আদিপুরুষ : ভারতে বানানো সবচেয়ে দামী ছবিটি নিয়ে এত বিতর্ক কেন?
বিনোদন ডেস্কঃ হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের গল্পের ওপর ভিত্তি করে বানানো এপিক ছায়াছবি ‘আদিপুরুষ’ গত শুক্রবার (১৬ জুন) ভারতের সিনেমা হলগুলোতে মুক্তি পেয়েছে।
কিন্তু বছরখানেকেরও বেশি সময় ধরে এই ছবিটি নিয়ে যে তীব্র বিতর্ক চলছে তা তো থামেইনি – বরং মুক্তির পর আদিপুরুষ যেন উত্তেজনার আগুন আরও উসকে দিয়েছে!
আদিপুরুষ হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে, এই অভিযোগে ছবিটির বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তুমুল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে। সেই চাপের মুখে ছবির নির্মাতারা সিনেমার বেশ কিছু সংলাপও বদলাতে বাধ্য হয়েছেন।
ভারতের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর পর্যন্ত বলেছেন, সাধারণ মানুষের ‘অনুভূতি নিয়ে ছেলেখেলা করে’ কোনও ফিল্ম পার পেয়ে যেতে পারবে না।
এই ছবিতে রামায়ণের সীতাকে যেভাবে ‘ভারত-দুহিতা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে প্রতিবেশী দেশ নেপালেও আদিপুরুষ-সহ সব হিন্দি ছবির স্ক্রিনিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
অথচ এই ছবিটি বলিউডের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র বলে বলা হচ্ছে – ‘আদিপুরুষ’ বানাতে প্রায় সাতশো কোটি রুপি খরচ হয়েছে বলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সূত্রের খবর, যে অঙ্কটি ভারতের সিনেমা জগতে একটি রেকর্ড।
‘বাহুবলী’ ব্লকবাস্টারের নায়ক ও দক্ষিণ ভারতের তারকা প্রভাস এই ছবিতেও প্রধান চরিত্রে (‘রাঘব’) আছেন, এছাড়া কৃতি স্যানন জানকীর (সীতা) ভূমিকায় ও সাইফ আলি খান ‘লঙ্কেশ’ রাবণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
কিন্তু শুরুর উইকেন্ডে ছবিটি দারুণ সাফল্য পেলেও গতকাল মুক্তির পর প্রথম সোমবারে আদিপুরুষ কিন্তু বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
অর্থাৎ বলিউডের পরিভাষায় যেটাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘মানডে টেস্ট’ বলা হয় – যাতে দেখা হয় সপ্তাহান্তের ছুটি শেষে প্রথম কাজের দিনেও ছবিটি দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে পারে কি না – তাতে আদিপুরুষ চরম ব্যর্থ হয়েছে!
যে সব ইস্যুতে আপত্তি
ছবি মুক্তির অনেক আগেই মুম্বাই মিরর পত্রিকাকে গত বছর একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন আদিপুরুষে ‘লঙ্কেশ’ চরিত্রের অভিনেতা সাইফ আলি খান।
রামায়ণের ‘রাবণ’ চরিত্রেরও যে একটা মানবিক দিক আছে এবং লক্ষ্মণের হাতে বোন শূর্পণখার অপমানের বদলা নিতেই তিনি সীতাকে অপহরণ করেছিলেন – এই জিনিসটা আদিপুরুষে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন সাইফ আলি খান।
ছবির ‘কোর অডিয়েন্সে’র একাংশ এই মন্তব্যে রুষ্ট হওয়ার পর সাইফ আলি খান রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে দু:খ প্রকাশ করেন এবং তাঁর ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন।
এরপর যখন অক্টোবরে ছবিটির প্রথম ‘টিজার’ মুক্তি পায়, তখনও খুব নিচু মানের ভিস্যুয়াল এফেক্টস নিয়ে দর্শকরা ছি ছি করতে থাাকেন।
বাধ্য হয়ে প্রয়োজক সংস্থা টি-সিরিজ সব এফেক্ট আবার ‘ফাইন টিউন’ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ছবির মুক্তিও এ বছরের জানুয়ারি থেকে পিছিয়ে দেওয়া হয় জুনে।
এপ্রিলে জানা যায়, আদিপুরুষের ‘ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার’ অনুষ্ঠিত হবে নিউ ইয়র্কের মর্যাদাব্যঞ্জক ট্রাইবেকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে – যে চলচ্চিত্র উৎসবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিখ্যাত হলিউড তারকা রবার্ট ডি নিরো।
কিন্তু কোনও রহস্যময় কারণে ছবিটি শেষ মুহুর্তে ওই উৎসবে আর দেখানো হয়নি – কোনও কোনও সূত্রে দাবি করা হয়েছিল যে প্রিমিয়ারের আগে ছবির কাজই নাকি পুরোপুরি শেষ করে ওঠা যায়নি।
এতশত বিতর্কের শেষে গত শুক্রবার (১৬ জুন) অবশেষে ভারতের সিনেমা হলে আদিপুরুষ মুক্তি পেলেও দেশের ফিল্ম সমালোচকরা প্রায় সবাই একবাক্যে তাদের রায় জানিয়ে দেন – ছবিটি মোটেও পাতে দেওয়ার মতো হয়নি।
ছবিতে বেশ কিছু চরিত্রকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং তাদের মুখে যে ধরনের সংলাপ বসানো হয়েছে – তাতেও ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের একটা বড় অংশ ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন।
যেমন হিন্দুদের ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে যেভাবে ছবিতে ‘অ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান’ (ক্রুদ্ধ যুবক) হিসেবে দেখানো হয়েছে বা রামভক্ত হনুমানকে ‘তেরে বাপ কি’-র মতো সংলাপ বলতে শোনা গেছে তা তাদের অনেকেরই পছন্দ হয়নি।
হিন্দুত্বের ব্যাকফায়ার?
