রাস্তার যে কুকুর মানুষের আগেই মহাশূন্যে গিয়েছিল
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃপৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম পরিভ্রমণ করেছিল কোনো মানুষ নয়, বরঞ্চ রাশিয়ার একটি বেওয়ারিশ মাদি কুকুর।
১৯৫৭ সালে নভেম্বরে লাইকা নামে কুকুরটিকে মহাশূন্যে পাঠানো হয়। চারবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার পর কুকুরটি মারা যায়।
রুশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ভিক্টর ইয়াযদভস্কির বয়স যখন ৯ বছর, তখন তার বিজ্ঞানী বাবা একবার লাইকাকে গবেষণাগার থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। লাইকাকে নিয়ে প্রফেসর ইয়াযদভস্কি স্মৃতিচারণ করেছেন বিবিসির ওলগা স্মিরনোভার কাছে।
“খুবই শান্ত স্বভাবের কুকুর ছিল লাইকা ।আদুরে চেহারার ছিল। তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়াও সহজ ছিল। তার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সবই খুব মুগ্ধ ছিল। তার চোখের রঙ ছিল কালো। তার চোখ যেন কথা বলতো।”
১৯৫৭ সালে প্রফেসর ভিক্টর ইয়াযদভস্কির বয়স ছিল ৯। তার বাবা ভ্লাদিমির ইয়াযদভস্কি ছিলেন একজন চিকিৎসক। সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচির মেডিকেল ইউনিটের প্রধান ছিলেন তিনি।
“সবাই লাইকাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। সেসময় কেই জানতো না জীবিত অবস্থায় কেই মহাকাশ থেকে ফিরতে পারবে কিনা।”
সবাই ধরে নিয়েছিল – লাইকা আর জীবিত ফিরবে না। ফলে ফ্লাইটে তোলার আগে প্রফেসর ইয়াযদভস্কির বাবা লাইকাকে অনেক আদর যত্ন করেছিলেন।
“আমার বাবা লাইকাকে আমার দাদির বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মস্কোর কাছেই ছিল আমার দাদির বাড়ি। সেসময় আমি এবং আমার বোন লাইকার সাথে খেলেছিলাম। আমার বাবা মনে করেছিলেন, ফ্লাইটে তোলার আগে বাড়ির পরিবেশ লাইকার জন্য দরকার ছিল।”
মহাকাশে কুকুর কেন, বাঁদর কেন নয়?
মহাকাশে কুকুর পাঠানোর কথা ১৯৪৮ সাল থেকেই সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন। এবং গবেষণাগারের এই সব কুকুরগুলোর সাথে প্রফেসর ভ্লাদিমির ইয়যদভস্কির ছেলে মেয়েরা মাঝে মধ্যেই খেলাধুলো করার সুযোগ পেত। লাইকা ছিল সেই কুকুর দঙ্গলের একটি।
আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমে সেসময় লাইকাকে সাইবেরিয়ান হাস্কি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। কিন্তু লাইকা হাস্কি জাতের কুকুর ছিলনা। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা তখন তাদের কাজের জন্য খুব সচেতনভাবে সাধারণ বেওয়ারিশ কুকুরকে বেছে নিয়েছিলেন ।
“তারা মহাকাশ গবেষণার জন্য খুব ভালো কোনো জাতের কুকুরের বদলে সাধারণ বেওয়ারিশ কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার নীতি অনুসরণ করছিলেন। এসব কুকুরের কোনা ঠিকানা ছিলনা, মনিব ছিলনা। কেন তাদেরকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিলে? কারণ, রাস্তায় বেওয়ারিশ হিসাবে টিকে থাকতে হতো বলে তাদের বেঁচে থাকার ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। এবং ঐ কুকুরগুলোর চাহিদা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। ফলে তাদেরকেই গবেষকরা অধিকতর উপযুক্ত মনে করতেন।”
কিন্তু এই মহাকাশ কর্মসূচির জন্য সব বেওয়ারিশ কুকুরকেই যে উপযুক্ত মনে করা হতো, তা নয়। যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি ছিল কুকুরটির ওজন। ছয় থেকে সাত কিলোগ্রামের বেশি ওজন হতে পারবে না। তাদের শরীরের রং হতে হবে সাদা, কারণ স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরায় সবসময় তাদের ছবি তোলার প্রয়োজন ছিল, এবং রং সাদা হলে ছবি তোলা সহজ।
কিন্তু আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মতো সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা কেন বাঁদরের বদলে কুকুর ব্যবহার করে কেন এই পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? যদি বাঁদর মানব প্রজাতির খুব কাছের একটি প্রাণী।
“বাঁদরকে রকেটে চড়িয়ে যখনই মহাশূন্যে পাঠানো চেষ্টা হয়েছে, বার বার তা ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কোনো বাঁদর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। বাঁদরদের যদি চেতনা-নাশক প্রয়োগ করে পাঠানো হতো, তাহলে যে তথ্য পাওয়া যেত, তা অসম্পূর্ণ থাকতো। আরো ছোটো প্রাণী যেমন ইঁদুর যদি পাঠানো হতো, তাহলে আপনি কি করে নিশ্চিত হবেন যে মানুষ মহাশূন্যে পাঠালে তার পরিণতি কি হতে পারে। আমেরিকানরা তো মাছিও পাঠিয়েছিল মহাশূন্যে।”
মহাশূন্যে কুকুর পাঠানোর পেছনে আরো একটি কারণ ছিল সোভিয়েতদের। রুশ বিজ্ঞানী পাবলভ কুকুর নিয়ে তার আগে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন।
“কুকুরের শরীরতত্ত্ব সম্পর্কে রুশ বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই অনেক কিছু জানতেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী পাবলভ কুকুরের হজম শক্তি থেকে শুরু করে তাদের স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন। তিনি এর জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।”
কীভাবে তৈরি করা হয়েছিল লাইকাকে
ফ্লাইটের আগে লাইকার শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল । ফ্লাইটের সময় তার রক্তচাপ এবং হৃদযন্ত্রের গতির ওপর নজর রাখার জন্য লাইকার প্রধান ধমনী তার চামড়ার কাছাকাছি তুলে আনা হয়। তারপর তার ধমনীর সাথে একটি ট্রান্সমিটার বসানো হয়। তার পাঁজর এবং কাঁধের সাথেও ট্রান্সমিটার এঁটে দেওয়া হয়। এতে লাইকার শ্বাস-প্রশ্বাস এবং তার আচরণের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা হয়ে যায়।
কিভাবে একটি কুকুরকে মহাকাশযানে খাবার পানি বা অন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল?
