এমন ভোট সিলেট আগে দেখেনি
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃসিটি নির্বাচনে এবার এমন অনেক কিছুই ঘটছে, যা সিলেটের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধরপাকড়, তল্লাশি, হুমকি-ধমকি, হামলা-মামলা এ শহরে এই প্রথম। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের ধরনেও রয়েছে নতুনত্ব। স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, জোট রাজনীতিতে এটি নতুন মেরুকরণ। সম্প্রীতির শহর সিলেটবাসীর কাছে নির্বাচন পূর্ববর্তী এ চিত্র একবারেই অচেনা। যুগযুগ ধরে লালিত ঐতিহ্যে এবার চিড় ধরেছে।
তাদের মতে, আপাত: দৃষ্টিতে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এর রেশ নির্বাচনের পরেও প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রচারণার ইতিহাস বলে, সব সময় সরকারবিরোধী পক্ষই নির্বাচন বানচালের অভিযোগ আনে। কিন্তু সিলেটে এক্ষেত্রেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদর উদ্দিন কামরান নিজেই নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনছেন। এজন্য তিনি তার প্রতিপক্ষের ওপর দায়ভার চাপাচ্ছেন। তবে নির্বাচনী মাঠের এসব নেতিবাচক কার্যক্রমের পাশাপাশি কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে এবার।
প্রথমবারেরমতো বর্ষা মৌসুমে কাদা-পানি মাড়ানো ছাড়াই নির্বিঘ্নে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রার্থীরা। ভোটাররা যানজটের ভোগান্তি থেকেও কিছুটা মুক্তি পেয়েছেন। গত নির্বাচনে প্রার্থীদের ইশতেহারে শুধু পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়েছিলো। কিন্তু এবার পরিকল্পনার পাশাপাশি সাবেক মেয়ররা অতীতে নগরীর উন্নয়নে তাদের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের কথাও তুলে ধরেছেন। ভোট ভাগাভাগিতেও নতুন মাত্রা পেয়েছে এবারের সিলেট সিটি করপোরেশ নির্বাচনে। এবারই প্রথম মেয়র পদে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৭ জন মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন, যদিও বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিম পরবর্তীতে দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
২০০১ সালের ৩১শে জুলাই সিলেট পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। এরপর থেকে এ মহানগরীর নগরপিতার আসনে বসেছেন দু’জন। একজন আওয়ামী লীগের বদর উদ্দিন কামরান, অপরজন বিএনপি’র আরিফুল হক চৌধুরী। এর মধ্যে কামরান ছিলেন ২ মেয়াদে টানা ১০ বছর। এরপর ২০১৩ সালে নগরের দায়িত্ব নেন আরিফুল হক চৌধুরী। এবার চতুর্থবারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ সিটিতে। দেশের অন্যান্য সিটির মতো এখানেও দলীয় প্রতীকে প্রথম মেয়র নির্বাচন।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ছোটখাটো দু’-একটি অভিযোগ ছাড়া পূর্বের তিনটি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ছিলো। নগরবাসী ও প্রার্থী নিজেরাও সে কথা স্বীকার করছেন। গণসংযোগে বারবার তারা উল্লেখও করছেন বিষয়টি। বলছেন, সিলেট সম্প্রীতির শহর। শান্তিপ্রিয় মানুষের বসবাস। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে মানুষ এ ঐতিহ্যকে লালন করেছে। কিন্তু এবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই সেই সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। এ অভিযোগ প্রায় প্রত্যেক প্রার্থীর। বিশেষ করে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী আওয়ামী লীগের বদর উদ্দিন কামরান ও বিএনপি’র আরিফুল হক চৌধুরী একে-অপরের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগে লিপ্ত।
প্রার্থীদের এসব অভিযোগ ছাড়াও মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সিলেটে এবার এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যা এ সিটির মানুষের কাছে একেবারেই নতুন। ইতিমধ্যে বেশকিছু ঘটনায় মানুষ বিস্মিত। প্রতিদিনই ঘটে যাওয়া এসব নেতিবাচক ঘটনায় নগরবাসী তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য হারানোর আশঙ্কা করছেন।
বুধবারও সিলেটে ককটেল হামলায় আহত হয়েছেন পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক (এসআই)। আহত এসআই রায়হান আহমদ দক্ষিণ সুরমার কদমতলী ফাঁড়িতে কর্মরত। ওইদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশীদ চত্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ফজল জানান, রাতে থানা থেকে মোটরসাইকেলযোগে কদমতলী ফাঁড়িতে যাচ্ছিলেন এসআই রায়হান। হুয়ায়ুন রশীদ চত্বর এলাকায় যাওয়ার পর একদল যুবক মিছিল সহকারে এসে তাকে লক্ষ্য করে কয়েকটি ককটেল নিক্ষেপ করে। ককটেল বিস্ফোরণে রায়হান আহত হন।
তাকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এদিকে কারা বা কোন প্রার্থীর পক্ষে মিছিল নিয়ে এসে হামলা করা হয়েছে সে বিষয়টি নিশ্চিত হতে না পারলেও বিএনপি’র ৪৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অবশ্য ঘটনার পরপরই কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলো, বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে নতুন মামলা সাজাতে এ ঘটনা। গত ২৪শে জুলাই ভোররাতে পুলিশ আটক করে বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও ঘনিষ্ঠজন জুরেজ আবদুল্লাহ গুলজারকে।
তাকে আগের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২২শে জুলাই আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী কামরানের একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায়ও অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। সোমবার ভোররাতে আরিফের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কেন্দ্রীয় বিএনপি’র ক্ষদ্র ঋণ বিষয়ক সহ-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তারে তার বাসায় অভিযান চালানো হয়। তাকে না পেয়ে তার ছেলে রুম্মান রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপি’র দাবি, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। একই রাতে সিলেট ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সাঈদ আহমদ, ছাত্রদল নেতা এনামুল হক ও জুনেল আহমদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর আগে ধানের শীষ প্রতীকের কর্মী বাদল, রাসেল, সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৯শে জুলাই এক সংবাদ সম্মেলন থেকে বের হয়ে আসার পর পুলিশ কেন্দ্রীয় বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ ও মেয়র প্রার্থী আরিফুল হকের গাড়িতে তল্লাশি করে। দুই কর্মীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২১শে জুলাইয়ে সিলেট পুলিশের উপ-কশিনার (দক্ষিণ) এর কার্যালয়ের সামনে অবস্থানের জের ধরে শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।
১৮ই জুলাই বিকাল ৪টার দিকে নগরের মাছিমপুর এলাকায় কাউন্সিলর প্রার্থী মোস্তাক আহমদ ও ফারুক আহমদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে একজন আহত হয়। এলাকাবাসী জানায়, মারামারি, ভাঙচুর ছাড়াও ওই সময় তারা বন্দুকের গুলির শব্দ শোনেন। এদিকে গত নির্বাচনে বিএনপি’র সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করলেও এবার পৃথকভাবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে জামায়াত। সিলেটে এটাও জোট রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। এসব ঘটনার পাশাপাশি এবার নগরীতে উন্নয়নের ছোঁয়াও অনেকটা নতুনরূপে ধরা দিয়েছে। নির্বাচনের সামনে সে বিষয়গুলোও গুরুত্ব পাচ্ছে। নগরবাসীর দীর্ঘদিনের ভোগান্তি জলাবদ্ধতা অনেকটা নিরসন হয়েছে।
অপ্রীতিকর ঘটনার প্রেক্ষিতে সিলেট আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের কাজ হচ্ছে আগুন দেয়া, বোমা নিক্ষেপ করা। তারা এই সংস্কৃতি থেকে এখনো বের হতে পারেনি। তারা শুরু থেকেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ ধরনের ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এদিকে পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপের ঘটনায় হতবাক হয়েছেন বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি গতকাল নগরীর শাহী ঈদগাহ্ এলাকায় গণসংযোগকালে বলেন- কারা এই ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে সেটি খুঁজে বের করা দরকার।
এসব ঘটনায় অযথা কাউকে হয়রানি করা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল মানবজমিনকে জানিয়েছেন- পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে কারণে ওই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পরিতোষ ঘোষ জানিয়েছেন, পুলিশ কাউকে হয়রানি করছে না। যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে, পুলিশ আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। সিলেট সুজন সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আগে থেকেই যদি নির্বাচন কমিশন কঠোর অবস্থানে থাকতো, তাহলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতো না।