মুক্তির পর থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব থিয়েটারে আদিপুরুষ দেখানো হচ্ছে, তার সামনে দর্শকরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ‘হিন্দু ধর্মের অপমান’ বন্ধ করার স্লোগান দিতে দিতে ক্ষুব্ধ জনতা ছবির পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছেন, ‘মুর্দাবাদ’ আওয়াজ তুলছেন।
দেশের রাজধানী দিল্লি, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সংসদীয় কেন্দ্র বারাণসী, উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনৌ বা বলিউডের প্রাণকেন্দ্র মুম্বাই – আদিপুরুষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ চলতে থাকে দেশের সর্বত্রই।
সিনেমাকর্মীদের সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া সিনে ওয়াকার্স অ্যাসোসিয়েশন’ ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চিঠি লিখে দাবি জানায়, আদিপুরুষ প্রদর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং ছবির পরিচালক ওম রাউত ও সংলাপ-লেখক মনোজ মান্তাশির ও প্রযোজকদের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে হবে।
ছবির নির্মাতারা প্রথমে আত্মপক্ষ সমর্থনে এগিয়ে এলেও পরে এই প্রবল চাপের মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছেন – মুক্তির পরও তারা ছবির বেশ কিছু বিতর্কিত সংলাপ বদলে দিতে বা সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছেন।
ওদিকে প্রতিবেশী নেপালেও প্রশ্ন উঠেছে, সবাই বিশ্বাস করেন রামায়ণের সীতার জন্ম নেপালের জনকপুরে – অথচ ছবিতে তাকে কেন ‘ভারতের কন্যা’ বলে দাবি করা হয়েছে?
এর প্রতিবাদে কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহ রবিবার রাত থেকেই তাঁর শহরে আদিপুরুষ-সহ সব হিন্দি ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দেন।
কাঠমান্ডুর পর নেপালের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর পোখরার মেয়র ধনরাজ আচার্যও সিনেমা হল মালিকদের চিঠি লিখে নির্দেশ দেন সেখানে অবিলম্বে সব ভারতীয় ছবির প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।
ভারতেও আদিপুরুষ বিতর্ক রাজনৈতিক মাত্রা পেয়ে গেছে – অন্যতম প্রধান বিরোধী দল আম আদমি পার্টি ছবিটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে। ছবির ‘কনটেন্ট’ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে সমাজবাদী পার্টি বা শিবসেনার (উদ্ধব গোষ্ঠী) মতো আরও অনেক দল।
এমন কী, দিল্লি বিজেপির মুখপাত্র প্রভিন শঙ্করও দাবি করেছেন, ছবির সব দৃশ্য ও সংলাপ নতুন করে যাচাই-বাছাই না-করা পর্যন্ত আদিপুরুষ ‘সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ’ করতে হবে।
অথচ ছবির ক্রেডিট রোলে আদিপুরুষের নির্মাতারা দেশের বড় বড় সব বিজেপি নেতার ‘আশীর্বাদ’ প্রার্থনা করেছিলেন।
তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের তালিকায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি বা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপির শরিক একনাথ সিন্ধে – কেউই বাদ যাননি।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী একটি দলের ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে এবং রামায়ণের কাহিনি-নির্ভর ছবি বানিয়েও আদিপুরুষ সেই হিন্দুত্ববাদীদেরই তোপের মুখে পড়েছে।