বাংলাদেশে নির্বাচনের নতুন মডেল

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ অভিযোগ সত্যি হলে তিন সিটির নির্বাচন শেষ পর্যন্ত গাজীপুর ও খুলনা মডেলকে হারিয়ে দিয়েছে বলেই গণ্য হবে। এবার একদিনে তিন সিটিতে তিনটি আলাদা মডেল জন্ম নিয়েছে। জালভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাই, এজেন্টদের বের করে দেয়া এবং সাংবাদিক প্রহারের মতো সব উপাদানই যুক্ত হয়েছে। তবে বরিশাল মডেল নতুন রেকর্ড গড়েছে। সেখানে ১০টার মধ্যেই ভোটপর্ব সাঙ্গ হওয়ার ধারণায় মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে ছুটে গেছেন। সিলেটে বিএনপি প্রার্থী নির্বাচন বাতিল দাবি করেছেন।
বরিশালে বিএনপিসহ ৪ প্রার্থীর ভোট বর্জন ঘটেছে। রাজশাহীতে মেয়র প্রার্থী বুলবুলের ভোট না দিয়ে মাঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় বসে থেকেছেন। এসবই নতুন মাত্রা। নতুন ইতিহাস। অনেকে বলছেন, মাগুরার একটি উপ-নির্বাচনে বিএনপির কারচুপি দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সূচনা করেছিল। কিন্তু দুটি সিটির পরে তিন সিটির অনিয়ম সার্বিকভাবে যে অবস্থার জন্ম দিয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ কি? অধিকাংশ নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক একমত যে, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় ভবিষ্যতের স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কি করে বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে? কেন মানুষ বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে নির্বাচনে দাঁড়াবে।

আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো, আগামী সাধারণ নির্বাচন কোন মডেলে হবে? আর পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মডেল-টডেল যাই হোক, ৫ সিটি নির্বাচনে জয় কার, পরাজয় কার। সারকথাটা হলো, হারলো কে?
যদিও বিএনপির মুখপাত্র তিন সিটির নির্বাচনকে তামাশা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র যথারীতি ‘উৎসব মুখর’ পরিবেশে ভোট দেয়ার দাবি করেছেন, কিন্তু গতকাল রাত নয়টা পর্যন্ত সিলেটের ভোটের ফলাফলে দুই প্রধান দলের প্রার্থীদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরিসংখ্যানই প্রচার পাচ্ছিল। অবশ্য সরকারঘেঁষা সূত্র থেকে প্রচারিত পূর্বাভাসে সিলেটে এরকম হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়েরই আভাস দেয়া হয়েছিল।
তবে এটা পরিষ্কার যে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থাটি ইতিমধ্যে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়েছে। বর্তমান প্রক্রিয়ায় সামনে নির্বাচন হলে তার বিশ্বাসযোগ্যতার গ্যারান্টি কে কীভাবে দেবে, সেটা আর কোনো মামুলি প্রশ্ন নয়।

সিলেটের রাজনীতি দেশের অন্যান্য স্থান থেকে কম সহিংসপ্রবণ ছিল। প্রাক নির্বাচনী ব্যবস্থায় তেমন কোনো সহিংসতা দেখাই যায়নি। দুই প্রধান মেয়র প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের সম্পর্কে কোনো ধরনের কটূকাটব্য করেননি। দুই দলের সমর্থকরা পাশাপাশি মিছিলে অংশ নিয়েছে। কোনো ধরনের উত্তেজনা তৈরি করেনি। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর যা ছড়িয়ে পড়েছে, যা তদন্তের দাবি রাখে। ২২ নং উপ-শহরের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আবু জাফর। তার একটি ফেসবুকে লেখা: আমার নিজের ভোটটি আমি দিতে পারি নাই। এদেশে জন্ম মনে হয় পাপ হয়ে গেছে।

