অপহরণের ৩২ বছর পর আমার ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি

Spread the love

বাংলা সাংলাপ ডেস্কঃ লি জিংঝি তিন দশকের বেশি সময় ধরে তার ছেলেকে খুঁজে বেরিয়েছেন। তার ছেলে মাও ইনকে ১৯৮৮ সালে অপহরণের পর বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। তিনি আর কোনদিন ছেলের দেখা পাবেন, এমন আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু গত মে মাসে একদিন তিনি একটি ফোন কল পেলেন, যেটির জন্য তিনি ৩২ বছর ধরে অপেক্ষা করেছেন।

প্রতি সপ্তাহান্তে জিংঝি এবং তার স্বামী তাদের শিশুপুত্র মাও ইনক নিয়ে কোন চিড়িয়াখানা বা শহরের কোন একটি পার্কে নিয়ে যেতেন। তারা থাকতেন মধ্যচীনের শাংজি প্রদেশের শিয়ান শহরে। তার স্মৃতিতে এরকম একটি বেড়ানোর স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

“সেসময় তার বয়স ছিল সাড়ে তিন বছর। আমরা ওকে শিয়ান শহরের চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ও মাটিতে একটি কেঁচো দেখতে পেল। ও বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠলো। কেঁচোটি দেখিয়ে বললো, মা, দেখ, একটা কেঁচো। আমি যখন ওকে চিড়িয়াখানা থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি, ও তখন কেঁচোটি হাতে ধরে আমার মুখের কাছে নিয়ে এসেছে।”
মাও ইন ছিল তার একমাত্র সন্তান। চীনের এক সন্তান নীতি তখন পুরোপুরি কার্যকর। কাজেই একের অধিক সন্তান নেয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। তিনি চেয়েছেন তার ছেলে খুব ভালোভাবে পড়াশোনা করবে এবং সফল হবে। কাজেই তিনি তার ডাক নাম রাখলেন জিয়া জিয়া, যার মানে মহৎ।

ঝিংজি বলেন, “জিয়া জিয়া ছিল খুব শান্ত এবং বাধ্য ছেলে। স্মার্ট। খুব বুঝদার। ও খুব একটা কাঁদতো না। ও ছিল খুবই প্রাণবন্ত এবং আদুরে। ও ছিল এমন এক শিশু যাকে যেই দেখতো সে-ই পছন্দ করতো।”

ঝিংজি এবং তার স্বামী সকালে ছেলেকে একটি কিন্ডারগার্টেনে দিয়ে আসতেন। এরপর দিনের কাজ শেষে আবার সেখান থেকে তুলতেন।

“প্রতিদিন আমার কাজ শেষ হওয়ার পর আমি আমার ছেলের সঙ্গে খেলতাম। আমি খুবই সুখী ছিলাম।”

ঝিংজি কাজ করতেন একটি শস্য রফতানিকারক কোম্পানির সঙ্গে। যখন ফসল তোলার সময় হতো, তখন তাকে শহর ছেড়ে গ্রামে গ্রামে যেতে হতো খাদ্যশস্য সরবরাহকারীদের সঙ্গে দেখা করতে। জিয়া জিয়া তখন বাড়িতে তার বাবার সঙ্গে থাকতো। একদিন এরকম এক সফরে তিনি তার কর্মচারীদের কাছ থেকে একটি খবর পেলেন। তাকে দ্রুত ফিরে আসতে বলা হলো।

“সেসব দিনে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেই ভালো ছিল না”, বলছিলেন ঝিংজি।

“কাজেই আমার কাছে মাত্র ছয় শব্দের একটি টেলিগ্রাম এসেছিল। তাতে লেখা, বাড়িতে জরুরী দরকার, এক্ষুনি ফিরে আসো’। আমি জানতাম না কী ঘটেছে।”

