ক্ষমতাবান কর্তা ব্যক্তিদের দুর্নীতির তথ্য কেন জানা যায় না

Spread the love

মুকিমুল আহসা,বিবিসি নিউজ বাংলা

বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক গঠন করা হলেও দুর্নীতি রোধে তা কতখানি কার্যকর সেটি এখন নানা আলোচনা চলছে। গণমাধ্যমে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি সামনে আসার পর দুদককে বেশ তৎপরতার দেখা যাচ্ছে।

তবে প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষমতাশালী বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা থাকেন তাদের বিরুদ্ধে দুদকের তেমন তৎপরতা কেন দেখা যায় না?

জবাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ব্যক্তিরা যখন দুর্নীতি করেন, তখন অনেকেই সরকারের প্রশ্রয়ে দুর্নীতি ও অপরাধ কর্মকাণ্ড করে থাকে বলেই দুদক এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে খুব একটা সাহস পায় না।

দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক, ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “তখন দুদকের মতো প্রতিষ্ঠান চাইলেও সেদিকে হাত দিতে পারতো না। কারণ তখন সেখানে হাত দিলে হাতই পুড়ে যেতো।”

দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কেউ দুদকে অভিযোগ না করলে কিংবা গণমাধ্যমে খবর না আসলে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না কে কোন পদে থেকে দুর্নীতি করছেন। যে কারণে আমরা উদ্যোগও নিতে পারি না”।

দুর্নীতি দমনে গত এক দশকে সারা বাংলাদেশে জনবল বেড়েছে। সেই সাথে যে আইন রয়েছে সেটিও যথেষ্ট বলে মনে করেন দুদকের সাবেক কর্মকর্তারা। তাদের মতে, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও সরকারের ইচ্ছার বাইরে দুদক কিছু করতে পারে না।

যে কারণে ক্ষমতা বা পদে থাকা অবস্থায় কেউ দুর্নীতি করলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়।

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মাঈদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ব্যক্তি পরিচয় বাদ দিয়ে সরকার এমন কোন বার্তা দেয় নি যে দুর্নীতিবাজ কেউ তাদের লোক না। সে কারণে দুদকও কোন ধরনের কোন ব্যবস্থা নেয় নি”।

সাবেক পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে দুদকের এই তৎপরতা হঠাৎ করে নিজ উদ্যোগে নেয়া হয়নি। একটি গণমাধ্যমে খবরের পর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে। উচ্চ আদালতেরও এ নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল।

যদিও সাবেক পুলিশ প্রধান তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তিনি একটি ভিডিও বার্তায় দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।

দুদকের মামলার আসামিদের সিংহভাগই মধ্যম ও নিম্নসারির কর্তকর্তা-কর্মচারী
ছবির ক্যাপশান,দুদকের মামলার আসামিদের সিংহভাগই মধ্যম ও নিম্নসারির কর্তকর্তা-কর্মচারী

ক্ষমতার অপব্যবহার চক্র

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে রাজনৈতিক দলটি। এসময় দলের বিভিন্ন পদে বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে থাকা অবস্থায় অনেকের রিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে।

এই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পদে বা এমপি পদে যারা রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তখন তারা ক্ষমতাকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। এরপর জড়িয়ে পড়েন নানা ধরনের অপকর্মে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক মি. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যারা ক্ষমতায় থেকে অপরাধ করেন অথবা ক্ষমতা ব্যবহার করে অপরাধ করেন তার পুরোটাই হয় সরকারের সাথে যোগসাজশে”।

তিনি মনে করেন, ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে অনিয়ম ও দুর্নীতি করার বিষয়টি পুরাটাই ক্ষমতার একটি অপব্যবহার চক্র। তারা একপাক্ষিকভাবে অনিময় দুর্নীতি করেন না। তারা সরকারকে বিভিন্ন ধরনের বাড়তি সুবিধাও দিয়ে থাকেন।

এখন থেকে আরো বছর দুয়েক আগে পুলিশ প্রধানের পদ অবসরে যান বেনজীর আহমেদ। এই দুই বছর তিনি অবসর জীবনে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই গণমাধ্যমে তার অঢেল সম্পত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

একইভাবে সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যে অভিযোগ যাচাই বাছাই করছে দুদক।

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মাঈদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যতই প্রভাবশালী হোক সরকার যদি বলতো দুর্নীতিবাজ কেউ আমার লোক না। দুদককে যদি সাহস দেয়া হত যে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তাহলে হয়তো দুর্নীতির এই চিত্র দেখতে হতো না।”

তিনি বলেন, এই ধরনের ব্যক্তিরা সরকারের সাথে ভাল যোগাযোগ রেখে পদ পদবীতে থাকেন। বিনিময় তারা বিভিন্ন দুর্নীতি ও অপকর্ম করেন। এটা সরকার ভালভাবেই জানেন। কিন্তু সরকারের সাথে এই সম্পর্কের কারণে গণমাধ্যম যেমন সহজে লেখার সাহস পান না। তেমনি দুদকও সাহস করে না ব্যবস্থা নেয়ার।

অভিযোগের বিষয়ে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে মি.আহমেদের আইনজীবী শাহ মঞ্জুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা এখন এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

লোক দেখানো তৎপরতা?

