টাইটান সাব ও গ্রিসের অভিবাসী নৌকা: জীবনের মূল্য কোথায় বেশি?
ডেস্ক রিপোর্টঃ বিশ্বজুড়ে শত শত কোটি মানুষ পর্যটক-বাহী সাবমার্সিবল বা ডুবোযান টাইটানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং তার করুণ পরিণতির খবর গভীর আগ্রহের সাথে পড়েছেন বা দেখেছেন। পাঁচজন যাত্রী নিয়ে সাবমেরিনটি গিয়েছিল বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য।
টাইটান ডুবোজাহাজে এই অভিযানের সামিল হতে যেসব যাত্রী প্রত্যেকে আড়াই লাখ ডলার করে দিয়েছিলেন তাদের ছবি বিশ্বজুড়ে শেয়ার করা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড এই উদ্ধার অভিযানের যেসব আপডেট জানিয়েছে তার প্রতি মানুষের ছিল চরম আগ্রহ। এবং খবরের লাইভ নিউজ পেজে ছিল বিশাল ট্রাফিক। আগে এনিয়ে যেসব সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে তাতে দেখানো হয়েছে ওশানগেট কোম্পানির ছোট সাবমার্সিবলটির ভেতরটা দেখতে কেমন ছিল। সব আন্তর্জাতিক মিডিয়া খবরটি কাভার করেছে।
“সাগরে হারিয়ে যাওয়া”র ওপর অন্যান্য যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে তার চেয়ে এই ঘটনাটি কেন বেশি চমকপ্রদ?
ইসলামাবাদে বিবিসির উর্দু বিভাগের প্রতিবেদক সাহের বালোচ এই বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব কথোপকথন দেখেছেন, তা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন।
নিখোঁজ সাবমার্সিবলের বিশদ বিবরণ যখন বের হতে শুরু করলো তখন পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ইউজাররা ঠিকই লক্ষ্য করলেন যে সাগর-সম্পর্কিত আরেকটি খবরের তুলনায় সংবাদমাধ্যমগুলো সাবমার্সিবল দুর্ঘটনার খবরটিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়েছে।
অন্য খবরটিতে, আনুমানিক ৭০০ জন অভিবাসীকে নিয়ে মাছ ধরার একটি নৌকা গত ১৪ই জুন দক্ষিণ গ্রিসে ডুবে যায়। এটি ছিল ইউরোপের সবচেয়ে শোচনীয় অভিবাসী বিপর্যয়ের ঘটনা।
ঐ ঘটনায় যারা প্রাণে বেঁচেছেন তারা জানিয়েছেন যে ১০০টিরও বেশি শিশু ছিল ঐ নৌকায় এবং অন্তত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর তখনই নিশ্চিত করা হয়েছিল।
তখনও সাগরে নিখোঁজ ছিল শত শত অভিবাসী।
গ্রিক কোস্ট গার্ড দাবি করেছিল যে নৌকাটি ইতালির পথে যাত্রা করেছিল এবং সেটি এমন কোন বিপদে পড়েনি যার জন্য তাকে উদ্ধার করতে হতো। তবে ঘটনার এই বিবরণ নিয়ে যে একটা সন্দেহ রয়েছে, বিবিসি তার প্রমাণ পেয়েছে।
ঐ এলাকার অন্যান্য জাহাজের গতিবিধি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অভিবাসী বোঝাই মাছ ধরার নৌকাটি ডুবে যাওয়ার আগে অন্তত সাত ঘণ্টা ধরে নড়াচড়া করতে পারেনি। বিবিসির অনুসন্ধানের এই ফলাফল নিয়ে গ্রিক কর্তৃপক্ষ এখনও কোন মন্তব্য করেনি।
![ডুবে যাওয়ার আগে অভিবাসী বোঝাই ঐ জাহাজের ছবি প্রকাশ করেছিল গ্রিক কোস্ট গার্ড](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/3302/live/92613800-111e-11ee-816c-eb33efffe2a0.jpg)
