কাতালোনিয়া কেন স্পেন থেকে বেরিয়ে যেতে চায়
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ কাতালোনিয়ার পার্লামেন্টে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পরে মাদ্রিদের পক্ষ থেকে আঞ্চলিক সরকারকে বরখাস্ত করার একদিন পর স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, তারা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে যাচ্ছে।
মাদ্রিদ সরকার ইতোমধ্যেই কাতালোনিয়ার স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নিয়ে সেখানে প্রত্যক্ষ শাসন জারি করার কথা ঘোষণা করেছে।
স্পেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী এখন কাতালোনিয়ার ক্ষমতা নিয়েছেন। কাতালান পুলিশ বাহিনির প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে, পার্লামেন্টকেও ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং আগামী ডিসেম্বর মাসে নতুন নির্বাচনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
স্পেনের সরকারি কৌশুলিরা এখন কাতালান নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পাশাপাশি স্পেনের ঐক্যের পক্ষে আজ মাদ্রিদে বড় আকারের সমাবেশ হওয়ারও কথা রয়েছে। তবে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বলছেন, এরকম কোন সমাবেশ আয়োজনের পরিকল্পনা তাদের এখনও নেই।
কাতালোনিয়ার স্বঘোষিত এই স্বাধীনতার ঘোষণাকে কোন দেশও এখন পর্যন্ত সমর্থন করেনি।
কাতালোনিয়ার পরিচয়
কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা ৭৫ লাখ। সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যার সমান। স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ এই কাতালোনিয়ায়। স্পেনের উত্তর-পূর্বের এই প্রদেশটির রাজধানী বার্সেলোনা। তাদের আছে নিজস্ব ভাষাও। বার্সেলোনা বিশ্বের অত্যন্ত জনপ্রিয় শহরগুলোর একটি, ফুটবল এবং একই সাথে পর্যটনের কারণে।
স্পেনের মোট জিডিপির এক পঞ্চমাংশ আসে এই বার্সেলোনা থেকে।
কিভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো?
কাতালোনিয়া স্পেনের অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। এর লিখিত ইতিহাস এক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের আগে এই অঞ্চলের ছিলো বড়ো রকমের স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসনের সময় কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসনকে নানা ভাবে খর্ব করা হয়।
কিন্তু ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর সেখানকার জাতীয়তাবাদ আবার শক্তিশালী হতে শুরু করে। এবং তীব্র আন্দোলন ও দাবির মুখে ওই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর সেটা করা হয় ১৯৭৮ সালের সংবিধানের আওতায়।
স্পেনের সংসদে ২০০৬ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয় যেখানে কাতালোনিয়াকে আরো কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়। কাতালেনিয়াকে উল্লেখ করা হয় একটি ‘জাতি’ হিসেবে।
কিন্তু সংবিধানে কাতালোনিয়াকে দেওয়া এরকম অনেক ক্ষমতা পরে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত বাতিল করে দেয় যা কাতালোনিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
স্বায়ত্তশাসন কাটছাঁট করার ফলে ক্ষুব্ধ হয় কাতালানরা, এর সাথে যুক্ত হয় বছরের পর বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক মন্দা, সরকারি খরচ কমানো। এই পরিস্থিতিতে তারা ২০১৪ সালে অনানুষ্ঠানিক-ভাবে স্বাধীনতার প্রশ্নে একটি গণভোটের আয়োজন করে।
তখন ভোটার ছিলো ৫৪ লাখ। ভোটে অংশ নেয় ২০ লাখেরও বেশি ভোটার। এবং কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন যে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোটার স্পেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় দেন। অর্থাৎ জনরায় ছিলো- কাতালোনিয়া চায় স্বাধীনতা। কিন্তু সেটা ছিলো অনানুষ্ঠানিক এক গণভোট।
বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ২০১৫ সালে কাতালোনিয়ার নির্বাচনে জয়লাভ করে। তখন তারা এমন একটি গণভোট আয়োজনের কথা বলে যার আইনি বৈধতা থাকবে এবং সেটা মানতে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হবে।
স্পেনের সংবিধানকে লঙ্ঘন করেই তারা এই ঘোষণা দেয়। কারণ সংবিধানে বলা আছে, স্পেনকে ভাগ করা যাবে না।
তাহলে সমস্যা কোথায়?
