জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সংলাপ নিয়ে যে অবস্থানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু বলেছেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান।

মঙ্গলবার ঢাকায় ১৪-দলীয় জোটের একটি সমাবেশে তিনি এই মন্তব্য করার পর থেকেই দেশ জুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে যে, এটি কি দলীয়, নাকি তার ব্যক্তিগত মন্তব্য।

নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিরোধী দল বিএনপি বহুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এই সংকট নিরসনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতার বিষয়ে কোন পক্ষ থেকেই এর আগে কিছু বলা হয়নি।

যদিও ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তাতে কোন সমাধান আসেনি।

রাজনৈতিক সংকটে মধ্যস্থতার জন্য আবার জাতিসংঘের দূত আসবে কিনা, আমির হোসেন আমুর ওই বক্তব্যের পর এ নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।

কি বলেছেন আমির হোসেন আমু?

মঙ্গলবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ১৪ দলের একটি সমাবেশ হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘’জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি আসুক। আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে দেখতে চাই, কোথায় সমস্যা, সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা কোথায় এবং কীভাবে সেটা নিরসন করা যায়। এটা আলোচনার মধ্য দিয়েই সুরাহা হতে পারে, অন্য কোন পথে নয়।‘’

বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে এই মন্তব্যের বিস্তারিত জানতে আমির হোসেন আমুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন ইস্যুতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কোন আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে কিনা, এটি জানতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কেউ এরকম কোন আলোচনার তথ্য জানাতে পারেননি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নির্বাচন নিয়ে কোন আলাপ আলোচনার বিষয়ে আওয়ামী লীগের ভেতর কোন ধরনের আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতি বা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে, এখানে এমন কোন সংকট বা এমন কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে, জাতিসংঘের মধ্যস্থতা করতে হবে। আমাদের দলের ভেতরে-বাইরে অনেক সময় অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়, কথাবার্তা হয়। কিন্তু আমার জানা মতে, জাতিসংঘের মধ্যস্থতা করার মতো কোন বিষয়ে কোন কথা কোথাও হয়নি।

কেন আমির হোসেন আমু ওই বক্তব্য দিয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা আমার জানা নেই। হয়তো তার ব্যক্তিগত বক্তব্য হতে পারে, কিন্তু দলে এরকম কোন আলোচনা নেই।

বুধবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে সাংবাদিকরা এই প্রশ্ন করলেও তিনিও বলেছেন, ‘’ আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করব, এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করব, বিগত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী সংলাপের আহ্বান করেছিলেন। জাতিসংঘ কেন মধ্যস্থতা করতে যাবে? আমাদের দেশে এমন কোনও রাজনৈতিক সংকট হয়নি যে জাতিসংঘকে এখানে ইন্টারফেয়ার করতে হবে। জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করবে এই রকম কোনও সংকট স্বাধীন বাংলাদেশ হয়নি।‘’

তিনি বলেছেন, ‘’আমার মনে হয় আমাদের গণতন্ত্র এখন অনেক পরিপূর্ণ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ধারা এগিয়ে চলছে। কাজেই এখানে বাইরের কোনও মধ্যস্থতা, বাইরের কোনও হস্তক্ষেপ তো দরকার নাই। আমাদের নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করব। সময় বলে দেবে কখন কী হবে। আপাতত আলাপ-আলোচনার কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।‘’

আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে যে, আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই হবে। সেই সময় নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। সেই সরকার কেমন হতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

বিএনপির কী প্রতিক্রিয়া?

আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতার মুখ থেকে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সংলাপের বক্তব্য এলেও এই বিষয়ে এখনি কোন মন্তব্য করতে চান না বিএনপি নেতারা।

দলটি গত কয়েক বছর ধরে নিদর্লীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এরকম কোন বিষয় নিয়ে তো আমরা এখন ভাবছি না। আমাদের একটাই দাবি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, সেটার জন্যই আমরা আন্দোলন করছি।

“আর আমির হোসেন আমু সাহেব যে কথা বলেছেন, সেটা তার নিজের ব্যক্তিগত বক্তব্য নাকি দলের বক্তব্য, তাতো আমরা এখনো জানি না। কোন আলোচনা করতে হলে সুনির্দিষ্ট এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব ছাড়া আমি এরকম বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।‘’

বিএনপির নেতারা বলছেন, সংকট সমাধানে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রস্তাব পেলে তারা দলের বৈঠকে আলোচনা করে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে যেকোনো ধরনের আলোচনা হতে হবে অবশ্যই নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে।

কেন এ নিয়ে এতো আলোচনা?

