পুরুষ যখন বাবা হন তখন তার শরীর ও মস্তিষ্কে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে
“একমাত্র যে শারীরিক পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করেছি সেটা হচ্ছে আমার ওজন বেড়ে গিয়েছিল। আমার শরীর হয়ে উঠছিল একজন পিতার শরীর,” বলেন ছ’মাস বয়সী এক শিশু সন্তানের পিতা টম।
কিন্তু না, পিতা হলে যে শুধু পুরুষের ওজন কয়েক কেজি বেড়ে যায় তা নয়। এর বাইরেও আরো কিছু পরিবর্তন ঘটে।
“মা ও বাবা- তারা দুজনেই শারীরিকভাবে শিশুর পিতামাতা,” বলেন ড. আন্না মাশিন, যিনি পিতৃত্বের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বইটির নাম: ‘পিতার জীবন: একজন আধুনিক পিতা হয়ে ওঠা।’
“পিতৃত্বের বিষয়ে এই উপলব্ধি নতুন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- অতীতে আমরা মনে করতাম যে শুধু নারীরাই শারীরিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়, কিন্তু আসলে সন্তানধারণ ও শিশুর জন্মদানের মতো বিষয়ে পুরুষের মধ্যেও একই ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে,” বলেন তিনি।
এটা ঠিক যে একজন পুরুষ নারীদের মতো ন’মাস ধরে তার পেটে সন্তানকে বড় করে না, তিনি সন্তান প্রসবও করেন না এবং সন্তানের জন্য তার দেহে দুধও উৎপন্ন হয় না।
কিন্তু তারাও একই ধরনের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয় যা বাইরে থেকে খালি চোখে দেখা যায় না।
“বড় ধরনের দুটো পরিবর্তন ঘটে। আপনি যখন প্রথমবারের মতো পিতা হবেন তখন আপনার দেহের হরমোন ও মস্তিষ্কে কিছু পরিবর্তন ঘটবে,” ড. আন্না ব্যাখ্যা করেন।
হরমোনজনিত প্রভাব
হরমোনজনিত সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন ঘটে সেটি হচ্ছে টেস্টোস্টেরন হরমোনের নিঃসরণ কমে যাওয়া। এটি পুরুষের সেক্স হরমোন।
“সন্তান উৎপাদনের জন্য যৌনমিলনের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। কারণ এই হরমোন আপনাকে সঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যাপারে আপনাকে সক্রিয় ও উৎসাহিত করে তোলে,” বলেন আন্না।
কিন্তু আপনি যখন পিতা হয়ে যান তখন এই টেস্টোস্টেরন নিঃসরণের মাত্রা কমে গিয়ে পিতা হিসেবে নতুন ভূমিকা পালনের জন্য আপনার দেহকে প্রস্তুত করে তোলে।
“যেসব পুরুষের দেহে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কম থাকে তারা তাদের সন্তানের প্রতি অনেক বেশি স্পর্শকাতর ও সহানুভূতিশীল হয়। এর ফলে তারা তাদের সন্তানদের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়।”
“একজন শিশু যখন কাঁদতে শুরু করে, যেসব পুরুষের শরীরে উচ্চমাত্রা টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসৃত হয় তারা এতে বিরক্ত হয়, কিন্তু যাদের দেহে টেস্টোস্টেরণ কম থাকে তারা সন্তানের কান্নায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।”
![মার্ক ও তার সন্তান আলবার্ট](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/8f4b/live/3024d430-0dd1-11ee-9e94-25f17ea6acca.jpg)
মার্ক নামের একজন পিতা, যিনি সম্প্রতি প্রথমবারের মতো পিতা হয়েছেন, তিনি বলেন, “পিতা হওয়ার আগে আমার এক ছোট্ট ভাতিজা কাঁদতে শুরু করলে আমি ভাবতাম কেউ এসে ওকে সামলাতে পারবে কি না। কিন্তু যেই মূহুর্তে আমি নিজে পিতা হয়ে গেলাম, আমার সন্তান কাঁদতে থাকলে তাকে সামলানোর জন্য আমি নিজে কিছু করতে উদ্যোগী হয়ে উঠলাম।”
টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে পিতারা অনেক বেশি ধৈর্যশীল হয়ে ওঠে, যা একটি শিশুর জন্য বেশ সহায়ক।
“আমি এখন আর হতাশ হই না। সেদিন আমি গাড়িতে ছিলাম। আরেকজন একটা কাজ করছিল কিন্তু সেই কাজটা করতে তার অনেক সময় লাগছিল। কিন্তু আমি বেশ শান্ত ছিলম, ভেবেছিলাম ‘যাই হোক’। এধরনের বিষয় আমরা কাছে এখন আর খুব বড় কোনো বিষয় নয়,” বলেন মার্ক।
টেস্টোস্টেরনের নিঃসরণ কমে যাওয়ার ফলে পিতার সঙ্গে তার সন্তানের সম্পর্কের ওপরেও এর একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।
“টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেশি হলে সেটা অক্সিটোসিন এবং ডোপামিনের ইতিবাচক প্রভাবকে আটকে দেয়,” বলেন আন্না।
