ভাস্কো দাগামার দেশে ; তাগুস নদীর তীরে
মোঃ মখলিছুর রহমানঃ
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন : قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلُ كَانَ أَكْثَرُهُم مُّشْرِكِينَ “বলুন, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পুর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছে। তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক।”
অর্থাৎ আল্লাহ পৃথীবি ভ্রমণের কথা বলেছেন . এই পৃথিবীটা কত বড় আজকাল সহজেই অনুমান করা যায় , সঠিক মাপ পাওয়া যায় কিন্তু আজ থেকে ৫০০ বছর আগে তা খুবই কঠিন ছিল । কলম্বাস বা ভাস্কো দাগামারা কেমনে বুঝলেন ঐ দূরে আরেকটি দেশ আছে । ইউরোপ থেকে ইন্ডিয়ার দূরত্ব প্রায় ৭০০০ মাইল এবং আমেরিকার দূরত্ব প্রায় ৫০০০ মাইল ।সেই সময়ে কোন গাড়ি , ট্রেন , জাহাজ , প্লেইন ছিলনা ।ওপারের খবর জানার জন্য রেডিও , টিভি ছিলনা তারপর ও এই পরিব্রাজকরা পাড়ি দিয়েছেন হাজার হাজার মাইল শুধু আবিষ্কারের নেশায় ।
জ্ঞানের উৎস হলেন আল্লাহ । ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন ।আল্লাহ কোরআনে বলেছেন – “শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।” (৯৬:৫ ) . যদি কোরআনে আদম আঃ এর কথা না থাকত তাহলে আমরা কেমনে জানতাম আদম আঃ কে ছিলেন বা উনাকে কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে ।রাসূলের সঃ এর বাড়ি মরুর দেশে অথচ পবিত্র কুরআনে নদীর কথা , সাগরের কথা , জাহাজ চালানো সবই আল্লাহ বলেছেন ।আমার মনে হয় এই ভাস্ক দাগামারা কোরআন থেকেই এই জ্ঞানলাভ করেছে যে ওদিকে গেলে অন্য দেশ পাব ।
৬১০ ক্রিস্টাব্দে রাসূল সঃ নবুয়ত প্রাপ্ত হন . ৭০০ ক্রিস্টাব্দের দিকে মুসলমানরা স্পেন দখল করে নেয় । আমার নিজের ও জানা ছিলোনা যে পর্তুগালের অধিকাংশ এলাকা ওই সময় মুসলমানের দখলে ছিল । প্রায় ৫০০ বছর মুসলমানরা এই অঞ্চলে ছিল কিন্তু দুঃখজনক হল মুসলমানরা এই দেশে টিকে থাকতে পারেনাই । ইন্ডিয়াতে ও মুছলমানরা শত শত বছর ছিল কিন্তু আজ ইন্ডিয়া একটি হিন্দু রাষ্ট ।আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেই দিয়েছেন যদি তুমরা আমার কাজ না কর বা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে আমি অন্য জাতি দিয়ে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করব ।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ “যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মত হবে না।”
পর্তুগাল যে মুসলমানের অধীনে ছিল বা এখানে যে মুসলমান ছিল তার প্রমান এখানে আসলেই আপনি দেখতে পারবেন . পর্তুগালের বিখ্যাত শহর আল গারব যা মুসলমানের নামেই . শত শত স্থাপনা বা রাস্তার নাম আল দিয়ে শুরু যা এরাবিক ইংরেজিতে The এর পতিবর্তে ব্যাবহৃত হয় . ওদের ভাষায় অক্সালা যা আরবিতে আমরা বলি ইনশাআল্লাহ . পর্তুগালের রাজধানী লিসবন যা আল ইসবুন থেকে নেওয়া হয়েছে . লিজবনে বিখ্যাত একটি গির্জা আছে যা আগে মসজিদ ছিল , মসজিদের ভিতরের কারুকাজ বলে দেয় তা একদিন মুসলমানের ছিল ।