দু’হাজার চৌদ্দ সালের পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্রিক অচলাবস্থা কাটাতে ঢাকায় তিন দফায় এসেছিলেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।

প্রথমবার তিনি ঢাকায় আসেন ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। এরপর ২০১৩ সালের মে মাসে এবং ডিসেম্বর মাসে আবার ঢাকায় আসেন। শেষ সফরে ছয়দিনে তারানকো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামের প্রতিনিধি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নাগরিক সমাজ, ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের সাথে মোট ২৫টি বৈঠকে অংশ নেন।

পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ডিসেম্বর মাসে ঢাকা ছাড়ার সময় তারানকো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাঁর এই সফরের লক্ষ্য ছিল উভয় দলকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা।

‘’আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এ দেশের রাজনীতিবিদদের। সমাধানটাও খুঁজে নিতে হবে তাঁদের,’’ তিনি বলেছিলেন।

দশই ডিসেম্বর ২০১৩ সালে মি. ফার্নান্দেজ-তারানকোর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দুটি প্রতিনিধি দল আলোচনায় বসে।

বৈঠক শেষে জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল বা দুই রাজনৈতিক দলের কেউই সাংবাদিকদের কাছে মুখ খোলেন নি তবে বিবিসিকে বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকএক শীর্ষ নেতা জানান, তাঁরা একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার ওপর জোর দিয়েছেন এবং এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে পদ ছেড়ে দেওয়ার দাবিও জানানো হয়েছে।

পাশাপাশি জাতিসংঘের নিবিড় তত্ত্বাবধানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে মিঃ ফার্নান্দেজ-তারানকো প্রস্তাবেও তারা রাজি।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে জানান, ছাড় দিতে সরকার সবসময়ই প্রস্তুত ছিল। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মত স্পর্শকাতর দফতর ছেড়ে দেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করার বিএনপির দাবি তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না।

সেই সময় বিএনপির নাম প্রকাশে একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছিল, জাতিসংঘ বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে। তাতে শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। কিন্তু নির্বাচনে যাতে সব দলের জন্য সমান সুযোগ বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা যায় সেজন্য জাতিসংঘ নানা রকম সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে।

এর একটি হচ্ছে জাতিসংঘের একটি বড় পর্যবেক্ষক দলের উপস্থিতিতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠান, যাতে করে নির্বাচনে কোন ধরণের পক্ষপাতিত্ব বা সরকারি প্রভাব খাটানোর চেষ্টা রোধ করা যায়।

বিএনপির সূত্রটি জানায়, জাতিসংঘের এই কথিত ফর্মুলা নিয়ে আলোচনায় অনাগ্রহ দেখায়নি দলটি।

সেই সময় ঢাকায় কূটনীতিকদের সাথে বৈঠকে তারানকো বলেছিলেন, ‘’অনেক চেষ্টার পর দুই দলকে আলোচনার টেবিলে বসানো গেছে, কিন্তু দুই পক্ষ নিজেদের অবস্থানে এতোটা অনড় যে, আলোচনার সাফল্য নিয়ে সংশয় রয়েছে।‘’

মি. তারানকো চলে যাওয়ার পরে আর সেসব আলোচনার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।

বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে একতরফা সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, এখনকার পরিস্থিতি জাতিসংঘের আবার বিশেষ দূতের আলোচনায় আসার মতো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।

”এগুলো আসলে বিরোধী দলকে বিভ্রান্ত করতে নানারকম বার্তা দেয়া হচ্ছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো, বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে। তারা চায়, বিএনপি ছাড়া সব দলকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে। সেখানে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আসলে তো তেমন কিছু হয় না। জাতিসংঘ তো ২০১৪ নির্বাচনের আগেও মধ্যস্থতা করেছে, তাতে কি কোন পরিবর্তন এসেছিল?” তিনি প্রশ্ন করেন।


Spread the love

Leave a Reply