শিশু সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে এই দুটো রাসায়নিক পদার্থ পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
আপনি যখন শিশু সন্তানকে জড়িয়ে ধরেন এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশা করেন অথবা কথাবার্তা বলেন তখন এই অক্সিটোসিন এবং ডোপামিন উৎপন্ন হয় যা আপনাকে চাঙ্গা করে তোলে।
“আপনি যখন সবেমাত্র পিতা হন, তখন আপনার দেহে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কম থাকে। ফলে অক্সিটোসিন এবং ডোপামিনের প্রভাব খুব বেশি হয়। ফলে শিশু সন্তানের সঙ্গে কথা বলা এবং তাদের সঙ্গে খেলা করা আপনার জন্য অনেক বেশি আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে।”
টমের নিয়মিতই এই অভিজ্ঞতা হচ্ছে: “যখন সে (শিশু সন্তান) হাসে তখন আসলেই এর চেয়ে ভাল অনুভূতি আর কিছু হয় না,” বলেন তিনি।
পরিবর্তনের এই সবটাই এরকম সুখকর নয়, সতর্ক করে দিয়েছেন আন্না। তিনি বলেন, “টেস্টোস্টেরন হরমোন পুরুষকে চাঙ্গা রাখে। এটি তাদের মানসিক অবস্থাকে খারাপ হতে দেয় না।”
“কিন্তু যখন এই হরমোন কমে যায়, এবং তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের আরো কিছু ঝামেলা এসে যুক্ত হয়, এবং স্ত্রী বা সঙ্গী প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতায় ভোগেন, তখন পুরুষের মধ্যেও এই একই ধরনের বিষণ্ণতা দেখা দিতে পারে,” বলেন তিনি।
আন্না বলছেন, শরীরের হরমোন এবং তাদের প্রভাব সম্পর্কে জানা থাকলে সেটা আমাকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকার ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হতে সাহায্য করতে পারে।
![পিতা ও শিশু](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/240d/live/55d56b40-0dd1-11ee-9e94-25f17ea6acca.jpg)
“একজন নারী হিসেবে আপনি ভাবতে পারেন: ‘আমি জানি যে আমার হরমোনের কারণেই এমনটা হচ্ছে, আমি যে এরকম খারাপ অনুভব করছি তার একটা কারণ আমার হরমোন, তখন এসব আপনাকে সাহায্য করতে পারে। আবার পুরুষরা যদি এটা জানেন যে হরমোনজনিত পরিবর্তন তাকে কখনও কখনও কিভাবে নাজুক ও অসহায় করে তুলতে পারে, তাহলে তারাও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে পারবেন,” বলেন তিনি।
শিশু ও পিতা দু’জনের জন্যেই উপকারী
শিশু সন্তানের সঙ্গে খেলা করা ও তাকে জড়িয়ে ধরার কারণে পিতার দেহে যে ডোপামিন ও অক্সিটোসিনের নিঃসৃত হয় তার ফলে তাদের দেহে যে ধরনের পরিবর্তন ঘটে তাতে শিশু ও পিতা দুজনেই লাভবান হয়।
পিতার মতো এই একই রাসায়নিকের নিঃসরণ ঘটে শিশুদের শরীরেও।
ফলে তারা দুজনেই একেবারে শুরু থেকে স্পর্শ, জড়িয়ে ধরা এবং মাসাজ ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজটা শুরু করতে পারেন।
সন্তান বড় হওয়ার সময় তাদের দেহে সবচেয়ে বেশি অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়, ফলে পিতার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তখন আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
“কোনো পিতা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে ‘আমার সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে হলে আমাকে কী করতে হবে?’, আমি তাকে বলবো ‘তাদের সঙ্গে খেলা করুন,” বলেন আন্না।
“দারুণ ব্যাপার হচ্ছে শিশু ও পিতার মধ্যে এই পরিবর্তন ঘটছে যা দুজনের সঙ্গেই জড়িত এবং দু’জনের ওপরেই তার প্রভাব পড়ছে। যখন তারা একসঙ্গে খেলা করে তখনই তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়।”
আন্না বলছেন, শিশুর বিকাশের জন্য তার সঙ্গে পিতার শারীরিকভাবে খেলাধুলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
“এর ফলে যে আপনার সন্তানের দেহে প্রচুর পরিমাণে অক্সিটোসিনের নিঃসরণ ঘটবে শুধু তাই নয়, এর ফলে তারা বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার করার উপায়ও শিখতে পারবে। তারা বুঝতে পারবে পড়ে গেলে কিভাবে উঠে দাঁড়াতে হয় এবং একবার ব্যর্থ হলে সেটা কাটিয়ে ওঠে কিভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয় সেটাও তারা শিখতে পারবে।”