পাকিস্তানের সিনেটের চেয়ারম্যান এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই ঘটনায় ৩০০ জন পাকিস্তানি নাগরিক ডুবে মারা গেছে, এবং এটি দেশে এখন একটি বড় আলোচনার বিষয়।
অন্যদিকে, পাঁচজন যাত্রী নিয়ে ডুবোযান টাইটান রওনা দেয়ার এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে সাহায্যকারী জাহাজের সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মার্কিন উপকূল রক্ষীরা জানিয়েছে যে আট ঘণ্টা পর ঐ ঘটনা সম্পর্কে প্রথম তাদের জানানো হয়। এবং এরপর শুরু হয় এক বিশাল উদ্ধার অভিযান, যাতে কেবল মার্কিন কর্তৃপক্ষই নয়, ক্যানাডিয়ান এবং ফরাসিরাও জড়িত হয়ে পড়ে।
নিখোঁজ সাবমার্সিবলকে খুঁজে বের করার অভিযানের মধ্যেই দুটি ঘটনা নিয়েই সোশাল মিডিয়ায় নানা ধরনের মন্তব্য এবং মতামত ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ মতামতই ছিল ঐ দুটি খবরকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তার পার্থক্যের ওপর।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক ফারাহ জিয়ার মতে, সাবমার্সিবল দুর্ঘটনার খবরটির শিরোনাম যে বড় হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “সারা বিশ্বে কোন ধনী ব্যক্তির জীবনে যখন কোন ট্র্যাজেডি ঘটে, তখন তাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ, মানুষ তার জীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয় বেশি। তাই স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়া বেশি করে তাদের খবর কাভার করে।”
তবে তিনি মনে করেন যে এই বিতর্কটি বিশ্ব মিডিয়ার জন্য “আত্ম-মূল্যায়ন করার” একটি সময়োপযোগী সুযোগ তৈরি করেছে।
কিন্তু এই দুটি ঘটনার খবর প্রচারের বৈষম্য নিয়ে অন্যান্য ভাষ্যকাররা সমালোচনা করছেন বেশি।
টুইটারের একজন ইউজার মরিয়ম লিখেছেন, “আন্তর্জাতিক উদ্ধার অভিযান এবং ধনী পর্যটকদের নিয়ে সাবমেরিন অভিযানের প্রেস কভারেজ এবং ডুবে যাওয়া নৌকায় দারিদ্র্যপীড়িত অভিবাসীদের জন্য মিডিয়ার আগ্রহের অভাবই আপনাকে বলে দেবে যে আমরা কোন দুনিয়ায় বাস করছি।”
কিন্তু ভাষ্যকার ও সাংবাদিক জারার খুহরোর কথা ভিন্ন।
“আমি মনে করি যে কোনও ট্র্যাজেডির পর মানবতার সেরা এবং চরম খারাপ দিকটি আপনি একই সাথে দেখতে পাবেন,” বলছেন তিনি।
গ্রিসের উপকূলে অভিবাসী বহনকারী নৌকার ডুবে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন: “আমরা যেমন একদিকে গ্রিক কোস্ট গার্ডের নিন্দনীয় আচরণ দেখতে পাচ্ছি। অন্যদিকে একই সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি এথেন্সের রাস্তায় কয়েক হাজার মানুষ প্রতিবাদ করছেন। সম্ভবত, এই প্রথমবারের মতো অভিবাসীদের প্রাণহানির নিন্দা জানাতে আমরা এত বড় বিক্ষোভ দেখতে পেলাম।”
এমন খবরও জানা যায় যে অভিবাসীদের বিপদ সঙ্কেত দেখতে পেয়ে ভূমধ্যসাগরে একটি বিলাসবহুল ‘সুপার-ইয়ট’ তাদের সাহায্যে ছুটে এসেছিল।
![সুলেমান দাউদ (১৯) ও তার বাবা শাহজাদা দাউদ, দু'জনেই টাইটান ডুবোযান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/8c13/live/c7b89d40-111e-11ee-816c-eb33efffe2a0.png)
