আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে যারা ইতোমধ্যেই চাকরি হারিয়েছেন

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ ডিন মিডোক্রফট কিছুদিন আগ পর্যন্ত একটি মার্কেটিং কোম্পানিতে কপিরাইটারের কাজ করতেন। প্রেস রিলিজ লেখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়াসহ কোম্পানির জন্য বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি করতে হতো তাকে।

কিন্তু গত বছর শেষ দিকে তার কোম্পানি একটি আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) ব্যবস্থা চালু করে।

“প্রথমে বলা হলো কপিরাইটারদের সাথে সমান্তরালভাবে কাজ করবে এই এআই ব্যবস্থা। তাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে, দ্রুত কাজ হবে,” তিনি বলেন।

তবে এআই যেসব কাজ করে দিচ্ছিল তার মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না মি. মিডোক্রফট। “এগুলো ব্যবহার করে সেসব কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছিল সেগুলো খুবই সাদামাটা গোছের, সবগুলোই প্রায় একইরকম লাগছিল, অসামান্য বা ভিন্ন কিছু কাজ বের করা যাচ্ছিলোনা।“

এআই ব্যবহার করে তৈরি লেখাগুলো আবার আরেকজন খুঁটিয়ে দেখতো হতো যেন সেগুলো অন্য কোথাও থেকে হুবহু কোনো নকল না হয়।

কিন্তু এআই দিয়ে খুব দ্রুত কাজ হচ্ছিল। যে কপি লিখতে একজন কপিরাইটারের এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগে, এআই দিয়ে তা ১০ মিনিট বা আরো কম সময়ে লেখা যাচ্ছিল।

এআই চালুর চার মাসের মাথায়, মি. মিডোক্রফটের চার-সদস্যের টিমের চাকরি চলে গেলে।

কেন তা করা হলো তা নিয়ে মি. মিডোক্রফট শতভাগ নিশ্চিত না হলেও তার দৃঢ় বিশ্বাস এআই এর কারণে তাদের চাকরি গেছে।

“এআই যে লেখকদের চাকরি খাবে বা আমার চাকরি হুমকিতে ফেলবে – এমন ধারণা আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম । কিন্তু বাস্তবে সেটাই হলো,” তিনি বলেন।

গত বছর শেষ দিকে ওপেন-এআই কোম্পানি চ্যাট-জিপিটি বাজারে ছাড়ার পর এআই-এর ব্যবহার হুহ করে বাড়ছে।

মাইক্রোসফটের সাহায্য নিয়ে তৈরি করা চ্যাট-জিপিটি যে কোনো প্রশ্নের উত্তর এমনভাবে দিয়ে দেয় যা দেখে মনে হবে মানুষই বোধ হয় সেই উত্তর লিখছে। এই এআই প্রোগ্রাম কয়েক মিনিটের মধ্যে বড় বড় নিবন্ধ, ভাষণ এমনকি রান্নার রেসিপি পর্যন্ত হাজির করে দিচ্ছে।

অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টরাও তাদের নিজস্ব এআই সিস্টেম তৈরির জন্য হুমকি খেয়ে পড়ছে। যেমন, মার্চে গুগল তাদের নিজস্ব এআই সিস্টেম বার্ড বাজারে ছাড়ে।

যদিও একেবারে নিখুঁত নয়, তারপরও এসব এআই সিস্টেম ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা অসীম তথ্যভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যটি বের করে আনতে সক্ষম, যে কাজ কোনো একজন বা একদল মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আর এ কারণেই এমন ধারণা অমূলক নয় যে কোনো কোনো চাকরি এখন হুমকিতে পড়ে গেছে।

এ বছরের গোড়ার দিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের একটি রিপোর্টে বলা হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে পূর্ণকালীন কাজ করছে এমন ৩০ কোটি মানুষ বেকার হয়ে যেতে পারে। তবে অর্থনীতির সব খাতে এটির প্রভাব সমানভাবে পড়বেনা। ঐ রিপোর্টে বলা হয়, প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজের ৪৬ শতাংশ এবং আইন পেশার ৪৪ শতাংশ কাজ এআই দিয়ে হতে পারে। কিন্তু নির্মাণ খাতের কাজে বড়জোর ছয় শতাংশ কাজ এআই দিয়ে করা সম্ভব হতে পারে।

সুইডিশ ফার্নিচার জায়ান্ট আইকিয়া তাদের কল সেন্টারের হাজার হাজার কর্মীকে ছাঁটাই না করে ডিজাইন পরামর্শকের কাজ দিয়ে রেখে দিয়েছে।

গোল্ডম্যান স্যাকসের ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, এআই দিয়ে উৎপাদনশীলতা এবং সেইসাথে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, ফলে নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে।

এরই মধ্যে তার নজির দেখা যাচ্ছে। যেমন, সুইডিশ ফার্নিচার জায়ান্ট আইকিয়া তাদের কল সেন্টারের হাজার হাজার কর্মীকে ছাঁটাই না করে ডিজাইন পরামর্শকের কাজ দিয়ে রেখে দিয়েছে।

