আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার গণহত্যার মামলা আসলে কী
ইসরায়েল অবশ্য এটিকে শক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এটি সম্পূর্ণ ‘ভিত্তিহীন’।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত হলো জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত, যার সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করে আইনি বিষয়ে পরামর্শ ভিত্তিক মতামত দেয়ার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির মতো আইসিজে গণহত্যার মতো সর্বোচ্চ অপরাধের জন্যও কোনো ব্যক্তির বিচার করতে পারে না।
তবে এর মতামত জাতিসংঘ ও অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে বাড়তি গুরুত্ব বহন করে।
![আইসিজে গণহত্যার অভিযোগের বিষয়ে মতামত দিতে পারে কারণ মামলাটির কোন ফৌজদারি বিচার হচ্ছে না।](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/5b12/live/3bd0c350-b13e-11ee-a24d-5371dfbad329.jpg)
গণহত্যা কী এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলাটি কী
দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগ গত সাতই অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
হামাসের শত শত বন্দুকধারী গাজা উপত্যকা থেকে গিয়ে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় তেরশ মানুষকে হত্যা করে এবং ২৪০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়।
এরপর গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল এবং হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে ওই অভিযানে সেখানে তেইশ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে, যার বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
আইসিজেতে দক্ষিণ আফ্রিকা যে প্রমাণপত্র জমা দিয়েছে তাতে দাবি করা হয়েছে যে ইসরায়েলের যে কার্যক্রম তার সঙ্গে গণহত্যার বৈশিষ্ট্যের মিল আছে কারণ তারা ফিলিস্তিনিদের জাতীয়, জাতিগত এবং নৃগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশকে ধ্বংস করতে চেয়েছে।
ইসরায়েল গাজায় যা করেছে এবং যা করতে চেয়েছে- উভয় ক্ষেত্রেই এ বক্তব্য তুলে ধরেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
অর্থাৎ ইসরায়েল এখন যা করছে যেমন বিমান হামলা এবং যা করতে পারেনি তাহলো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
এই মামলায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ্যে ইসরায়েল যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে সেটিকে তুলে ধরা হয়েছে ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ এর প্রমাণ হিসেবে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর করা কিছু মন্তব্যও আছে।
আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ‘জাতি, বর্ণ বা নৃগোষ্ঠী বা ধর্মীয় কোনো সম্প্রদায়কে আংশিক বা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি বা একাধিক কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে’।
এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে :
কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা বা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি।
কোনো গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস করা।
কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন জন্ম প্রতিরোধের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া।
জোর করে এক গ্রুপের শিশুদের অন্য গ্রুপে স্থানান্তর করা।
![সামরিক অভিযানে গাজায় মূলত নারী ও শিশুদের মৃত্যু হয়েছে।](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/87d9/live/9725a720-b13e-11ee-a24d-5371dfbad329.jpg)
গণহত্যার অভিযোগের জবাব ইসরায়েল কীভাবে দিচ্ছে
ইসরায়েল অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়েই দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
মি. নেতানিয়াহু বলেছেন : “নো, দক্ষিণ আফ্রিকা, গণহত্যার অপরাধ আমরা করিনি, এটি করেছে হামাস।”
“তারা পারলে আমাদের সবাইকে হত্যা করতো।”
“বিপরীতে আইডিএফ (ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স) যতটা সম্ভব নৈতিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছে।”
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে তারা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে।
এর মধ্যে আছে:
হামলার আগে সতর্কতা জারি করা
যেসব ভবন টার্গেট করা হয়েছিলো সেগুলো ছেড়ে দিতে বেসামরিক নাগরিকদের ফোনে অনুরোধ করা
বেসামরিক নাগরিকরা চলাচল করছে এমন সময়ে কিছু হামলার সিদ্ধান্ত বাতিল করা
এবং ইসরায়েল সরকার বারবার বলেছে তাদের লক্ষ্য হামাসকে ধ্বংস করা, ফিলিস্তিনের মানুষকে নয়।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের একজন মুখপাত্র বলেছেন মি. সুনাক বিশ্বাস করেন যে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলাটি ‘পুরোপুরি অন্যায্য ও ভুল’।
“এ ধরনের আইনি পদক্ষেপ শান্তি নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে না। যুক্তরাজ্য সরকার আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামোর মধ্যে ইসরায়েলিদের নিজেদের রক্ষার অধিকারের সাথেই রয়েছে।”
![যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজা।](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/25da/live/be5a6d30-b13e-11ee-a24d-5371dfbad329.jpg)
আদালত ইসরায়েলকে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করাতে পারবে?
দক্ষিণ আফ্রিকা চায় আইসিজে ইসরায়েলকে ‘অবিলম্বে গাজায় সামরিক অভিযান স্থগিত করতে নির্দেশ দিক’।
কিন্তু এটা অনেকটাই নিশ্চিত যে এমন কোনো নির্দেশ ইসরায়েল মেনে নিবে না এবং তাদের বাধ্যও করা যাবে না।
আদালতের নির্দেশ সংশ্লিষ্ট দুপক্ষের জন্য মান্য করার তাত্ত্বিক বাধ্যবাধকতা আছে কিন্তু বাস্তবে এটি প্রয়োগে বাধ্য করা যায় না।
২০২২ সালে আইসিজে রাশিয়াকে অবিলম্বে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান স্থগিত করতে বলেছিলো। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষিতই থেকে গেছে।
![গাজার সবচেয়ে বড় শহর খান ইউনিস শহরে হামলার দৃশ্য।](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/73c3/live/eefc87c0-b13e-11ee-a24d-5371dfbad329.jpg)
সিদ্ধান্ত কখন আসবে?
দক্ষিণ আফ্রিকার অনুরোধের প্রেক্ষিতে আইসিজে দ্রুতই ইসরায়েলকে সামরিক অভিযান স্থগিত করতে বলতে পারে।
তত্ত্বগতভাবে এটি ফিলিস্তিনিদের এমন কিছু থেকে সুরক্ষা দিবে যা পরে গণহত্যা বলে ঘোষিত হতে পারে।
কিন্তু ইসরায়েল গণহত্যা করছে কিনা সে বিষয়ে আদালতের একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
কেন দক্ষিণ আফ্রিকা মামলাটি আদালতে আনলো?
এর কারণ গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রচণ্ড সমালোচক দক্ষিণ আফ্রিকা।
দেশটির মতে জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে তাদের কিছু করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এছাড়া ক্ষমতায় থাকা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাবার দীর্ঘ ইতিহাস আছে।
তারা দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসিত সরকারের নানা জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাসের সঙ্গেই একে তুলনা করে।
তবে দেশটি সাতই অক্টোবরের হামলার নিন্দা করে জিম্মিদের মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছিলো।
“গাজার জনগণকে হত্যার বিরোধিতাই একটি দেশ হিসেবে আমাদের আইসিজেতে আসতে পরিচালিত করেছে,” বলেছেন প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা।
“বর্ণবাদ, বৈষম্য এবং রাষ্ট্র পরিচালিত সহিংসতার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জাতি হিসেবে আমরা নিশ্চিত যে আমরা ইতিহাসে সঠিক পাশেই থাকবো”।