ঝিংজি দ্রুত শিয়ানে ফিরে আসলেন। সেখানে একজন ম্যানেজার তাকে সেই ভয়ংকর খবরটি দিল।

“আমার নেতা আমাকে কেবল একটা কথাই বললেন, ‘তোমার ছেলে নিখোঁজ।”

আমার অন্তর যেন শূন্য হয়ে গেল। আমার মনে হচ্ছিল হয়তো আমার ছেলে কোথাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু আমার একবারও মনে হয়নি, আমার ছেলেকে আর কখনো খুঁজে পাবো না।”

১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা এটি। জিয়া জিয়ার বয়স তখন মাত্র ২ বছর ৮ মাস।

জিংঝির স্বামী বলছিলেন, তিনি জিয়া জিয়াকে কিন্ডারগার্টেন থেকে তুলে নিয়ে আসেন। পথে তিনি থেমেছিলেন তাদের পারিবারিক মালিকানাধীন একটি ছোট্ট হোটেল থেকে ছেলের জন্য খাবার পানি সংগ্রহের জন্য। মাত্র এক-দুই মিনিটের জন্য হয়তো তিনি ছেলেকে বাইরে রেখে গিয়েছিলেন। যখন ফিরলেন, সেখানে জিয়া জিয়া নেই।

জিংঝি ভেবেছিলেন, ছেলেকে দ্রুত খুঁজে পাওয়া যাবে।

লি ঝিংজি এবং তার ছেলে মাও ইন (জিয়া জিয়া))

“আমি ভেবেছিলাম আমার ছেলে হয়তো হারিয়ে গেছে। ও হয়তো তার বাড়ির পথ খুঁজে পাচ্ছে না। কোন দয়ালু লোক হয়তো তাকে খুঁজে পাবে এবং আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবে।”

কিন্তু এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। কেউ তাকে খুঁজে পেল না, তখন জিংঝি বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি বেশ জটিল।

হোটেলটির আশে-পাশের এলাকায় গিয়ে তিনি জনে জনে জিজ্ঞেস করতে থাকলেন, জিয়া জিয়াকে কেউ দেখেছে কীনা। তিনি জিয়া জিয়ার ছবিসহ এক লাখ লিফলেট ছাপালেন। শিয়ানের রেল স্টেশন এবং বাস স্টেশনে গিয়ে তিনি লিফলেট বিলি করলেন। স্থানীয় কাগজে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিলেন। কিন্তু কোন কাজ হলো না।

“আমার মনে যে তখন কী তীব্র কষ্ট.. আমার কান্না পাচ্ছিল, আমার চিৎকার করতে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমার হৃদয়টা ফাঁকা হয়ে গেছে।”

ছেলের কাপড়-চোপড় দেখলে তখন তার কান্না পেত। ছেলের জুতা, খেলনা- এসব দেখে তার কান্না পেত।

চীনে তখন শিশু পাচারের ঘটনা যে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা জানতেন না জিংঝি।

চীনে এক সন্তান নীতি চালু হয় ১৯৭৯ সালে। এর উদ্দেশ্য ছিল চীনের দ্রুত বাড়তে থাকা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং দারিদ্র বিমোচন করা।

শহরে বাস করেন যেসব দম্পতি, তারা কেবল একটি সন্তান নিতে পারবেন। তবে যারা গ্রামাঞ্চলে থাকেন, তাদের প্রথম সন্তান যদি মেয়ে হয়, তাহলে তারা দ্বিতীয় একটি সন্তান নিতে পারবেন।

যেসব দম্পতি আশা করেছিলেন যে তাদের একটি পুত্র সন্তান হবে এবং পরিবারের নাম ধরে রাখবে, বৃদ্ধ বয়সে তাদের যত্ম নেবে, তাদের সামনে পুত্র্র সন্তানের চেষ্টা করার আর কোন উপায় রইলো না। যদি তারা একের অধিক সন্তান নেন, তাদের বিরাট অংকের জরিমানা করা হবে। তাদের দ্বিতীয় সন্তানকে সব ধরণের সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে।

