টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ অন্বেষণকারী সাব নিখোঁজ, সবশেষ যা জানা যাচ্ছে

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পর্যটনে ব্যবহৃত একটি সাব বা সাবমারসিবল নিখোঁজ হওয়ার পর উত্তর আটলান্টিকে ব্যাপক অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান চলছে।

রোববার টাইটান নামের ঐ ডুবোজাহাজটি সাগরে নামার এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে গবেষণা জাহাজ ‘পোলার প্রিন্স’-এর সাথে সাবটির ক্রুদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় সময় বিকেল পাঁচটার দিকে (ইএসটি) মার্কিন কোস্ট গার্ডরা ধারণা করেছিল যে সাবটিতে ৭০ থেকে ৯৬ ঘণ্টা চলার মতো জরুরি অক্সিজেন ছিল।

পর্যটন সংস্থা ওশানগেট বলেছে যে, তারা ক্রুদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য সব ধরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সরকারি সংস্থাগুলি উদ্ধার অভিযানে যোগ দিয়েছে।

উদ্ধার প্রচেষ্টার সর্বশেষ আপডেট

‘পোলার প্রিন্স’ রবিবার সকালে আটলান্টিক মহাসাগরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে পৌঁছায়। টাইটানে থাকা হামিশ হার্ডিং-এর একটি ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, যে তারা স্থানীয় সময় চারটার দিকে পানির নিচে যাত্রা শুরু করবে বলে আশা করছেন।

অনুসন্ধানের নেতৃত্বদানকারী বোস্টন কোস্ট গার্ড টুইটারে বলেছে যে, পাঁচ জন আরোহী “রবিবার সকালে পানির নিচে যাওয়া শুরু করে এবং এর প্রায় এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে পোলার প্রিন্সের ক্রুরা তাদের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে”।

টাইটান ডুবোজাহাজটি তখন কেপ কড উপকূল থেকে প্রায় ১৪৫০ কিলোমিটার দূরে ছিল বলে মনে করা হয়েছিল।

মার্কিন কোস্ট গার্ডের রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মাগার সোমবার বলেছেন যে এমন একটি দুর্গম এলাকায় অনুসন্ধান চালানো একটি চ্যালেঞ্জ।

অনুসন্ধানের দুটি দিক আছে, একটি হল সমুদ্র পৃষ্ঠে অনুসন্ধান যদি টাইটান সমুদ্রের পৃষ্ঠে ফিরে আসে এবং সেখান থেকেই কোনোভাবে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া পানির নিচে শব্দ তরঙ্গের সাহায্যে সোনার অনুসন্ধানও আরেকটি উপায় রয়েছে।

সমুদ্র পৃষ্ঠে সাবমার্সিবল খোঁজার জন্য কোস্ট গার্ড দুটি সি-১৩০ হারকিউলিস আকাশযান পাঠিয়েছে, এবং একটি কানাডিয়ান সি-১৩০ এবং একটি পি৮ আকাশযানও অনুসন্ধানে কাজ করছে, যাদের পানির নিচে সোনার অনুসন্ধানের ক্ষমতা রয়েছে।

রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মাগার বলেছেন যে, জাহাজটিকে যদি পানির নিচে পাওয়া যায় তাহলে সেটি উদ্ধার করতে অতিরিক্ত দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হবে এবং মার্কিন নৌবাহিনীর সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করা হবে।

কানাডার প্রতিরক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, বিমানটির পাশাপাশি কানাডিয়ান কোস্ট গার্ডদের জাহাজ ‘কোপিট হপসন’ অনুসন্ধানে সাহায্য করছে।

পোলার প্রিন্সের সহ-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হরাইজন মেরিটাইম, বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে যে জাহাজটি অনুসন্ধানে কাজ করছে এবং একটি দ্বিতীয় জাহাজ, হরাইজন আর্কটিক, ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।

ভেতরে কারা ছিলেন?

টাইটানের ভেতরে থাকা পাঁচজনের মধ্যে শুধুমাত্র তিনজনের নাম নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। তারা হলেন – হামিশ হার্ডিং, একজন ৫৯ বছর বয়সী ব্রিটিশ বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী এবং পরিব্রাজক, আরেক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ এবং তার ছেলে, সুলেমান দাউদ।

মি. হার্ডিং প্রথম ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি গত বছরের জুনে এই দলে যোগ দিতে যাচ্ছেন এবং বলেছিলেন যে জাহাজের ক্রুদের মধ্যে “কয়েকজন বড় মাপের অভিযাত্রী রয়েছেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ ১৯৮০ সাল থেকে আরএমএস টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে ৩০টিরও বেশি ডাইভ করেছেন”।

তিনি অ্যাকশন এভিয়েশন নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার চেয়ারম্যান, যা দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক ব্যবসায়িক বিমান শিল্পের বিক্রয় এবং পরিচালনা নিয়ে কাজ করে।