টাইটান সাব ট্র্যাজেডি সম্পর্কে যা জানা যায়:
- ওশানগেট কোম্পানির পরিচালিত সাবমার্সিবল টাইটান পাঁচজন যাত্রী বহন করতে পারে। “বাণিজ্যিক এবং গবেষণা”র উদ্দেশ্যে তারা টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষে ভ্রমণের আয়োজন করে।
- টাইটান ডুবোযানে ছিলেন ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী, একজন ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ব্যবসায়ী এবং তার ১৯-বছর বয়সী ছেলে, “মি. টাইটানিক” নামে পরিচিত একজন ফরাসি অভিযাত্রী এবং একজন ব্রিটিশ বিলিয়নেয়ার।
- আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপের জায়গায় সফর করতে টিকেটের দাম ২,৫০,০০০ মার্কিন ডলার।
- ১৮ই জুন টাইটান সাগরে নামার কিছু সময় পর মাদারশিপের সাথে টাইটানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
- ২১শে জুন মার্কিন কোস্ট গার্ড টুইট করে জানায় যে একটি ক্যানাডিয়ান অনুসন্ধানী বিমান পানির নিচ থেকে পাওয়া শব্দ শনাক্ত করেছে এবং দূর-নিয়ন্ত্রিত একটি ডুবোযান দিয়ে সেটা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
- ২২শে জুন টাইটানিক ধ্বংসাবশেষের কাছে একটি অনুসন্ধানী ডুবোযান টাইটানের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে। টাইটানিক জাহাজ থেকে সেটি ১,৬০০ ফুট (৪৮৮ মিটার) দূরে পড়ে ছিল। বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, পানির প্রবল চাপে টাইটান ধ্বংস হয়েছে।
- ওশানগেট এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করে যে কোম্পানির সিইও স্টকটন রাশ, শাহজাদা দাউদ এবং তার ছেলে সুলেমান, হেমিশ হার্ডিং এবং পল-আঁরি নারজিওলেট ঐ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা চলছে, সংবাদমাধ্যমের খবরে কীভাবে এই দুটি ঘটনায় সুস্পষ্টভাবে শ্রেণি বিভেদ প্রকাশিত হয়েছে। তবুও তাদের আলোচনায় ঘুরে ফিরে এসেছে মানুষের জীবনের মূল্যের দিকটি।
যেমন, একজন ভাষ্যকার টুইটারে লিখেছেন: “সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা হলেও এই দুটি ট্র্যাজেডি আসলে একই রকম।”
জারার খুরহো বলছেন: “মনে হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকেরা ডুবোযানে থাকা একটি ১৯-বছর বয়সী তরুণের মৃত্যু কামনা করছে। কিন্তু কেন? শুধু তার বাবা ধনী, সেই কারণে? কয়েক প্রজন্ম ধরে এই দাউদ পরিবার যত মানুষকে সাহায্য করেছে, এই লোকেরা সম্মিলিতভাবে তার এক শতাংশও করতে পারবে না।”
তিনি বলছেন, এখনকার দুনিয়া কোন আদর্শ জায়গা নয়: “উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, যখন ফ্রান্সের নটরডেম গির্জায় আগুন লেগেছিল, তখন তার সংস্কারের জন্য ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সারা বিশ্ব তহবিল জোগাড় করা হয়েছিল। কোন উন্নয়নশীল দেশে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত করে, তখন কি এভাবে সাহায্য করা হয়? জবাব হচ্ছে, না। এটা শুনতে আমাদের খারাপ লাগছে? জবাব হচ্ছে, অবশ্যই। তাহলে এটা কি বদলে ফেলা যাবে? জবাব হচ্ছে, না।”