বার্মায় মুসলিম হত্যা

Spread the love

Burma killing1নাজমিন রিয়া , বাংলাদেশ
বার্মার রোহিঙ্গা মুসলমানের কান্নায় পৃথিবীর আকাশ ভারী হয়ে উঠছে। মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুরা বাচাঁও বাচাঁও বলে আর্তচিৎকার করছে। মায়ানমারের বর্বর সরকার তাদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালাচ্ছে। হত্যা করছে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশু, যুবক, বৃদ্ধাদেরকে। ধর্ষণ করে কলঙ্কিত করছে অসংখ্য মা-বোনদের। বিধবা করছে হাজারো নারীদের। সন্তানহারা করছে অসংখ্য মাকে। স্বামীহারা করছে অসংখ্য স্ত্রীকে। ভাইহারা করছে অসংখ্য বোনকে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের আহাজারীতে পৃথিবীর আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে। বিশ্ব মুসলমানদের সহযোগীতা ও ভ্রাতৃত্বের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ও.আই.সি নিশ্চুপ। নিশ্চুপ জাতিসংঘ । কাগজে কলমে দুএকটা বিবৃতি দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না মায়ানমারের বর্বর সরকার । গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এভাবে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। নিজ দেশে থাকতে না পেরে তারা বাঁচার আশায় থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সমুদ্র পথে নৌযানে পাড়ি জমাচ্ছে। নৌযান ডুবে তারা সাগরের পানিতে ভাসছে ও ডুবে মরছে। সাগরে ভাসতে ভাসতে শুধু রোহিঙ্গা মুসলমান মরছে না, মানবতারও মৃত্যু হচ্ছে। তাদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসা সকলের মানবিক দায়িত্ব।
মুসলিম জনগণের ওপর সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, অমানবিক এবং অবৈধ, নৃশংস হত্যাকান্ডের মাধ্যমে মুসলমান শুন্য করার খেলায় মেতে উঠেছে মায়ান্মার। নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এ নৃশংস বর্বরতার নিন্দা জানানোর ভাষা অভিধানে আজ পরাজিত! রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে গোটা বিশ্বের অমুসলিম শক্তি আজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। মানবিক সংস্থাগুলো এখনও নিশ্চুপ! রোহিঙ্গা মুসলমানদের কিই বা দোষ ছিল, যার কারণে তারা আজ নির্মম-জুলুম নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে? কারণ একটাই ওরা যে মুসলমান। ধর্মীয় পার্থক্য ও বৈপরিত্যের কারণেই রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমারের সামরিক জান্তা, প্রশাসন ও বৌদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠিরা তাদের উপর সীমাহীন জুলুম চালাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠি। শত শত বছর ধরে তারা নির্যাতিত ও নিপিড়ীত হচ্ছে। নির্যাতনের চিত্রগুলো বিশ্বমিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিভৎস চেহারাগুলো দেখে কার চোঁখ না অশ্রুসিক্ত হবে? চোখের সামনে ভাই-বোন, মা-বাপ, ছেলে-মেয়েদের যদি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে, শরীরের উপর কামান তুলে মাথার মগজ বের করে ফেলে, চোঁখের সামনে তাজাদেহ দ্বিখন্ডিত করে ফেলে তখন কেমন লাগবে? বার্মার মুসলমানদের সাথে তাই করা হচ্ছে! জাতিসঙ্ঘ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিশ্বের সবচেয়ে বর্বর নির্যাতনের শিকার জনগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করেছ
বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ওরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হযেছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে যে সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওযা একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়েবলেন, আল্লহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা।তবে,ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন
muslim-killings-in-Burmaমিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণ বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে তাড়িত করবে। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিম বিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম হত্যা করে। শত শত বছর ধরে তারা মিয়ানমারে বাস করে এলেও মিয়ানমার সরকার তাদেরকে সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বলা হয় এরা বহিরাগত। ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায় এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্ব প্রথম গড়ে উঠা মুসলিম বসতি ওয়ালা প্রদেশের মধ্যে বর্তমানের আরাকান তথা রাখাইন প্রদেশ ছিল উল্লেখ যোগ্য। ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আরাকানের স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। ২০০ বছরের বেশি সময় সেটা ছিল স্থায়ী। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ পর্যন্ত আরাকান রাজ্য এক কঠিন দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আর এই দূর্ভিক্ষই আরাকান থেকে মুসলিম প্রশাসকের পতন ঘটে। ১৯৮১ সালে মিয়ানমারের সামরিক শাসনকর্তা আরাকান রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন প্রদেশ করে, এটা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, এ রাজ্য বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায়ের, রোহিঙ্গা মুসলমানদের নয়। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে ‘বসবাসকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাদের ভোটাধিকার নেই। নেই কোন সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। তারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যেখানে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু আজ সেখানে তারা সংখ্যালঘু। বড় আফসোস! আজও রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার। বার্মা বা মিয়ানমার দেশটির রাখাইন রাজ্যে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করছে এবং তাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালি অভিবাসী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করে। তাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করছে মিয়ানমার সরকার। বর্তমানে লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু শিবিরে আটক অবস্থায় রয়েছে। মায়ানমারের সামরিক জান্তা তার অধিবাসী মুসলমানদের জন্য সে দেশকে জাহান্নামের অগ্নিকুন্ডে পরিণত করেছে। তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে উপার্জিত সব সম্পদের মালিকানা, নাগরিক অধিকার, মানবিক অধিকার, এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারও। তাই তারা সমূহ বিপদের কথা জানার পরও মরিয়া হয়ে ছুটছে একটুখানি নিরাপদ ঠিকানার সন্ধানে।
সর্বহারা এসব আদম সন্তন মৃত্যুর অপেক্ষায় বেঁচে আছে।
APphoto_Myanmar Two Child Policyচলতি মাসের শুরুতে থাইল্যান্ডে মানব পাচার শিবির আর অভিবাসীদের সম্ভাব্য গণকবরের সন্ধান এবং আন্দামান সাগরে হাজার হাজার ভাসমান অভিবাসী শনাক্ত হওয়ার পর গেলো কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি। বছরের পর বছর ধরে নাগরিকত্ব না পেয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘রাষ্ট্রহীন’ অবস্থায় বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গারা। পরিচিতি ও স্বীকৃতিহীন এসব রাজ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। আর এ মিয়ানমারেরই অবিসংবাদিত নেত্রী বলে গণ্য করা হয় অং সান সুচিকে। বিশ্ব শান্তিতে অপরিসীম অবদান রাখার জন্য ১৯৯১ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। অথচ নিজ দেশে রোহিঙ্গা নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে বরাবরই মিনমিনে গলায় কথা বলে আসছেন সুচি। এর ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। সম্প্রতি যখন মানব পাচারের শিকার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সাগরে ভেসে নির্মম দিনাতিপাত করছে, তখনও নিরব সুচি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার এ ধারাবাহিক নিরবতাকে ‘অমার্জনীয় অপরাধ’ বলে উল্লেখ করেছেন আল জাজিরার উপস্থাপক ও হাফিংটন পোষ্ট ইউকের রাজনৈতিক পরিচালক মেহদি হাসান। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির রহস্যজনক নিরবতা প্রসঙ্গে লেখা এক ব্লগে এমন মন্তব্য করেছেন তিনি।
