জিম্মি মুক্তির ঘটনায় ইসরায়েলি পরিবারে স্বস্তি, ফিলিস্তিনে উৎসব
ডেস্ক রিপোর্টঃ হামাসের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া ১৩ ইসরায়েলি জিম্মির পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বস্তির কথা জানিয়েছেন। মুক্তি পাওয়া এই দলটিকে রেডক্রসের ব্যবস্থাপনার গাজা থেকে মিশরে নেয়ার পর এখন ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
তাদের মুক্তির পরপরই পশ্চিম তীরের বেইতুনিয়া চেকপয়েন্ট এলাকায় মুক্তি দেয়া হয়েছে ৩৯ ফিলিস্তিনি বন্দীকে, যাদের মধ্যে ১৫ জন কিশোর রয়েছে।
এছাড়া কাতারের মধ্যস্থতায় কার্যকর হওয়া চুক্তির আওতায় আরও দশ থাই নাগরিক ও একজন ফিলিপিনোকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। কাতার চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মোট ৫০ জন ইসরায়েলি জিম্মি ও ১৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দী চারদিনের যুদ্ধবিরতির মধ্যে মুক্তি পাওয়ার কথা।
শুক্রবার হামাস যেসব জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে তাদের ইসরায়েলে ফিরিয়ে নেয়ার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মিশরের একটি হাসপাতালে নেয়া হয়।
এর মধ্যে দুই, চার, ছয় ও নয় বছর বয়সের-মোট চারটি শিশুর পাশাপাশি ৮৫ বছর বয়সী এক নারীও আছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “আমরা আমাদের প্রথম দফার জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। শিশু ও তাদের মায়েরা এবং অন্য নারী। তারা প্রত্যেকেই আমাদের কাছে একেকটি বিশ্ব”।
“আমি সব পরিবার এবং ইসরায়েলের নাগরিকদের কাছে জোর দিয়ে বলছি: আমরা সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর”।
![ড্যানিয়েল আলোনি ও তার মেয়ে এমিলিয়াকে শুক্রবার রাতে ছেড়ে দিয়েছে হামাস](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/4887/live/425992d0-8b5d-11ee-b19e-c3ebec355472.jpg)
স্বজনদের প্রতিক্রিয়া
ইওনি আশারের স্ত্রী ৩৪ বছর বয়সী ডরন কাৎয আশার এবং তাদের দুই কন্যা- চার বছরের রাজ এবং দু বছরের আভিভ জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
“আমি আমাদের পরিবারকে দুঃসহ মানসিক অবস্থা ও শোকার্ত একটি পরিস্থিতি থেকে বের করে নিয়ে আসতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম,” বিবিসিকে বলছিলেন মি. আশার।
“আমরা আনন্দ উদযাপন করবো না। অপহরণ যাদের করা হয়েছে তাদের শেষ ব্যক্তিটি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা কোন উদযাপন করবো না”।
“অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার কোন পোস্টার বা শ্লোগান নয়। তারা সত্যিকার মানুষ। এই পরিবারগুলো আমার নতুন পরিবার। শেষ ব্যক্তির ঘরে ফিরে আসার জন্য আমরা যা দরকার তাই করবো”।
৭৮ বছর বয়সী ক্যান্সার থেকে সেরে ওঠা মার্গালিট মোসেজ কিবুৎয থেকে গত সাতই অক্টোবর অপহৃত হয়েছিলেন।
চুক্তির আওতায় আরও মুক্তি পেয়েছেন ড্যানিয়েল আলোনি ও তার ছয় বছরের কন্যা এমিলিয়া। তারা কিবুৎযে পরিবারের কাছে বেড়াতে এসেছিলেন।
হামলার সময় ড্যানিয়েল পরিবারের সদস্যদের কাছে শেষ বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন ‘বাড়িতে সন্ত্রাসীরা এসেছে’। তিনি আর বাঁচবেন কি-না তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত ছিলেন।
![ফিলিস্তিনি বন্দীদের স্বাগত জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসে বহু মানুষ](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/15e8/live/adea0ac0-8b5d-11ee-b19e-c3ebec355472.jpg)
ইতায় রাভির ৭৮ বছর বয়সী কাজিন আব্রাহাম এখনো জিম্মি অবস্থায়। পরিবারের তিন জন মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বলেছেন ‘খুশী হওয়ার পথে এটা একধাপ অগ্রগতি’। ওই তিনজন নির ওয এলাকা থেকে অপহৃত হয়েছিলেন। এর মধ্যে নয় বছর বয়সী ওহাদও আছে।
“তারা এখন ইসরায়েলের হাসপাতাল, পরিবারের কাছে আসার পথে। এটা দারুণ ব্যাপার। তবে আমরা এখনো পুরোপুরি খুশী হতে পারছি না,” বিবিসি নিউজনাইটে বলেছেন তিনি।
ওহাদের যেদিন নয় বছর পূর্ণ হলো সেদিন সে গাজায় জিম্মি অবস্থায়।
“আমরা বড় করে তার জন্মদিন উদযাপন করবো নতুন এক বাস্তবতায়। আমি জানিনা সন্ত্রাসী সংগঠনের হাতে ৫০দিন আটক থাকার পর কিভাবে নয় বছরের শিশুটি ফিরে আসছে। আশা করি সে ভালো আছে”।
ওদিকে থাই ও ফিলিপিনো যারা মুক্তি পেয়েছে তাদের পরিবারেও স্বস্তি ফিরে এসেছে। ২৮ বছর বয়সী থাই জিম্মি উইচাই কালাপাতের বান্ধবী এই কদিনে কী অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন তার আবেগময় বর্ণনা দিয়েছেন।