পর্তুগাল দক্ষিণ পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশ ।মোট আয়তন ৩৫ হাজার স্কয়ার মাইল , টোটাল জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটির উপরে । রাজধানী লিসবন ।পর্তুগালের দুই দিকে স্পেন ও দুইদিকে আটলান্টিক মহাসাগর ।সাগর পারের দেশ হিসাবে মাছই তাদের প্রধান খাদ্য ।আমাদের মত মিটাপানির মাছ নেই । সামুদ্রিক মাছ সার্ডিন ও কডই তাদের প্রধান খাদ্য ।
লিসবন পৃথিবীর আদি শহরের একটি , ইউরোপের ও অন্যতম পুরাতন শহর । তাগুস নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরের বর্তমান জনসংখ্যা ৫ লক্ষের উপরে । শহরের অবকাঠামো দেখলেই অনুমান করা যায় যে ওরা অনেক আগে থেকেই উন্নত ছিল .৭১১ ক্রিস্টাব্দে এই লিজবন মুসলমানের অধীনে চলেযায় । চারশত বছর পর ক্রিস্টানরা আবার দখল করে নেয় , মুসলমানদর সব স্থাপনা বা মসজিদ ধ্বংস করে ফেলে ।
একটি জাতি যখন কোথাও যায় সাথে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে যায় ।পর্তুগিজরা ইন্ডিয়ার গোয়াতে ছিল তাইত গোয়ার বেশিরভাগ মানুষ ক্রিস্টান । পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের কলোনি ছিল ।আফ্রিকার ৬ টি দেশের ভাষা এখনও পর্তুগিজ . আমরা আস্তে আস্তে ইমিগ্রেন্ট হিসাবে এখন ইউরোপের অনেক দেশে বসবাস করতেছি ।সাথে আমাদের ও সংস্কৃতি নিয়ে যাচ্ছি ।লন্ডনের অনেক এলাকা এখন মুসলমানদের দখলে আছে ।লন্ডনের অনেক রাস্তাতে বাংলায় লিখা নাম আছে .এই পর্তুগালেও এখন মসজিদ হয়েছে , বাঙালি বা হালাল পর্যাপ্ত খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে . ট্যুরিস্ট এরিয়ার অনেক শপ বাংলাদেশিদের . মুসলমানের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেছে ।
পর্তুগালের সরকার প্রধান হলেন প্রধান মন্ত্রী . আমাদের মত নির্বাচন হয় ৪ বছর পর পর . ২৩০ জন নির্বাচিত হন এসেম্বলিতে . প্রেসিডেন্ট ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন ।প্রধানতঃ দুইটি দলই বড় . সোশ্যাল পার্টি ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ।
লিসবনে ভ্রমণ করার জন্য আমার দুইটি উদ্দেশ্য কাজ করেছে . প্রথমত: আমি দেখতে চাইছিলাম ভাস্কো দাগামার দেশটি , দিত্বীয়ত আমার এলাকার অনেক একান্ত পরিচিত কয়েকজন ভাই থাকেন তাদের কে ও দেখতে চাইছিলাম ।আমার জন্য সুবিধা ছিল যে আমি আমার ঘরের কাছে লন্ডন সিটি এয়ার পোর্ট থেকে ফ্লাই করতে পেরেছিলাম যা আমার জন্য খুবই সহজ ছিল ।লন্ডন থেকে মাত্র আড়াই ঘন্টার পথ বিমানে ।