সাম্প্রতিক সময় বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় দুদকে ব্যাংক একাউন্ট তলব কিংবা সম্পদের অনুসন্ধানের বাইরে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে খুব বেশি পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি।

বরং পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়কে গুরুত্ব দেয়া হয় বলেও দুদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ওঠে।

সাবেক পুলিশ প্রধানের বাইরে কয়েকজন মধ্যম সারির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটি।

একসময় দুদকের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন মাঈদুল ইসলাম। তিনি উদাহরণ টানেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর।

তিনি বলেন, ”আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে মি. বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এতে হাইকোর্টের সম্মতিও ছিল।”

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় নি।

এসব ক্ষেত্রে কেন ব্যবস্থা নেয়া যায় না? কিংবা ব্যবস্থা নিলেও সেটি লোক দেখানো কী না এমন প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন সময়?

জবাবে দুদকের আইনজীবী মি. খান বলেন, “তারা যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের একটা প্রভাব থাকে। যে কারণে ক্ষমতায় থাকলে এইসব তথ্য পাওয়া যায় না। দুদকের কাছে তো সেই তথ্য আগে থেকে আসতে হবে। না আসলে দুদক কিসের ভিত্তিতে তদন্ত করবে”?

বিপদে পড়লে দায় নেয় না দল

গত এক দশকে দুটি জাতীয় নির্বাচনসহ সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়। এই নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা কিংবা সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ছিল।

সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ কিংবা সাবেক সেনা প্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও সরকারের সমর্থনে কাজ করা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক জোট কিংবা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে।

মানবাধিকার প্রশ্নে র‍্যাবের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে ঘটনার জের ধরে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আগেই মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। গত মাসে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় সাবেক সেনা প্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে।

সরকারে সাথে ঘনিষ্ঠ এই দুই সাবেক বাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরও তাদের পক্ষেই সমর্থন ছিল সরকারের।

সর্বশেষ পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের সম্পদ জব্দের পরই তার অসংখ্য দুর্নীতির খবর প্রকাশ পাচ্ছে। এমন অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কী তার দায় নেবে?

বুধবার সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোন ব্যক্তির দুর্নীতির দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার বিভিন্ন সময় নিজেদের ইমেজ উদ্ধারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিলেও তা ছিল আইওয়াশ।

বিশেষ করে কাসিনো কাণ্ডে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার নাম আসার পর তাদের কিছুদিন জেলে থাকলেও এখন সে সব মামলায় খুব বেশি অগ্রগতি নেই।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক মি. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী কারো বিরুদ্ধে দুদক এমন কোন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারেনি বললেই চলে। যাদেরকেও বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছিল, তা ছিল লোক দেখানো।

সাবেক আইজিপি মি. আহমেদ দায়িত্ব থাকা অবস্থায় সেগুলো নিয়ে কেন দুদক ব্যবস্থা নিলো না সেই প্রশ্ন যেমন উঠছে। তেমনি এটিও বলা হচ্ছে, এসব অভিযোগ সত্যি হলে সরকারি বাহিনীর পদ ব্যবহার করে কিভাবেই বা এত দুর্নীতির সাথে জড়ালেন এই কর্মকর্তা?

শুদ্ধাচার পুরস্কার বনাম দুর্নীতি

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততাসহ ১৮টি গুণাবলী বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময় এমন বেশ কয়েকজন ব্যক্তির এই পুরস্কার পাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন বেনজীর আহমেদ।

গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ২০২০-২১ সালে সততাসহ নানা গুণাবলীর কারণে রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরষ্কার পান সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ।

তবে দুদকের তথ্য বলছে, যে বছর মি. আহমেদ এই শুদ্ধাচার পুরস্কার পান ঐ বছরই তিনি ও তার পরিবার ৮৭ দশমিক ৯ একর জমি কিনেছিলেন।

সততার জন্য শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রাপ্ত একজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলার বিষয়টি কতটা স্বাভাবিক?

এমন প্রশ্নে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, তিনি অনিয়ম দুর্নীতি অনাচারসহ মানুষের অধিকার হরণের বিষয়গুলো ধামাচাপা দেয়ার জন্যই এই পুরস্কার নিজে থেকে গ্রহণ করেছেন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”এই পুরস্কার যে তিনি পাবেন এই সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিয়েছেন। পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত একটা ভাল কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।”

চাকরিতে থাকাকালে পুলিশের বেশ কিছু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারও পেয়েছেন। পাঁচবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) লাভ করেন তিনি।

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মি. ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মতো অভিযোগ ওঠে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়েযদি শুদ্ধাচারের পুরস্কার দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়, তখন অন্য দুর্নীতিবাজরা উৎসাহ পায়।

বেনজির আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চললেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক মামলা হয়নি।

তবে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনে মি. আহমেদের সম্পত্তি যখন আদালতের নির্দেশে জব্দ করা হয়েছে তখন এক ধরনের গুঞ্জন উঠেছে তিনি গোপনে দেশ ছেড়েছেন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু জানেনা বলে জানানো হয়েছে।

তবে, এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৯শে এপ্রিল নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, তিলকে তাল বানিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে। যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যাচার।

সেখানে তিনি দাবি করেছে তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ মিথ্যা। অবসরের পরে তাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণের চেষ্টা ‘হতাশাজনক ও দুঃখজনক’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।


Spread the love

Leave a Reply