কাতালান পার্লামেন্টে গণভোটের প্রসঙ্গে একটি আইন তৈরি করা হয় এবছরের সেপ্টেম্বর মাসে। সেখানে রাখা হয় মাত্র একটি প্রশ্ন: আপনারা কি চান কাতালোনিয়া প্রজাতন্ত্রের কাঠামোয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে উঠুক?
আর সেখানে দুটো ভোট দেওয়া উপায় রাখা হয়: হ্যাঁ অথবা না।
বিতর্কিত এই আইনটিতে ভোটের ফলাফলকে মানতে বাধ্যতামূলক করা হয় এবং বলা হয় কাতালোনিয়ার নির্বাচন কমিশন গণভোটের ফলাফল করার দু’দিনের মধ্যে পার্লামেন্টে কাতালোনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও মাদ্রিদের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে অনুষ্ঠিত গণভোটের রায় ছিলো স্বাধীনতার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত কাতালান পার্লামেন্টেও স্বাধীনতার ঘোষণার পক্ষে ভোট পড়ে। পক্ষে ৭০টি আর বিপক্ষে ১০টি।
এর কিছুক্ষণ পর মাদ্রিদে সেনেট কাতালোনিয়ায় সরাসরি শাসন জারির পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এবং তার পরপরই প্রধানমন্ত্রী রাহয় কাতালান সরকারও প্রেসিডেন্ট এবং পুলিশ বাহিনীর প্রধানকে বরখাস্ত করেন।
এর আগে কাতালান প্রেসিডেন্ট পুজডেমন ঘোষণা করেছিলেন, অন্য কোন আদালত বা রাজনৈতিক শক্তি তার সরকারকে ক্ষমতা থেকে বরখাস্ত করতে পারবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাহয় বলেন, “কাতালোনিয়ায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্যে সেখানে প্রত্যক্ষ শাসন জারি করা জরুরী হয়ে পড়েছে।”
গণভোটের ব্যাপারে মাদ্রিদের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো?
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় এই ভোটকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে। বলেছিলেন, “আমি অত্যন্ত নরম সুরো কিন্তু কঠোর করে বলতে চাই কোন গণভোট হবে না। এটা হবে না।”
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত কাতালোনিয়ার ওই আইনটিকে বাতিল করে দেয়। এতে কাতালানরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এবং তারপর থেকেই স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার কাতালোনিয়ার অর্থনীতি ও পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে।
কাতালানরা কি আসলেই স্বাধীনতা চায়?
স্বাধীনতার পক্ষের সমর্থকরা স্পেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দাবিতে সম্প্রতি বড়ো আকারের সমাবেশ করেছে। ১১ই সেপ্টেম্বরে জাতীয় দিবস উপলক্ষে জড়ো হয়েছিলো ১০ লাখেরও বেশি মানুষ।
কাতালান সরকারের উদ্যোগে চালানো এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৪১ শতাংশ স্বাধীনতার পক্ষে, আর বাকি ৪৯ শতাংশ স্বাধীনতা চায় না।
ধারণা করা হয়েছিলো স্বাধীনতার সমর্থনে গত কয়েক বছরে হয়তো ভাটা পড়েছে। কিন্তু স্পেন সরকার যেভাবে দমন পীড়ন চালিয়ে গণভোট বন্ধ করেত চেয়েছিলো তাতে অনেকেই হয়তো স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকেও পড়েছেন, তবে আসল চিত্রটা যে কি বলা কঠিন।