মেহদি বলেন, ‘১৯৯১ সালে সুচিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার সময় নরওয়ের নোবেল কমিটি ঘোষণা করেছিলো, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ে এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ক্লান্তিহীন সংগ্রামের জন্য মহান এ নেত্রীকে সম্মানিত করা হচ্ছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছেন অং সান সুচি।’
মেহদি বলেন, ‘শুধু নোবেল কমিটিই নয়, সুচির গুণকীর্তন করেছেন বিশ্বসেরা গুণীরাও। আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দুর্দশার করা বর্ণনা করে একবার বলেছিলেন, এ মানুষগুলোর দুর্দশা লাঘবে একজন গুনী ও ন্যায়বান নেত্রী প্রয়োজন, সেটা হতে পারে অং সান সুচি। আর গর্ডন ব্রাউন তো সুচিকে বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী বন্দীর মর্যাদা দিয়েছিলেন।
‘তবে সুচির নিজ দেশেই গত ২৪ বছর ধরে সীমাহীন নির্যাতিত, নিষ্পেষিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিরা নরওয়ের পাঁচ সদস্যের নোবেল কমিটি, গর্ডন ব্রাউন কিংবা ডেসমন্ড টুটুদের মতের বিরোধিতা করতেই পারেন।
জাতিসংঘের বরাতে মেহেদি জানান, ‘এ মুহুর্তে রোহিঙ্গারা বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যারা তাদের দুর্দশায় বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি সাগরে ভাসমান অভিবাসীদের মানবেতর জীবনের প্রসঙ্গ টেনে মেহেদি বলেন, ‘গেল সপ্তাহখানেক ধরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া-থাইল্যান্ড উপকূলে বহু চেষ্টার পর ভিড়তে সক্ষম হয়েছে, এবং আরো হাজারো রোহিঙ্গা এখনো সাগরে ভাসছে, জীবিত এবং মৃত। সাগরে কোনরকম পানি, খাবার ছাড়া শত শত রোহিঙ্গাকে ভাসতে দেখে চোখের পানি আটকাতে পারেন নি ইন্দোনেশিয়ার জেলে মোক্তার আলী। নিজ উদ্যোগে তাদেরকে গভীূর সমুদ্রে থেকে তীরে নিয়ে আসেন তিনি। এএফপিকে বলছিলেন, তাদেরকে দেখার পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। শত শত মানুষ কীভাবে মাসের পর মাস সমুদ্রে ভেসে থাকেতে পারে? তাদেরকে খুবই ক্ষুধার্ত, দুর্বল আর হাড্ডিসার লাগছিলো।

গত ২৯শে মে এশিয়ার ১৮টি দেশ, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থা ব্যাংককে একত্রিত হয়েছিল। সেখানে তারা নিজেদের ‘গভীর উদ্বেগ’ সংবলিত বিবৃতি দিয়েছে। একই সঙ্গে টাস্কফোর্স গঠন, যোগাযোগের উন্নয়ন, তথ্য ভাগাভাগি বৃদ্ধি ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। এর কয়েক দিন আগে সংকট হ্রাসে দয়াপরবশ হয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। দেশ দুটি অসহায় অভিবাসীদের নৌকা সাগরে ফেরত পাঠানো বন্ধে সম্মত হয়েছে। যাত্রীদের প্রত্যাবর্তন বা পুনর্বাসন করার আগে আশ্রয় দেয়া হবে। প্রায় ৩ হাজার অভিবাসী এখন পর্যন্ত তীরে ভিড়েছেন। তবে আরও শত শত অভিবাসী সাগরে ভেসে আছেন।
এর পরও ওই সম্মেলন থেকে উন্নতির কিছু লক্ষণ দেখা গেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি লক্ষণীয়ভাবে দ্বন্দ্ব-বিমুখী। রাজনৈতিক নেতারা একটি সম্মেলনে প্রকাশ্যে আঞ্চলিক লজ্জাজনক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন, এমন দৃশ্য বিরল। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াকে নিয়ে প্রাথমিক আলোচনায় অনুপস্থিত ছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তবে ব্যাংককে তারা নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন।
ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন এমন এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, সম্মেলনে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করা হয়েছে। এমনকি মিয়ানমারের প্রতিনিধিরাও উচ্চারণ করেছেন। বার্মিজরা রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে সম্বোধন করে। এটি মূলত সমস্যা থেকে মিয়ানমারকে দূরে রাখার একটি কৌশল। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) অভিবাসীদের কাছে যেতে দেয়া হবে বলে সম্মেলনে আশ্বস্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আইওএমকে কয়েক মিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও মিয়ানমারে মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে একই কাজ করেছে। এ ছাড়া সম্মেলনে এক যৌথ বিবৃতিতে সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এখানেই মূলত কৌশলের খেলা। ব্যাংককের সম্মেলনে মিয়ানমারের প্রতিনিধি জাতিসংঘের এক কর্মকর্তার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেছিলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রতি যে আচরণ করছে, তার ফলেই রোহিঙ্গারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সত্যিকার অর্থেই, রোহিঙ্গারা বার্মিজদের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে পালাচ্ছেন। বার্মিজরা তাদের বিভিন্ন শিবিরে বন্দিও করেছে।
ব্যাংকক সম্মেলনের এক সপ্তাহ আগে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ‘পপুলেশন কন্ট্রোল হেলথ কেয়ার’ বিলে স্বাক্ষর করেছেন। এরপর সেটি আইনে পরিণত হয়েছে। ওই আইনের ফলে, যেসব অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি, সেখানে মায়েরা তিন বছরের কম সময়ের ব্যবধানে বাচ্চা নিতে পারবেন না। এ বিষয়টি কার্যকরের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। দেশটির বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশপ্রেমীরা মুসলিমদের মধ্যে উচ্চজন্মহার নিয়ে চিন্তিত। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ওই আইনটি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হবে।
এ বিষয়টির ওপর বিশ্বের মনোযোগ সরে গেলে কি ঘটবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন অনেকে। এখন হয়তো মানব পাচারের নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হবে। কিন্তু যত দিন মানুষ বাঁচার তাগিদে পলায়নের জন্য মরিয়া হয়ে থাকবে, তত দিন ওই নেটওয়ার্কগুলো থাকবে। মিয়ানমারে নির্বাচনের মওসুম ঘনিয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের কোন রাজনীতিবিদই এখন পর্যন্ত লাভবান হননি।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কিছু রাখাইন কর্মকর্তা আট রোহিঙ্গা মহিলাকে অপহরণ, হত্যা ও ধর্ষণ করলে রোহিঙ্গারা এর প্রতিবাদ জানায়। এদের ওপরও চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর যখন আক্রমণ হয়, তখন মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনাবাহিনী দর্শক সারিতে ছিল অথবা তাদের সহায়তা জুগিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ২০১২ সালেই শত শত রোহিঙ্গা হত্যা, দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে করা হয় গৃহহীন। আর বিবিসি শিশুদের পুড়িয়ে মারার দৃশ্যও প্রকাশ করেছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দণি-পূর্ব এশীয় অঞ্চলসহ সারাবিশ্বের ঞড়ঢ় ড়ভ ঃযব রংংঁব নিজ দেশে নির্যাতিত ও পরবাসী রোহিঙ্গা মুসলিম ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি এবং ভাগ্যান্বেষণের আশায় সাগরে ভাসা কিছু বাংলাদেশীকে নিয়ে। যারা এখনো নৌকায় আন্দামান সাগর ও মালাক্কা প্রণালীতে ভাসমান দুঃসহ জীবন-যাপন করছে। যাদের সংখ্যা আট হাজারেরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে ভেসেছিল এসব বাংলাদেশী। আর মিয়ানমার সরকার ও বৌদ্ধদের নির্যাতনে সাগর পাড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ভাসমান রোহিঙ্গাদের সংখ্যাও প্রায় অর্ধেক। মিয়ানমারে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস।
জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার [টঘঐঈজ] একটি প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, জীবন বাঁচাতে গত তিন বছরে এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছে, যাদের ২০ হাজারই দেশান্তরী হয়েছে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে। ভাসমান এ অবৈধ অভিবাসী ও রোহিঙ্গাদের উপকূলে ভিড়তে দিচ্ছে না থাইল্যান্ড, মালেশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। ফলে সেখানে খুবই বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। এবিসি অনলাইন-রেডিও অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, সাগরে যাত্রাকালেই প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে আর এদের বেশির ভাগের মৃত্যু হয়েছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা এবং নির্যাতনে। এমনকি খাবার নিয়ে মারামারিতেই প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে।
গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, সাগরে অনেকে অপুষ্টিতে প্যারালাইজড হয়ে গেছে, বাকিরাও যেন একটি জীবন্ত কঙ্কাল। তারা কখনো অথৈ সমুদ্রে, কখনো রোদে পুড়া আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজছেন। খাবার নেই, পানি নেই। নিজেদের মূত্র পান করেও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন অনেকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণহত্যা স্মৃতি জাদুঘর ‘ঞযবু ধিহঃ ঁং ধষষ ঃড় মড় ধধিু বধৎষু ধিৎহরহম ংরহবং ড়ভ মবহড়ংরফব রহ ইঁৎসধ’ নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, কিভাবে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ঘৃণামূলক বক্তৃতা দেয়াসহ, শারীরিক নির্যাতন, ভয়াবহ জীবন-যাপন, ভূমি বাজেয়াফত করা, যৌন সহিংসতা, নাগরিকত্ব হারান, চাঁদাবাজি ও মানবতাবিরোধীসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়। আর জাতিসঙ্ঘ এদের ‘ভাসমান কফিন’ বলে উল্লেখ করেছে।
টহরাবৎংরঃু ড়ভ খড়হফড়হ এর ছঁববহ গধৎু ওহংঃরঃঁঃব-এর একদল গবেষক নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে গত কয়েক মাসের অবস্থা বিবেচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে, যা চৎড়ভবংংড়ৎ চধহু এৎববহ প্রকাশ করেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের সামনে দু’টি পথ আছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। (১). দেশে অবস্থান করে ধীরে ধীরে নির্মূল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা।(২). পলায়ন করে সমুদ্রে ভেসে আশ্রয় নেয়া। এই নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে জাতিসঙ্ঘ ‘ঞযব সড়ংঃ ঢ়বৎংবপঁঃবফ ঢ়বড়ঢ়ষব ড়হ ঃযব বধৎঃয’ (পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
এই রোহিঙ্গা নিধন আন্দোলনের কলকাঠি নাড়ছে বৌদ্ধদের চরমপন্থী সংগঠন ‘৯৬৯ সড়াবসবহঃ ড়ভ ইঁফফরংস। এই সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন উইরাথু নামের বৌদ্ধভিক্ষু; যিনি ২০০৩ সালে মুসলিমবিরোধী প্রচারণায় সাত বছর জেলে ছিলেন। উইরাথু নেতৃত্বাধীন সংগঠনের মূলমন্ত্র হলো ‘ইঁফফরংঃং ঃড় ভৎধঃবৎহরুব ড়হষু ধসড়হম ঃযবসংবষাবং’ অর্থাৎ ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক শুধু তাদের মধ্যেই চলবে। তারা মনে করে, তদের ধর্ম বিলুপ্ত হচ্ছে। ইসলাম ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান, চীনের উইঘুর দখল করে নিয়েছে, যা পূর্বে বৌদ্ধদের আবাসভূমি ছিল। তাদের আশঙ্কা মিয়ানমারে মুসলিমদের সংখ্যা যেহারে বেড়ে যাচ্ছে তাতে এই দেশও একদিন ইসলাম দখল করে নেবে। এরই আরেক সহযোগী সংগঠন ইড়ফঁ ইধষধ ংবহধ (ইইঝ), যারা শ্রীলঙ্কায় তৎপরতা চালাচ্ছে এবং ইসলামকে শ্রীলঙ্কা থেকে বিতাড়িত করার ব্যর্থ অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আর এসব অযৌক্তিক সংগঠনের চাপে মিয়ানমার সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘দু’সন্তান নীতি’ চালু করেছে।
নির্যাতিতরা রোহিঙ্গা কিংবা বাংলাদেশী বলেই কি এত অবহেলা! কী অদ্ভুত বিশ্বের সভ্য মানবতা! আবার কোনো কোনো দেশ শুধু বিবৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ঙওঈ রোহিঙ্গাদের এমন দুরবস্থা দেখেও না দেখার ভান করছে। অপর দিকে আরব লিগের শেখরা আমেরিকা, ইহুদিদের গোলামের মতো নিশ্চিন্তে বসে আছেন। আর সৌদি-আরব তো ইয়েমেনবাসীর ওপর আক্রমণ করার জন্য ইসলামবিদ্বেষীদের গায়ে তেল মর্দন করায় ব্যস্ত।
তাহলে কী বিরোধী শক্তি সর্বদা ষড়যন্ত্রের অট্টহাসি হেসেই যাবে আর মুসলিমরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে সারা জীবন কেঁদেই বেড়াবে?


Spread the love

Leave a Reply