গত তিন দিন অনেকের সাথে আমার দেখা হয়েছে , পরিচয় হয়েছে . খুবই ইনজয় করেছি সবার সাথে , বিশেষ করে মইনুলের বিবাহউত্তর পার্টিতে সকলের সাথে দেখা হয়েছে । রকিব ও কামরুলের আতিথিয়তা মনে থাকবে, বিশেষ করে শাহীনের সুস্বাদু রান্না ছিল অতুলনীয় . এই সুদূর লিসবনে এসেও আমাদের কানাইঘাটের ঐতিহ্যবাহী মুলার চাটনি(করু ) খেলাম ।
ব্যাচেলর ভাইদের জীবন অনেক সংগ্রামের ,অনেক কষ্টের ।ইউরোপে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পর্তুগালই একমাত্র দেশ যেখানে এখন ও সহজে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ রয়েছে . বৈধ পথে এই দেশে ঢুকলে এখনো সহজে স্থায়ী হওয়া যায় . জীবন যাত্রারমান খুবই সহজ . আয় খুবই কম , ব্যয় ও কম . পূর্ব লন্ডনে তিন রুমের একটি ঘরের বাড়া যেখানে ১৫০০ পাউন্ড লিসবনে তা মাত্র ৪০০ ইউরো । এককাপ চা মাত্র ৫০ সেন্ট ।
বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকার নাম বেনফোরমোচ , মার্টিমোনিজ ।ছোট এরিয়াতেই দুইটি মসজিদ আছে . লন্ডনের ব্রিলেনের মত এই গলিতে অনেক গ্রছারি শপ আছে , রেস্টুরেন্ট আছে ।কানাইঘাটের কয়েকজন ভাই খুবই ভাল পজিশনে আছেন . উনাদের ভাল ব্যবসা আছে ।আস্তে আস্তে এই লিসবনে বাংলাদেশিদের অবস্থা হবে লন্ডনের মত ।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আরবদের বলেছিলেন পৃথিবী ঘুরে দেখতে কারণ কোরআন নাজিলের সময় আরবরাই শ্রুতা ছিল যাতে তারা নিজ চুখে আল্লাহর গজব দেখতে পায় ও ভয়ে আল্লাহকে মান্য করে . আল্লাহর গজবে আরব ভূখণ্ডের বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক জায়গা ধ্বংস হয়ে ছিল . আদ , সামুদ জাতির বসবাস আরব ভূখন্ডেই ছিল এবং আল্লাহর হুকুম না মানাতে আল্লাহ শাস্তি দিয়েছিলেন ।
মুসলমানরা আরব ভূখণ্ড থেকে আস্তে আস্তে প্রসারিত হয়ে আফ্রিকা হয়ে স্পেন ও পর্তুগালে পৌঁছেছিল কিন্তু নিশ্চয় কোরআন ও সুন্নার পর্যাপ্ত চর্চা না করাতে ৪০০ বছর মুসলিম অধ্যুষিত জায়গা থাকার পর ও গত ৫০০ বছর মুসলমানের কোন গন্ধ ছিলনা পর্তুগালে . আল্লাহ বলেই দিয়েছেন তিনি পরিবর্তিত করে নিবেন ।
আমরা বাংলা দেশের মানুষ যে ভাবে উদারতার নামে ,চেতনার নামে , আকাশ সংস্কৃতি প্রভাবে যে ভাবে ধর্ম থেকে বিমুখ হচ্ছি , ধর্মকে যে ভাবে ব্যাখ্যা করতেছি , ধর্ম হীনতাকে যেভাবে উৎসাহিত করতেছি, এবং একটি বিধর্মী রাষ্ট্র ধারা যে ভাবে বেষ্টিত আছি জানি না আজ থেকে ৫০০ বছর পর আমাদের এই মাতৃভূমিতে কে থাকবে এবং কোন ধর্ম নিয়ে থাকবে ।
আল্লাহ আমাদের মাতৃভূমি কে তুমি হেফাযতে রেখ ।আমাদের যখন একবার ঈমানের স্বাদ দিয়েই দিয়েছ আমাদের ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কিয়ামত পর্যন্ত ঈমানের উপর রেখো ।
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ
হে আমাদের রব! যখন তুমি আমাদের সোজা পথে চালিয়েছো তখন আর আমাদের অন্তরকে বক্রতায় আচ্ছন্ন করে দিয়ো না, তোমার দান ভাণ্ডার থেকে আমাদের জন্য রহমত দান করো কেননা তুমিই আসল দাতা।” – আমিন ।