“এবং যেসব শিশু এধরনের খেলায় অংশ নেয়, তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক বেশি অদম্য ও অপরাজেয় হয়ে ওঠে, যে কোনো খারাপ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে,” বলেন তিনি।
![মস্তিষ্ক](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/ec0f/live/43deeb40-0dd2-11ee-9e94-25f17ea6acca.jpg)
এজন্য আন্না বলছেন, শিশুর সঙ্গী হিসেবে পিতার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
“অতীতে পিতাদের ‘ফান প্যারেন্ট’ হিসেবে দেখা হতো যারা শিশুদের চকলেটসহ নানা জিনিস উপহার দিতেন। কিন্তু শিশুদের বিকাশের জন্য তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।”
মস্তিষ্কে ইতিবাচক পরিবর্তন
আপনি যখন একজন পিতা হবেন তখন হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তনের পাশাপাশি আপনার মস্তিষ্কেও কিছু শারীরিক পরিবর্তন ঘটে।
“শিশু সন্তানকে ভাল মতো দেখাশোনা করার জন্য আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশের প্রয়োজন হয় সেসব জায়গায় পরিবর্তন ঘটে,” বলেন আন্না।
“একটা উদাহরণ দেওয়া যাক- আউটার ব্রেইন বা বহির্মস্তিষ্কের কিছু অংশ বেড়ে যায়। পরিকল্পনা, মনোযোগ দেওয়া এবং সমস্যার সমাধানের মতো দক্ষতার জন্য মস্তিষ্কের এই অংশের প্রয়োজন হয়। আর মস্তিষ্কের অবচেতন অংশে (আনকনশাস ব্রেইন) আমরা সেসব জায়গায় তৎপরতা দেখতে পাই যেগুলো শিশু প্রতিপালন এবং ঝুঁকি চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োজন হয়। আপনার শিশু নিরাপদে আছে কি না সেটা জানার জন্য এগুলোর প্রয়োজন নয়।”
টম নিজেও এই পরিবর্তনটা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। “আপনি সবসময় উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। আর কিছু না হলেও এই উদ্বেগ আগের চাইতে বেশি। আমি যখন সন্তানকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, তখন পেছনে তাকিয়ে দেখি কোনো গাড়ি আমার দিকে চলে আসছে কি না!”
একই সাথে আপনি ঝুঁকির ব্যাপারেও অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠছেন। পিতারা প্রায়শই স্পর্শকাতর হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে তার সন্তানের বিষয়ে।
“অন্যের দুঃখ কষ্টের ব্যাপারে আপনি আরো বেশি সংবেদনশীল এবং তাদের প্রতি আরো বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন,” বলেন আন্না।
“আমি অনেক পিতার সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলবে – শিশুদের ব্যাপারে যেসব খবর দেখানো হয় আমি আর সেগুলো দেখতে পারি না।”
টমের বেলাতেও তাই হয়েছে। “আমার খুব কান্না পায়। এটা আমাকে আগে প্রভাবিত করতো না, কিন্তু এটা সত্যিই আমার ওপর প্রভাব ফেলছে,” বলেন তিনি।
![টম ও তার ছয়মাস বয়সী শিশুসন্তান ওটিস](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/b2f1/live/730ef4b0-0dd1-11ee-9e94-25f17ea6acca.jpg)
জ্ঞানই শক্তি
আন্না আশা করছেন যে শারীরিক এই পরিবর্তনের ব্যাপারে জানতে পারলে, পিতা হিসেবে পুরুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে।
“পুরুষদের কাছ থেকে আগে আমি এই কথাটা প্রচুর শুনতে পেতাম যে তারা মনে করে শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে মা-ই হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড। যেহেতু তিনি গর্ভধারণ করেছেন, শিশুর জন্ম দিয়েছেন, দুগ্ধ-পান করিয়েছেন, তাই তিনিই ভালো জানেন যে শিশুর জন্য কী করতে হবে, এটা তার সহজাত প্রবৃত্তি।
“কিন্তু পুরুষদেরকে এসব শিখতে হয়। এসব সত্য নয়। নারী ও পুরুষ দুজনেই পিতামাতা হিসেবে একই ধরনের সহজাত প্রবৃত্তির অধিকারী। কারণ সন্তান জন্মদানের সময়ে তাদের দুজনকেই শারীরিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।”
বাবাদের জন্য তার কিছু পরামর্শ আছে: “আপনার মধ্যেও সহজাত প্রবৃত্তি আছে, এবিষয়ে আপনাকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আপনিও নিজেকে সন্তানের মায়ের সহকারী হিসেবে না দেখে নিজেকেও তার মায়ের মতো একই ধরনের ব্যক্তি হিসেবে দেখার চেষ্টা করুন। তার কাছে থাকে এবিষয়ে আপনি অনেক কিছু শিখতে পারবেন।”