করে বলেছেন “আমাদের নিখোঁজ বন্ধু সম্পর্কে কিছু জানলে প্লীজ জানান। সে ওই ভবনের ১৯ তলায় থাকতো”।
আলী বাবর জাফরি
তাঁর বয়স ৮২ বছর। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে থাকতেন গ্রেনফেল টাওয়ারের ১১ তলায়।তাঁর ছেলে হামিদ জানান , তাঁর বাবার হার্টের সমস্যা আছে ও হাঁটতেও সমস্যা হয়। তাদেরই আরেক বোন সেদিন গ্রেনফেল টাওয়ারে গিয়েছিল বাবা-মাকে দেখার জন্য। যখন আগুন লাগে তখন বাবাকে নিয়ে তার মেয়ে লিফটে উঠে। কিন্তু ১০ তলাতেই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই সময় থেকে মি:আলীর সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।আলী বাবর জাফরি ১৬ বছর ধরে ওই ভবনে বাস করছেন। তাঁর ছয় ছেলেমেয়ে ও নাতিনাতনির সংখ্যা সাতজন।