টুইটারে, তার প্রতিষ্ঠান রবিবার বলেছে যে “সাবটির সফল উৎক্ষেপণ হয়েছে এবং হামিশ বর্তমানে ডুব দিচ্ছে”।

সোমবার, মার্কিন কোস্ট গার্ড বলেছে যে তারা তাদের পরিবারের প্রতি সম্মানের কারণে ভেতরে থাকা আরোহীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে প্রস্তুত নয়।

মঙ্গলবার একটি বিবৃতিতে দাউদ পরিবার তাদের দুই সদস্য শাহজাদা দাউদ এবং সুলেমান দাউদের ঐ সাবে থাকার কথা নিশ্চিত করেছে।

ফরাসি পরিব্রাজক পল-হেনরি নার্জোলেট এবং ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী স্টকটন রাশও নিখোঁজ সাবে ছিলেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

সাব কি করছিল?

ওশানগেট এক্সপেডিশন্স তার আট দিনের অভিযানে একটি সিটের জন্য অতিথিদের আড়াই লাখ ডলার চার্জ করে থাকে। এই অভিযান মূলত টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়, যেটি আটলান্টিকের তলদেশে সমুদ্র পৃষ্ঠের সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে অবস্থিত৷

জায়গাটি নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল থেকে প্রায় ৬০০ কিমি দূরে অবস্থিত এবং এই ধ্বংসাবশেষ দুটি অংশে ছড়িয়ে আছে।

টাইটানিকের সামনের সূচালো অংশ এবং মাঝের অংশটি প্রায় ২৬০০ ফুট দূরে আলাদা হয়ে পড়েছে। ভাঙা জাহাজটিকে ঘিরে রয়েছে বিশাল ধ্বংসস্তূপ।

ধ্বংসাবশেষে একটি সম্পূর্ণ ডাইভ দিতে অর্থাৎ অবতরণ এবং আরোহণ করতে আনুমানিক আট ঘণ্টা সময় লাগে।

ওশানগেটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি অভিযান আট দিন স্থায়ী হয় এবং প্রতিটি ডুব দেয়া বা ডাইভের একটি বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য থাকে। এরমধ্যে রয়েছে ধ্বংসাবশেষে কতোটা ক্ষয় হয়েছে সেটা বিশ্লেষণ করা।

কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুসারে, তাদের প্রথম ডাইভটি হয়েছিল ২০২১ সালে।

দ্য পোলার প্রিন্স
দ্য পোলার প্রিন্স

আমরা টাইটান সম্পর্কে কি জানি?

টাইটান হল একটি পাঁচ-আরোহীর ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন সাবমার্সিবল যা চার হাজার মিটার গভীরে নামতে সক্ষম এবং এটি তিন নটে অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে তিন মাইল গতিতে চলতে পারে।

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে আরোহীদের নিয়ে যাওয়া ছাড়াও, এটি সাইট জরিপ, পরিদর্শন, গবেষণা এবং তথ্য সংগ্রহ, ফিল্ম এবং মিডিয়া প্রোডাকশন এবং হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার গভীর সমুদ্র পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।

টাইটানিক সাবমার্সিবল

কোম্পানির মতে, টাইটানে অত্যাধুনিক আলো এবং সোনার নেভিগেশন সিস্টেম রয়েছে। সেইসাথে এর ভেতরে এবং বাইরে ফোর-কে ভিডিও ও ছবি ধারণের মতো ক্যামেরা বসানো রয়েছে।

ওশানগেট-এর ওয়েবসাইট অনুসারে, পাঁচ-আরোহীর এই সাবমার্সিবল বাস্তব সময়ে জাহাজের পাটাতনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করারও ব্যবস্থা রয়েছে।

সাবমার্সিবলের কাঠামোয় কোন সমস্যা হয়েছে কিনা তা মূল্যায়ন করার জন্য এটি ডুব দেওয়ার সাথে সাথে সাবের উপর যে চাপ পড়ে, তার প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য সেন্সর রয়েছে।

কোম্পানির মতে, “এই অনবোর্ড হেলথ অ্যানালাইসিস মনিটরিং সিস্টেমটি” যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে আগে থেকেই সতর্কতা দেয় যেন এর আরোহীদের নিরাপদে সমুদ্র পৃষ্ঠে ফিরিয়ে আনার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়।

সাংবাদিক ডেভিড পোগ একই সংস্থার সাথে সমুদ্রযাত্রায় গিয়েছিলেন।
সাংবাদিক ডেভিড পোগ একই সংস্থার সাথে সমুদ্রযাত্রায় গিয়েছিলেন।

সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা

বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস গত বছর টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে তাদের একজন সাংবাদিককে একই সংস্থার সাথে সমুদ্রযাত্রায় পাঠিয়েছিল।