মনে করা হয়, সরকারের এই নীতির ফলে শিশু অপহরণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে ছেলে শিশু। কিন্তু এর কিছুই আসলে জিংঝি জানতেন না।

“কখনো কখনো টেলিভিশনে নিখোঁজ শিশুর সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞপ্তি থাকতো। কিন্তু আমি জানতাম না যে এসব শিশুকে অপহরণ করে বিক্রি করে দেয়া হয়। আমার কেবল ধারণা ছিল, তারা আসলে হারিয়ে গেছে।”

বাবা এবং মায়ের সঙ্গে পুর্নমিলনের পর জিয়া জিয়া

জিয়া জিয়া হারিয়ে যাওয়ার পর প্রথমেই তিনি দোষ দিলেন তার স্বামীকে। কিন্তু পরে তিনি উপলব্ধি করলেন, ছেলেকে খুঁজে পেতে হলে তাদের দুজনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সময় যত গড়াতে লাগলো, তারা এটি নিয়ে এতটাই ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন যে তারা আর কিছু নিয়ে কখনো কথা বলতেন না। চার বছর পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেল।

জিংঝি কিন্তু কখনো তার ছেলেকে খোঁজা বন্ধ করেন নি। প্রতি শুক্রবার বিকেল কাজ শেষ করে তিনি ট্রেনে চেপে চলে যেতেন আশে-পাশের বিভিন্ন প্রদেশে। জিয়া জিয়াকে খুঁজতে। রোববার সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরতেন যাতে আবার পরদিন কাজে ফিরতে পারেন। যখনই তিনি কোন নতুন তথ্য বা সূত্র পেতেন, তার ছেলে জিয়া জিয়ার মতো দেখতে কোন শিশুকে কেউ দেখেছে, তিনি ছুটে যেতেন তদন্ত করতে।

যেবছর জিয়া জিয়া নিখোঁজ হয়েছিল, সেবছরই এরকম এক লম্বা সফরে যান জিংঝি। শাংজি প্রদেশের আরেকটি শহরে তাকে যেতে হয়েছিল অনেক দীর্ঘ বাস জার্নি করে। সেখান থেকে আরেকটি বাসে চেপে তিনি যাচ্ছিলেন এক গ্রামের দিকে। সেখানে নাকি এক দম্পতি শিয়ান শহরের এক শিশুকে দত্তক নিয়েছে, যে দেখতে অবিকল জিয়া জিয়ার মতো।

সেই গ্রামে গিয়ে সারাদিন অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কখন গ্রামের লোক ফসলের ক্ষেত থেকে কাজ শেষে বাড়ি ফিরে, সেই অপেক্ষায়। কিন্তু সন্ধ্যায় তিনি জানতে পারলেন, এই দম্পতি নাকি ছেলেটিকে নিয়ে শিয়ান শহরে গিয়েছে।

জিংঝি সাথে সাথে আবার ফিরতি পথ ধরলেন। পরদিন সকালে ফিরে আসলেন নিজ শহরে।

এই দম্পতি যে ফ্ল্যাটটিতে ভাড়া থাকে, সেই ফ্ল্যাটটি খোঁজা শুরু করলেন। কিন্তু বাড়িওয়ালা জানালো, তারা মাত্র দুদিন আগে সেখান থেকে অন্য শহরে চলে গেছে।

জিংঝি এবার দ্রুত ছুটলেন সেই শহরে। যতক্ষণে সেখানে পৌঁছালেন, তখন রাত হয়ে গেছে। কয়েক ঘন্টা ধরে তিনি শহরটির এক হোটেল থেকে আরেক হোটেলে ছুটছিলেন তাদের খুঁজে বের করার জন্য। শেষ পর্যন্ত তাদের হোটেলটি যখন খুঁজে পেলেন, ততক্ষণে সেই হোটেল ছেড়ে দিয়েছে তারা।

