নাজানীনের তিন দিনের আবেগ
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃসবে যখন গুটি গুটি পায়ে মায়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো শুরু, তখন থেকেই এক ঝড়ে মা-মেয়ে বিচ্ছিন্ন। দুই বছর ধরে মায়ের সঙ্গ পায় না শিশুটি। হঠাৎ করেই রূপকথার দেবীর মতো মা এসে হাজির। তবে মায়ের হাতে সময় খুবই কম। মাত্র তিন দিন। এরপরই আবার তাঁকে চলে যেতে হবে। বন্দী হতে হবে। ছোট্ট শিশুটি আর তার মা যেন সময়টাকে খুব করে কাজে লাগাতে চাইছে। একদণ্ডও কেউ কাউকে কাছছাড়া করতে চাইছে না।
মায়ের হাত ধরে পার্কে যাওয়া, মায়ের সঙ্গে খেলা করা, মায়ের হাতে খাওয়া, মায়ের সঙ্গে ঘুমানো—যা যা করা যায়, সবই করছে বিশ্ব গণমাধ্যমের নজরে থাকা এই মা ও মেয়ে।
সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বন্দিজীবন কাটানো এই মা হলেন নাজানীন জাঘারি র্যাটক্লিফ। চরবৃত্তির অভিযোগে ইরানে কারাবন্দী ইরানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক নাজানীনকে তিন দিনের জন্য মুক্তি দিয়েছেন দেশটির আদালত। ২০১৬ সালে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
মুক্ত হয়ে সবার ভালোবাসা পেয়ে মুগ্ধ নাজানীন। অল্প সময়ের জন্য হলেও তাঁর চার বছরের মেয়ে গ্যাবরিয়েলা ‘মাকে আবার ফিরে পেয়েছে’—বলে আবেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেছেন, নাজানীনকে বন্দী করা ‘বড় ধরনের অবিচার’ এবং তাঁকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দেওয়া উচিত।
নাজানীনকে মুক্ত করার জন্য গড়ে ওঠা গ্রুপ ‘নাজানীন মুক্তি আন্দোলন’ বলছে, তিন দিনের জন্য মুক্তি দেওয়ার ‘চর্চা’ রয়েছে। তাঁর আইনজীবী এই মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবার আবেদন করবেন।
নাজানীনকে মুক্ত করার আন্দোলন গড়ে তোলেন তাঁর স্বামী রিচার্ড র্যাটক্লিফ। স্ত্রীকে বাড়িতে ফিরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তিনি এই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
স্ত্রী তিন দিনের জন্য মুক্তি পাওয়ার পর র্যাটক্লিফ বলেছেন, তাঁর সাময়িক এই মুক্তি তাঁদের জন্য আনন্দ বয়ে এনেছে। নাজানীন এখন পরিবারের সঙ্গে ইরানের দামাভান্দে সময় কাটাচ্ছেন।
নাজানীন থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ইরানে বসবাসরত তাঁর পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে এলে তেহরান বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইরান তাঁর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ করে। তিনি জানান, নিজের পরিবারের সঙ্গে শিশুকন্যাকে পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি এসেছিলেন।
‘নাজানীন মুক্তি আন্দোলন’-এর এক বিবৃতিতে তাঁর স্বামী র্যাটক্লিফ বলেন, তাঁর স্ত্রীকে ১০ মিনিটের নোটিশে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রোববার পর্যন্ত তিনি মুক্তি পাচ্ছেন। আন্দোলন গ্রুপটির পক্ষ থেকে বলা হয়, তাঁকে মুক্তি দেওয়া নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা চলছিল।
এই মুক্তির জন্য নাজানীনকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তার মধ্য রয়েছে—গণমাধ্যমের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া যাবে না। কোনো দেশের দূতাবাসে যাওয়া যাবে না, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের। ইরান ছাড়ার চেষ্টা করা যাবে না। নাজানীন ও তাঁর বাবা দুজনেই আলাদাভাবে এসব শর্ত মেনে চলার অঙ্গীকার করেছেন।
তাঁকে তিন দিনের মুক্তি দেওয়া প্রসঙ্গে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি ইরানের কাছ থেকে। ধারণা করা হচ্ছে, ঈদের কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মেয়েকে নিয়ে আবেগে ভাসছেন নাজানীন। তিনি বলেছেন, ‘অবশেষে মাকে বাড়িতে পাওয়া গ্যাবরিয়েলার জন্য দারুণ কিছু। তার পুতুলের ঘর নিয়ে আমরা দুজন খেলছি। আমাকে সে তার সব খেলনা দেখাচ্ছে। তার চুল আঁচড়ে দেওয়া, গোসল করানো, পার্কে নিয়ে যেতে পারা, খাওয়ানো, তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা—এই সবকিছু আমাকে পাগল করে তুলেছে। এটা বিশ্বাস করা এখনো কঠিন আমার জন্য।’
নাজানীন বলেন, ‘নানির সঙ্গে দেখা করাও ছিল আমার জন্য অনেক আবেগের মুহূর্ত। আমি এত কেঁদেছি। আমি এতটা ভালোবাসা পেয়েছি। মনে হচ্ছে যেন, এই শেষ থেকেই যদি আবার সবকিছু শুরু করা যেত।’