প্রথমে কর্মকর্তারা তাকে জানিয়েছিলেন যে উইচাই মারা গেছেন। কিন্তু মৃতদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে তার নাম ছিলো না। পাঁচদিন আগে তাকে জানানো হয় যে থাই জিম্মিদের তালিকায় তিনি আছেন।
ফিলিপিন্সের নাগরিক ৩৩ বছর বয়সী গেলেইনর (জিমি) পাচেকো কিবুৎযের নির ওয থেকেই সাত অক্টোবরে অপহৃত হয়েছিলেন। তিনি যার বাড়িতে কাজ করতেন তিনি হামাসের হামলায় নিহত হয়েছিলেন।
![হামাস যাদের মুক্তি দিয়েছে তাদের হেলিকপ্টারে করে তেল আবিবের একটি মেডিকেল সেন্টারে আনা হয়েছে।](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/0fa2/live/12e861b0-8b5e-11ee-b19e-c3ebec355472.jpg)
৩৯ ফিলিস্তিনির মুক্তি,উৎসবে স্বাগত
ওদিকে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ৩৯ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। পাথর ছোঁড়া থেকে শুরু করে হত্যা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিলো।
২৪ নারী ও ১৫ কিশোরকে বেইতুনিয়া চেকপয়েন্টের কাছে নিয়ে ছেড়ে দেয়ার পর বিপুল সংখ্যক মানুষ উল্লাস করে তাদের শুভেচ্ছা জানায়।
এর মধ্যে ২০১৫ সালে ১৬ বছর বয়সে আটক হওয়া মারাহ বাকিরও আছেন। সীমান্তে পুলিশ কর্মকর্তার ওপর ছুঁড়ি-হামলার দায়ে তার সাড়ে আট বছরের জেল দেয়া হয়েছিলো।
অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বাকির বলেছেন, “বহু মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই চুক্তি হয়েছে, যা তাদের কাছে অস্বস্তিকর এবং এটি তাদের খুশী করেনি”।
তিনি জানান আটক থাকার সময় বাইরের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিলো না এবং গাজার পরিস্থিতি সম্পর্কেও তার কোন ধারণা নেই। “চুক্তির খবরটি ছিলো অবাক করে দেয়ার মতো বিষয়,” বলছিলেন তিনি।
হামাসের দেয়া তিনশ নারী ও শিশুর একটি তালিকা থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের নাম চূড়ান্ত করেছে ইসরায়েল। ওই তালিকার এক চতুর্থাংশেরও কম ব্যক্তির সাজা দেয়া হয়েছিলো। বাকীরা বিভিন্ন অভিযোগে রিমান্ডে বিচারের অপেক্ষায় ।
তবে ওই তালিকার ৪০ ভাগেরই বয়স ১৮ বছরের কম। এছাড়া একজন কিশোরী ও ৩২ জন নারী আছে।
রামাল্লাহর কাছে বেইতুনিয়া চেকপয়েন্টের রাস্তায় ইসরায়েলের সেনাদের সামনে পড়েছিলো একদল ফিলিস্তিনি মানুষ। সেনারা রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তাদের পেছনে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো।
![পতাকা হাতে সামনের তরুণও মুক্তি প্রাপ্তদের একজন।](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/87ff/live/56218c90-8b5e-11ee-b19e-c3ebec355472.jpg)
তরুণদের কেউ কেউ ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছিলো ও টিয়ারশেল গুলো পাল্টা নিক্ষেপের চেষ্টা করছিলো।
“ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখা ও হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়ার যে প্রত্যাশা তার একটি লক্ষণ এটি,” বলছিলেন মোহাম্মেদ খাতিব নামের এক ব্যক্তি।
মুক্তি পাওয়া বন্দীদের নিয়ে বাস যখন তাদের কাছে এসে পৌঁছায় তখন সেখানে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। জানালা দিয়ে দেখা যায় যে কয়েকজন বন্দী নাচছেন। একজন ফিলিস্তিনের পতাকা গায়ে জড়িয়ে রেখেছিলেন।
শ্লোগানে মুখরিত মানুষের মুখে ছিলো ‘আল্লাহ মহান’ ধ্বনি।
অল্প কয়েকজন হামাসের পতাকা নাড়াচ্ছিলেন। তবে অন্যরা ফিলিস্তিনি ঐক্যের কথা বলেছেন। পুরো বিষয়টা ছিলো ‘যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে বিজয়ের একটি মূহুর্ত’।
তবে ইসরায়েলের কাছে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিরা নিরাপত্তা হুমকি। আর ফিলিস্তিনিদের কাছে তারা ইসরায়েলি দখলদারিত্বের শিকার। তাদের মুক্তি একটি প্রতীক।
গত সাতই অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে অন্তত ১২শ জন মারা যায় এবং জিম্মি করা হয় দুশোর বেশি মানুষকে। এর পর বিনা অভিযোগে ফিলিস্তিনের আটকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে ছয় হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে ইসরায়েল, যারা বিচারের অপেক্ষায় আছেন।
অন্যদিকে চার দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী যে কোন জায়গাতেই ত্রাণ সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার থাকার কথা। তবে বাস্তুচ্যুত যেসব মানুষ গাজার দক্ষিণে অবস্থান করছে তাদের বাড়ি ফেরার চেষ্টা না করতে বলেছে ইসরায়েল। তারা বলছে, “উত্তরাঞ্চল এখন যুদ্ধ ক্ষেত্র”। অবশ্য এখনো বহু বেসামরিক নাগরিক সেখানে অবস্থান করছে।