কিন্তু এরপরও হাল ছাড়লেন না জিংঝি। তখন প্রায় মধ্যরাত। তিনি সেখান থেকে আরেক শহরে গেলেন এই লোকটির বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে। সেখানেও তাদের পাওয়া গেল না। এবার তিনি স্ত্রীলোকটির নিজ শহরে যেতে চাইলেন। কিন্তু ততক্ষণে তিনি একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। দুদিন ঘুমাননি। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করেননি।

একটু বিশ্রাম নিয়ে তিনি আবার ছুটলেন। এবার সেখানে পৌঁছে তিনি স্ত্রীলোকটি এবং তার শিশুটিকে খুঁজে পেলেন। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হলো। তাদের দত্তক নেয়া শিশুটি জিয়া জিয়া নয়।

“আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, এই শিশুটি জিয়া জিয়া। আমাকে হতাশ হতে হলো। আমার ওপর এর একটা বিরাট প্রভাব পড়লো। এরপর আমি যেন সারাক্ষণ আমার ছেলের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার মায়ের ভয় হতে লাগলো যে, আমি হয়তো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি।”

প্রতিদিন সকালে যখন তার ঘুম ভাঙ্গতো, প্রথমেই তার মনে হতো ছেলের কথা। রাতে তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলে ‘মা’,’মা’ করে কাঁদছে। তার এক বন্ধু ছিল ডাক্তার। তার পরামর্শে জিংঝি হাসপাতালে ভর্তি হলেন।

“একজন ডাক্তার আমাকে এমন কিছু বলেছিল, যা আমার মনে বিরাট ছাপ ফেলেছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসা করতে পারি। কিন্তু তোমার মনের চিকিৎসা, সেটা কিন্তু তোমার ওপর।’ তার এই কথা নিয়ে আমি সারারাত ভাবলাম। আমি অনুভব করলাম যে এভাবে চলা সম্ভব নয়। আমি যদি আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, আমি হয়তো উন্মাদ হয়ে যাব। আর আমি যদি পাগল হয়ে যাই, তাহলে তো আর আমার ছেলেকে খুঁজতে যেতে পারবো না। অথবা আমার ছেলে যদি ফিরে এসে দেখে তার মা পাগল হয়ে গেছে, সেটা তার জন্য খুবই বেদনাদায়ক হবে।”

এরপর থেকে জিংঝি সচেতনভাবে চেষ্টা করতেন যাতে কোনভাবেই তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে না পড়েন। যাতে তিনি ছেলের সন্ধানে তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেন।

এদিকে জিংঝির বোন জিয়া জিয়ার সব কাপড়চোপড় আর খেলনা বেঁধে তুলে রাখলেন। কারণ এগুলো দেখলেই জিংঝির মানসিক যন্ত্রণা শুরু হতো।

এরই মধ্যে জিংঝি উপলব্ধি করলেন, তিনি একা নন, তার মতো আরও বহু বাবা-মা তাদের নিখোঁজ সন্তানের খোঁজ করছে। শুধু শিয়ান শহরে নয়, চীনের আরও দূর-দূরান্তে। চীনের প্রায় সব প্রদেশের এরকম বাবা-মারা মিলে তখন তারা একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেন । তারা একে অন্যের কাছে লিফলেট ভর্তি ব্যাগ পাঠাতেন। এরপর এসব লিফলেট বিলি করতেন।

এই নেটওয়ার্ক থেকে আরও অনেক সূত্রের সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, কোনটি থেকেই আসলে জিয়া জিয়াকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ছেলেকে খুঁজতে জিংঝি সব মিলিয়ে চীনের দশটি প্রদেশ সফর করেন।

ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর যখন ১৯ বছর পেরিয়ে গেছে, জিংঝি একটি ওয়েবসাইটের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ শুরু করলেন। এই ওয়েবসাইটের নাম, ‘বেবি কাম হোম।’ যেসব বাবা-মার সন্তান নিখোঁজ, তাদের নিখোঁজ সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয় এই ওয়েবসাইট।

“এরপর আমার আর নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল না। আমাদের সন্তানদের খুঁজে পেতে কত কত স্বেচ্ছাসেবক যে এখানে কাজ করছিল। এদের কাজ আমাকে খুব নাড়া দিল”, বলছিলেন জিংঝি।

“আরেকটা সুবিধাও ছিল। আমি ভাবছিলাম, যদি আমার ছেলেকে খুঁজে নাও পাওয়া যায়, আমি অন্য ছেলেদের অন্তত তাদের নিজের পরিবারে ফিরে যেতে সাহায্য করতে পারবো।”

এরপর ২০০৯ সালে চীন সরকার একটি ডিএনএ ডেটাবেজ স্থাপন করলো। যেসব দম্পতির সন্তান নিখোঁজ হয়ে গেছে তারা এবং যেসব ছেলে-মেয়ে মনে করে তাদের অপহরণ করা হয়েছিল তারা এখানে তাদের ডিএনএ রাখতে পারে। এটা ছিল এক বিরাট পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে এরকম অনেক নিখোঁজ রহস্যের মীমাংসা হয়েছিল।

জিংঝি যত শিশু নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা শুনেছেন, তার বেশিরভাগই ছিল ছেলে শিশু। যেসব দম্পতি এরকম শিশু কেনে, তারা নিঃসন্তান। বা হয়তো তাদের কন্যা সন্তান আছে, ছেলে নেই। এদের বেশিরভাগই সাধারণত চীনের গ্রামাঞ্চলের।

‘বেবি কাম হোম’ ওয়েবসাইট এবং অন্যান্য সংগঠনের মাধ্যমে জিংঝি এপর্যন্ত ২৯জন ছেলে-মেয়েকে তাদের বাবা-মার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছেন। তিনি বলছেন, বাবা-মার সঙ্গে সন্তানদের পুনর্মিলনের এই দৃশ্য দেখার অনুভূতি বর্ণনা করা কঠিন।

“আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম: এটা আমার ছেলে কেন হলো না? কিন্তু যখন আমি দেখতাম অন্য বাবা-মারা তাদের সন্তানকে আলিঙ্গন করছে, তখন আমার খুব ভালোও লাগতো। আমার মনে হতো, এদের যদি এরকম সৌভাগ্য হতে পারে, একদিন আমারও হবে। আমি আশাবাদী হয়ে উঠতাম। ওদের ছেলে-মেয়েকে ফিরে আসতে দেখে আমার আশা জাগতো, একদিন আমার ছেলেও আমার কাছে ফিরে আসবে।”

তবে এরকম অনেক সময় আসতো, যখন তিনি একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়তেন।

“যখনই কোন সূত্র ধরে এগিয়ে দেখতাম যে আসলে সেটা ঠিক ছিল না, তখন হতাশ হতাম। কিন্তু আমি বার বার হতাশ হতে চাইছিলাম না। যদি আমি বার বার হতাশায় আক্রান্ত হই, আমার পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হতো। কাজেই আমি আশা ছাড়লাম না।”

তার বৃদ্ধা মাও তার মধ্যে আশা জাগিয়ে রাখতে সাহায্য করলেন।

“আমার মা ২০১৫ সালে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি সবসময় জিয়া জিয়ার কথা মনে করতেন। একবার আমার মা আমাকে বললেন, তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, জিয়া জিয়া ফিরে এসেছে। তিনি বলছিলেন, প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেল, ওর এখন ফেরা উচিৎ।”

মৃত্যুর আগে যখন তার মা অচেতন হয়ে পড়েছেন, তখন জিংঝি বুঝতে পারছিলেন, তার মা হয়তো জিয়া জিয়ার কথা ভাবছে।