“লাইকার সাথে সাত দিনের খাবার দিয়ে দেয়া হয়। তার জন্য বিজ্ঞানীরা বিশেষ ধরনের খাবার উদ্ভাবন করেন। কীভাবে পানির ব্যবস্থা হবে তা নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করতে হয়েছিল, কারণ ওজন-বিহীন পরিবেশে পানি তো ভাসবে। ফলে বিজ্ঞানীরা তৃষ্ণা মেটাতে পানির পরিবর্তে একধরণের জেল তৈরি করেন। খাবার হিসাবে মাংস পিষে, পানি মিশিয়ে বিশেষ একধরণের খাবার তৈরি করা হয়। তারপর সেই খাবার একটি বিশেষ ধরণের টিউবের মধ্যে ভরা হয়।”
তারপর ফ্লাইটের সময় কি হয়েছিলো লাইকার?
“পৃথিবীর কক্ষপথে চারবার প্রদক্ষিণ করা পর্যন্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। ১০ ঘণ্টা পর সমস্যা শুরু হয়। প্রচণ্ড তাপে লাইকা মারা যায়। কারণ মহাকাশ যানের ভেতর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথেষ্ট নিরাপদ করা সম্ভব হয়নি।”
সুতরাং মহাকাশে লাইকা কার্যত গরমে সেদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল?
“আমি সেরকম তুলনা করবো না। আমি বলবো লাইকা অতিরিক্ত গরমে মারা যায়। সে তো একটি রক্ত মাংসের প্রাণী ছিল। শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ওঠার পর সে তা সহ্য করতে পারেনি।
১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাস ছিল রুশ বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী । সেদিনটিকেই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ একটি বড় ঘোষণার জন্য বেছে নেন। ফলে তার আগেই মহাকাশে জীবন্ত প্রাণী পাঠানোর জন্য চেষ্টা হচ্ছিলো। ফলে ফ্লাইটের প্রস্তুতির সময় যথেষ্ট সময় নিয়ে ঠিকঠাক-মত সবকিছু বিবেচনা করা হয়নি।
“মাহাকাশ গবেষণায় আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আমেরিকা। আমরা কি করছি, সবসময় তারা নজর রাখতো। এই কর্মসূচির সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতারও সম্পর্ক ছিলো। ছিল মর্যাদার লড়াই। তখন সোভিয়েত নেতা ছিলেন ক্রুশ্চেভ। তিনি আমেরিকানদের দেখাতে চাইছিলেন কে শ্রেষ্ঠ।”
রাস্তার কুকুরের সেলেব্রিটি মর্যাদা
সুতরাং মহাকাশ নিয়ে দুই পরাশক্তির লড়াইয়ের বলি হতে হয়েছিলো বেওয়ারিশ এক কুকুরকে। তবে মহাকাশে তার করুণ মৃত্যুর পর সে সোভিয়েত সেলেব্রিটিতে পরিণত হয়েছিল।
মহাকাশে ঐতিহাসিক ঐ ফ্লাইটের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের লাইকা ব্রান্ডের গিসারেট এবং দিয়াশলাই বেরিয়েছিল। বিশেষ ডাকটিকেট এবং খাম ছাড়া হয়েছিলো যেগুলোর ওপর লাইকার মুখের ছবি ছিলো। ২০০৮ সালে মস্কোতে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়। সৌধটি দুই মিটার উঁচু । নীচের দিকটি ছিল রকেটের মত দেখতে যেটি উপরের দিকে একটি হাতের তালুর চেহারা নিয়েছে, এবং ঐ তালুর ওপর দাড়িয়ে আছে একটি কুকুর। লাইকা প্রমাণ করেছিলো মহাশূন্যে ওজনহীন পরিবেশে একটি প্রাণী টিকে থাকতে পারে।
লাইকার পরও আমার বাবা স্পুটনিকে করে মহাশূন্যে কুকুর পাঠানোর কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। যেমন ১৯৬০ সালের অগাস্টে বেলকা এবং স্ত্রেলকা নামে দুই কুকুরকে মহাশূন্যে পাঠানো হয়েছিল। এবং তারা জীবন নিয়েই পৃথিবীতে ফিরে আসে। এবং তার পরে আস্থা তৈরি হয় যে কুকুর যদি বেঁচে ফিরে আসতে পারে, মানুষও পারবে।
এরপরই ইউরি গ্যাগারিন ঐ একই মহাকাশ যানে চড়ে মহাকাশে গিয়েছিলেন। সেটা সম্ভব হয়েছিল লাইকা নামের একটি কুকুরের বীরত্বের কারণে।
প্রফেসর ভিক্টর ইয়াযদভস্কি এখন মস্কোতে একজন চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেন।-সুত্রঃ বিবিসি বাংলা