ডেভিড পোগ ওই অভিযানে যাওয়ার পর সেখানে একটি লিখিত বিবৃতি পড়েছিলেন। যেখানে বলা হয়েছে, এটি মূলত একটি “পরীক্ষামূলক” জাহাজ “যা কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত বা প্রত্যয়িত হয়নি, এবং এর ফলে শারীরিক আঘাত, অক্ষমতা, মানসিক আঘাত বা মৃত্যু হতে পারে”

ওশানগেটের সিইও স্টকটন রাশ তারপর তাকে সাবমার্সিবলে একটি ট্যুর দেন, সেই অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান যে, জাহাজটিতে শুধুমাত্র একটি বোতাম রয়েছে এবং এটি একটি ভিডিও গেম কন্ট্রোলার ব্যবহার করে চালানো হয়।

তিনি আরও বলেন এর ভেতরে থাকা আরোহীদের বাইরের কারও সাহায্য ছাড়া বেরিয়ে আসা অসম্ভব।

সময়মত জাহাজটি খুঁজে বের করা উদ্ধারকারীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে বলে তিনি মনে করেন।

সোমবার বিবিসির কাছে পোগ ব্যাখ্যা করেন যে, যাত্রীদের মূল ক্যাপসুলের ভিতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে বেশ কয়েকটি বোল্ট দিয়ে সিল করে দেয়া হয়েছিল এবং বাইরে থেকে সেই স্ক্রু খোলার পর সবাই বেরোতে পেরেছেন।

তিনি দ্য কনটেক্সট প্রোগ্রামকে বলেছিলেন যে জাহাজটির পানির ওপরে উঠে আসার সাতটি ভিন্ন ফাংশন ছিল। কিছু চিন্তার বিষয় হল সেগুলোর মধ্যে কোনটিই এখনও পর্যন্ত কাজ করেনি।

তিনি বলেন, যদি সাবটি আটকে পড়ে বা ফুটো হয়ে যায় তাহলে এর উঠে আসা নিয়ে কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে।

“কোন ব্যাকআপ নেই, কোন পালানোর পড নেই,” তিনি বলেন। “এটি হয় সমুদ্র পৃষ্ঠে উঠে আসবে নাহলে সবাই মারা যাবে।”

টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ।
টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ।

উদ্ধারকারীরা নিখোঁজ সাবটি খুঁজে বের করতে এখন সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়াচ্ছে, বলছে মার্কিন কোস্ট গার্ড।

সরকারি সংস্থা, মার্কিন ও কানাডার নৌবাহিনী এবং গভীর সমুদ্র বিষয়ক বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

উদ্ধার অভিযান বোস্টন, ম্যাসাচুসেটস থেকেও চালানো হচ্ছে।

পুনরুদ্ধারের মিশন আরও জটিল হয়ে পড়েছে কারণ জিপিএস পানির নিচে কাজ করে না, রেডিও কাজ করে না – যার অর্থ বর্তমানে জাহাজের সাথে সাবটির যোগাযোগ করার “কোনও উপায়” নেই।

“যখন সাপোর্ট সাবটি সরাসরি সাবের উপরে থাকে, তখন তারা বার্তা পাঠাতে পারে। স্পষ্টতই সেগুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না,” পোগ বলেছেন, তিনি গত বছর টাইটানের যে অভিযানে ছিলেন সেটিও প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সময় হারিয়ে গিয়েছিল।

তিনি বলেছেন যে শুরুতে তার এই সাবে যাত্রা করার ব্যাপারে বেশ দ্বিধা কাজ করছিল।

“সাবটি একটি এক্স-বক্স গেম কন্ট্রোলার দিয়ে চালানো হয়, কাঠামোয় ব্যবহার করা হয়েছে নির্মাণকাজের পরিত্যক্ত পাইপ।”

পোগ বলেছেন যে, টাইটানের উদ্ভাবক এবং ওশানগেটের সিইও, স্টকটন রাশ তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, কার্বন-ফাইবার দিয়ে তৈরি ক্যাপসুলটি নাসা এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথভাবে ডিজাইন করা হয়েছে এবং এটি “পাথরের চাইতেও কঠিন”।

সোমবার এক বিবৃতিতে, ওশানগেট বলেছেন যে তাদের এখন “পুরো মনোযোগ পানির নিচে থাকা আরোহী ও তাদের পরিবারের উপর”।

গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানে কাজ করা সবার প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ।
টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ।

টাইটানিক জাহাজটি, ১৯১২ সালে সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্ক আসার পথে একটি বরফ খণ্ডের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এটি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় জাহাজ এবং প্রথম যাত্রাও তা শেষ করতে পারেনি। ওই দুর্ঘটনায় জাহাজে থাকা ২২০০ যাত্রী এবং ক্রুদের মধ্যে ১৫০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।

১৯৮৫ সালে জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু হয়।


Spread the love

Leave a Reply