“আমি আমার মায়ের কানে ফিসফিস করে বলেছিলাম, মা চিন্তা করো না, আমি নিশ্চয়ই জিয়া জিয়াকে খুঁজে পাবো। এটি শুধু আমার নিজের ইচ্ছে পূরণের জন্য নয়, আমার মায়ের ইচ্ছেও আমি পূরণ করতে চেয়েছিলাম। আমার মা মারা গিয়েছিল ২০১৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি। চন্দ্র বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী, সেদিন ছিল জিয়া জিয়ার জন্মদিন। আমার মনে হলো ঈশ্বর যেন এভাবেই আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আমি যেন আমার জন্মদাত্রী মাকে এবং সেই সঙ্গে আমি যে সন্তানকে জন্ম দিয়েছি, তাদের কাউকে ভুলে না যাই। একই দিনে একজন বিদায় নিয়েছিলেন, আরেকজন জন্মগ্রহণ করেছিল।”

তারপর এবছরের ১০ই মে, মা দিবস তিনি একটি ফোন কল পেলেন। এটি এসেছিল শিয়ান শহরের জননিরাপত্তা ব্যুরো থেকে।

তারা একটি অসম্ভব ভালো খবর দিল: “মাও ইনকে খুঁজে পাওয়া গেছে।”

“আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এটা বাস্তব”, বলছিলেন জিংঝি।

এপ্রিল মাসে তাকে একজন একটা তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি এমন একজনকে চেনেন, যাকে নাকি বহু বছর আগে শিয়ান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার পরিণত বয়সের একটা ছবি এই লোকটি জিংঝিকে দিলেন।

জিংঝি এই ছবিটি পুলিশের কাছে নিয়ে গেলেন। ফেসিয়াল রিকগনিশন টেকনোলজি দিয়ে পুলিশ খুঁজে বের করলো ছবির লোকটিকে। তিনি থাকেন পাশ্ববর্তী প্রদেশ সিচুয়ানের চেংডু শহরে। প্রায় সাতশো কিলোমিটার দূরে।

পুলিশ এই লোকটিকে একটি ডিএনএ টেস্ট করাতে রাজী করাতে পারলো। ১০ই মে এই ডিএনএ পরীক্ষার ফল জানা গেল। তার ডিএনএ মিলে গেল জিংঝির সঙ্গে।

পরের সপ্তাহে পুলিশ আরেক দফা রক্তের নমূনা সংগ্রহ করে আবার ডিএনএ পরীক্ষা করলো। এবারও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো, জিংঝি এবং এই লোকটি মা এবং ছেলে।

“যখন আমি ডিএনএ পরীক্ষার ফল পেলাম, তখনই আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করলাম যে আমার ছেলেকে খুঁজে পাওয়া গেছে।”

অন্তত ৩০০ বার ভুল সূত্রের পেছনে ঘুরে, ৩২ বছর পর অবশেষে ছেলের জন্য জিংঝির অনুসন্ধানের সমাপ্তি ঘটলো।

মা-ছেলের পুর্নমিলনের দিন নির্ধারিত হলো ১৮ই মে, সোমবার। জিংঝি নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না, তার ছেলে তাকে কতটা অনুভব করবে। ছেলে এখন প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ, বিবাহিত। তার নিজের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের ব্যবসা আছে।

“আমাদের দেখা হওয়ার আগে আমার মধ্যে অনেক দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। ও হয়তো আমাকে স্বীকার করবে না, আমাকে গ্রহণ করবে না। হয়তো ওর মনে আর আমার জায়গা নেই, আমাকে একদম ভুলে গেছে। আমার ভয় লাগছিল, আমি যখন আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে যাব, ও হয়তো আমাকে জড়িয়ে ধরতে দেবে না। আমার মনে হচ্ছিল,যে ছেলেকে আমি ৩২ বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি, আমার আলিঙ্গন এবং ভালোবাসা যদি সে গ্রহণ না করে, তখন আমি আরও বেশি কষ্ট পাব।”