সিলেটভিউটুয়েন্টিফোর বলেছে, কেন্দ্র দখল ও জালভোটের প্রতিবাদে ২২ নং ওয়ার্ডে পুনরায় নির্বাচন চান ৫ কাউন্সিলর প্রার্থী। আরেক সাংবাদিকের তার ফেসবুকে দেখা যায়, এরকম একটি পোস্ট: ‘সিলেটে ১২টি কেন্দ্রে ১০০% ভোট কাস্ট হওয়ার পরও শতাধিক ভোটার লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন। ব্যালট পেপার না থাকায় তাদের ফিরে যেতে হয়। উৎসব উৎসব।’ সিলেটে সাংবাদিকরা ক্যামেরা হাতে মুখে হাত দিয়ে মুখবন্ধ রাখার প্রতিবাদ করেছেন।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত কারচুপির অভিযোগ নাকচ করে বলেছেন, বিএনপির আসলে কোনো লোকজন নেই। তাই তারা অর্থহীন অভিযোগ আনছেন।
তবে অনেকেই বলছেন, তিন সিটি নির্বাচনের অনেক ভিডিও ফুটেজ নির্বাচন কমিশন চাইলে আমলে নিতে পারবে। কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা বাধার সম্মুখীন হলেও অনেক স্থানে তারা নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। বরিশালে একাত্তর টিভির আলোকচিত্রি একজন ভোটারকে বুথে ঢুকে ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। নির্বাচন এজেন্টের কাছে সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, আপনাকে তো ভোট দিতে দেখলাম। এজেন্ট ধরা গলায় বলছেন, না স্যার। সাংবাদিকরা আরো সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, বরিশালের পশ্চিম কাউনিয়ায় ২৪০৭ ভোটারের একটি কেন্দ্রে শতাধিক ব্যক্তি গণহারে সিল মেরেছে। ব্যালটের পুরো মুড়িটাই একদল লোক সেখানে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। রাজশাহীতে বেলা ১২টায় নগরীর ইসলামিয়া কলেজে ব্যালট শেষ হয়ে গেছে।
তিন সিটির নির্বাচনী উত্তাপ আজ সরকারিভাবে প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হবে। কিন্তু যে প্রশ্নটি বারবার ঘুরপাক খাবে, তাহলো, তিন মেয়র জয়ী হবেন। আগে সরকার দলীয় দুই মেয়র জিতেছেন। এবারে সরকারি দল থেকে সবাই জিতলে ৫ বছর আগের ইতিহাসের শোধ নেয়া সম্পন্ন হবে। ৫ বছর আগে ৫টি সিটি নির্বাচনে বিএনপির কাছে একত্রে হেরে আওয়ামী লীগ হয়তো মনে করেছিল, তারা সাধারণ নির্বাচনটাই হেরে বসে আছে।
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপিকে আসতেই দেয়া হয়নি, সেই পাঁচ সিটির পরাজয়ের গ্লানি হার থেকে, এটা কারো কারো বিশ্লেষণ। তাহলে প্রশ্ন উঠবে, এবারে তারা ৫টিতে জিততে পারলে, তারা নিশ্চিত মনে আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে সহজভাবে নিতে পারবে?
এরকম যোগ বিয়োগ, হিসাব নিকাশ চলতেই থাকবে। তবে রাজনীতির পণ্ডিতরা বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন সহিংসতা বা অনিয়ম দিয়ে গোটা নির্বাচনকে মূল্যায়ন করার মধ্যে একটা ঝুঁকি থাকে। কিন্তু রাজনীতিতে পারসেপশন বা জনমনে ধারণা বলে একটা কথা আছে। এটা সবসময় তথ্য যাচাই দিয়ে চলে না। সমাজে একটি বার্তা রটেছে বা রটবে। আর তাতে প্রার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে, দলীয়ভাবে জয়ী হবেন। তাদের অভিষেক হবে। গণসংবর্ধনা হবে। রাস্তায় হয়তো ব্যান্ড পার্টি নামবে। বাদ্য বাজবে।
কিন্তু হারবে তো কেউ। কিংবা কোনো একটি পক্ষ হেরে বসে আছে। সিলেটের ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের পরে কিংবা আসামের সঙ্গে সিলেটের থাকা না থাকা নিয়ে যে গণভোট হয়েছিল, সেই সময়টা বিবেচনায় নিলে, কাল যা ঘটলো বলে প্রতীয়মান হলো, তার কোনো নজির নেই।
সবমিলিয়ে হয়তো সন্দেহ সামান্য যে, হেরেছে জনগণ। কারণ বিজয়ী জনপ্রতিনিধিগণের বৈধতার প্রশ্নটি আগামী ৫ বছর ধরেই তাদের তাড়া করে ফিরবে।


Spread the love

Leave a Reply