জিংঝি যেহেতু নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ছেলে-মেয়েদের সমস্যা নিয়ে প্রায়শই টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতেন, তার ঘটনাটি অনেকেই জানতো। তাই ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার খবরটি চীনের গণমাধ্যমে চাঞ্চল্য তৈরি করলো।

যেদিন মা-ছেলের পুর্নমিলন ঘটলো, সেদিন চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন (সিসিটিভি) এটি লাইভ সম্প্রচার করে।

জিয়া জিয়া যখন শিয়ানের জননিরাপত্তা ব্যুরোর অনুষ্ঠান হলে ঢুকছেন, তিনি ‘মা’ বলে চিৎকার করে ডাকলেন তার মাকে। এরপর দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তার মাকে। মা, ছেলে, বাবা- সবাই তখন কাঁদছেন, সবার চোখে পানি।

“ছোটবেলায় ও ঠিক এভাবেই আমার দিকে দৌড়ে আসতো”, বলছিলেন জিংঝি।

জিংঝি পরে জানতে পেরেছিলেন, জিয়া জিয়াকে অপহরণের এক বছর পর সিচুয়ান প্রদেশের এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল ৬ হাজার ইউয়ানে। তার দত্তক বাবা-মা তার নতুন নাম রেখেছিল গু নিংনিন। একমাত্র সন্তান হিসেবে তিনি সেই পরিবারে বড় হন।

সেখানে তিনি প্রাথমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুলে যান। এরপর পড়াশোনা করেন চেংডুর কলেজে। আজব ব্যাপার হচ্ছে, তিনি টেলিভিশনে তার মা জিংঝিকে দেখেছেন। তার মনে হয়েছে এই নারী খুবই স্নেহময়ী। জিংঝি যখন টেলিভিশনে তার ছেলের ছোটবেলার ছবি দেখাচ্ছিল, তখন তার এটাও মনে হয়েছে, এই ছবির সঙ্গে তার ছোটবেলার ছবির অনেক মিল। কিন্তু তারপরও তাদের দুজনের মধ্যে যে কোন সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা তার মনে হয়নি।

কিন্তু যে লোকটি মা-ছেলের মধ্যে পুর্নমিলনের সূত্রটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চান না।
দুজনের এই পুর্নমিলনের পর জিয়া জিয়া একমাস শিয়ান শহরে পালাক্রমে তার মা এবং বাবার সঙ্গে থেকেছেন। এসময় মা-ছেলে তাদের পুরোনো ছবি দেখেছেন। তারা আশা করছিলেন, এসব ছবি দেখে জিয়া জিয়া তার শৈশবের কথা মনে করতে পারবেন।

কিন্তু জিয়া জিয়া আসলে তার চার বছর বয়সের আগের কোন স্মৃতিই মনে করতে পারেন না।

জিংঝি বলেন, “এই বিষয়টাই আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্টের। আমার ছেলে যখন ফিরে আসলো, আমি চেয়েছিলাম আমাদের সঙ্গে যখন ও ছিল, সে সময়ের একটা স্মৃতি যেন ও মনে করতে পারে। কিন্তু সেরকম কিছু এখনো ও মনে করতে পারেনি‍।”‍
একদিন শিয়ানের একটা সুন্দর জায়গায় বেড়াতে গিয়ে জিংঝি নিজেও উপলব্ধি করলেন, অতীতকে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।

“সেদিন আমরা একটা পাহাড়ে বেড়াতে যাই। ফেরার সময় আমি বলি, জিয়া জিয়া, আসো, আমি তোমাকে কোলে করে নামাই। কিন্তু আমি তো এখন আর ওকে কোলে নিতে পারি না, ও তো অনেক বড়।”

“আমার মনে হচ্ছিল, ও যদি আবার আমার কাছে ফিরে আসে, আমরা আমার নতুন করে শুরু করতে পারি, যখন ও শিশু ছিল তখন থেকে। আমরা আমাদের গত ৩২ বছরের শূন্যতা পূরণ করতে পারি। আমি আমার ছেলেকে বলছিলাম, জিয়া জিয়া, তুমি কি আবার একেবারে ছোট্টটি হয়ে যেতে পারো? তুমি আবার ২ বছর ৮ মাস থেকে শুরু করবে, আমি শুরু করবো ২৮ বছর থেকে। আসো, আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করি।

কিন্তু জিংঝি জানেন, এটা সম্ভব নয়।

জিয়া জিয়া এখনো চেংডুতেই থাকেন। আর মা জিংঝি থাকেন শিয়ানে। অনেকেই তাকে উপদেশ দিয়েছে, তিনি যেন ছেলেকে শিয়ানে ফিরে আসতে রাজী করান। যদিও এরকমটা হলে জিংঝি খুশিই হবেন, কিন্তু ছেলের জীবনে তিনি জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না।

“ও এখন একজন পরিণত মানুষ। ওর নিজের চিন্তা-ভাবনা আছে। জিয়া জিয়া বিয়ে করেছে। তার নিজের পরিবার আছে। ওর জন্য আমার শুভকামনা, দূর থেকে। আমি এখন জানি আমার ছেলে কোথায় আছে। আমি জানি, ও বেঁচে আছে। তাতেই আমি খুশি।”

মা আর ছেলের মধ্যে এখন প্রতিদিন কথা হয় উইচ্যাটে, চীনের সবচয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ।
“আমার ছেলের ব্যক্তিত্ব একদম আমার মতই। ও আমার জন্য অনেক ভাবে। আমিও ওকে নিয়ে অনেক চিন্তা করি। এত বছর পরেও এখনো আমার প্রতি ওর ভালোবাসা আছে। আমার মনে হয়, আমরা যেন কখনো বিচ্ছিন্ন হইনি। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ।”

জিয়া জিয়া কোন সাক্ষাৎকার দিতে চান না। তার দত্তক বাবা-মার ব্যাপারে কোন তথ্যও পুলিশ প্রকাশ করছে না।

৩২ বছর আগে কে জিয়া জিয়াকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাকে একদিন পুলিশ খুঁজে বের করবে বলে আশা করেন জিংঝি। তিনি চান, এই দুস্কৃতকারী সাজা পাক, যে তার ৩২ বছরের যন্ত্রণার জন্য দায়ী।

এখন তিনি তার ফিরে পাওয়া ছেলের সঙ্গে নতুন স্মৃতি তৈরি করতে ব্যস্ত। পুর্নমিলনের পর তারা বহু ছবি তুলেছেন।

তার প্রিয় ছবি হচ্ছে সেটি, যেটি তারা পুর্নমিলনের একদিন পর একসঙ্গে তুলেছিলেন। তখন তারা একটি পার্কে একসঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন।
সেই ছবিতে মা আর ছেলে পাশাপাশি, দুজনকে দেখে মনে হবে হুবহু একই চেহারা। দুজনের মুখেই পুর্নমিলনের খুশির আভা।

জিংঝি বলছেন, গত কয়েক বছরে চীনা সরকার এবং চীনা গণমাধ্যমের প্রচেষ্টায় শিশু অপহরণের ঘটনা অনেক কমে এসেছে।

কিন্তু এখনো অনেক পরিবার আছে, যারা তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে খুঁজছে। অনেকে তাদের জন্মদাতা পিতা-মাতাকে খুঁজছে। কাজেই জিংঝির সামনে এখনো অনেক কাজ।

(এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত বেশিরভাগ ছবি লি জিংঝির সৌজন্যে)

রিপোর্ট; বিবিসি বাংলা


Spread the love

Leave a Reply