ঐ কোম্পানি বিলি নামে একটি এআই সিস্টেম চালুর পর তা দিয়েই কল সেন্টারের ৪৭ শতাংশ কল মানুষের বদলে মেশিন দিয়েই হ্যান্ডল করা সম্ভব হচ্ছে।

কিন্তু তারপরও আইকিয়ার কল সেন্টারের কর্মীদের চাকরি যায়নি। এ মাসে কোম্পানি জানায় ২০২১ সাল থেকে তারা কল সেন্টারে কর্মরত ৮৫০০ কর্মীকে ছাঁটাই না করে ডিজাইন পরামর্শকের কাজ দিয়ে রেখে দিয়েছে।

যদিও আইকিয়ায় এআই চালুর পর মানুষ চাকরি হারায়নি, কিন্তু কোম্পানিগুলো যেভাবে একে একে তাদের কাজে এআই চালু করছে তাতে শ্রমিক-কর্মচারিদের মধ্যে গভীর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক সংস্থা বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের (বিসিজি) করা সাম্প্রতিক এক জরিপ করেছে যেখানে তারা সারা বিশ্বের বিভিন্ন খাতে কর্মরত ১২,০০০ কর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। ঐ জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে উত্তরদাতাদের এক তৃতীয়াংশই ভয় পাচ্ছেন এআই-এর কারণে তারা চাকরি হারাবেন। ম্যানেজারদের চেয়ে ফ্রন্ট-লাইনে কর্মরত কর্মীদের মধ্যে এই ভয় বেশি।

বিসিজির কর্মকর্তা জেসিকা অ্যাপোথেকের বলেন, অজানা আশংকায় ভুগছে মানুষ। “আপনি যদি নেতৃস্থানীয় বা ম্যানেজারদের সাথে কথা বলেন, তাদের ৮০ শতাংশই প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার এআই ব্যবহার করছেন। কিন্তু যারা সাধারণ কর্মী তাদের মধ্যে এআই ব্যবহারের সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ। সুতরাং প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা কম থাকায় তাদের মধ্যে উদ্বেগ আশংকা বেশি।“

কিন্তু সেই আশংকার পেছনে যথার্থ কারণও রয়েছে।

জনপ্রিয় একটি ইউটিউব চ্যানেলে গতবছর তিনমাস ধরে ভয়েস-ওভার বা কণ্ঠ দেওয়ার কাজ করছিলেন আলেহান্দ্রো গ্রাও। তিনি ভাবছিলেন এই কাজে ভালো ভবিষ্যৎ রয়েছে তার কারণ ইংরেজি ঐ ইউ-টিউব চ্যানেলের সব কন্টেন্ট স্প্যানিশ ভাষায় তাকে ভয়েস ওভার করতে হতো।

গত বছরের শেষদিকে ছুটিতে গিয়েছিলেন মি. গ্রাউ। নিশ্চিত ছিলেন ফিরে এসে কাজ পাবেন।

“আমি ভেবেছিলাম যে টাকা পাচ্ছি তাতে সংসার চলে যাবে – আমার দুটো মেয়ে, আমার টাকা দরকার।“

কিন্তু ছুটি থেকে ফেরার আগেই তিনি দেখলেন ঐ ইউ-টিউব চ্যানেলটি স্প্যানিশ ভাষায় ভয়েস-ওভার করা একটি নতুন ভিডিও আপলোড করেছে যেটিতে তিনি কণ্ঠ দেননি।

“আমি যখন ঐ ভিডিওতে ক্লিক করলাম, আমি নিজের কণ্ঠ শুনলাম না। যেটা শুনলাম তা হলো এআই দিয়ে তৈরি একটি কণ্ঠ – যদিও তা একেবারেই মূল কণ্ঠের সাথে ঠিকমত মিলছিল না। জঘন্য লাগছিল। আমি হতবাক হয়ে গেলাম, ভাবলাম – এই কণ্ঠই কি চ্যানেলে আমার সহকর্মী হবে? নাকি এটি আমার জায়গা নিয়ে নেবে?” তিনি বলেন।

স্টুডিওতে ফোন করে চরম দুঃসংবাদ পেলেন তিনি।

ঐ চ্যানেল এআই ব্যবহার করে দেখতে চাইছে তা কাজ করে কিনা। কারণ, এতে তাদের কাজ দ্রুত এবং সস্তায় হয়ে যাবে।

তবে সেই নিরীক্ষা কাজ করেনি। দর্শকরা ভয়েস-ওভার নিয়ে অভিযোগ তোলে। ফলে, ঐ চ্যানেল তাদের এআই ব্যবহার করে ভয়েস-ওভার করা ভিডিওগুলো প্রত্যাহার করে নেয়।

কিন্তু ঐ ঘটনার পর মি. গ্রাওয়ের ভেতরে ভয় ঢুকে যায়। তিনি মনে করেন, প্রযুক্তির উন্নতি হবে এবং শেষ পর্যন্ত তার মতো ভয়েস-ওভার শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়বেন।

“এমনটি হলে আমি তখন কি করবো? চাষাবাদের ক্ষেত কিনবো? জানিনা। কী চাকরি আমি খুঁজবো যা অদূর ভবিষ্যতে এভাবে হুমকিতে পড়বে না? পরিস্থিতি খুবই জটিল হয়ে পড়ছে,” তিনি বলেন।

এআইয়ের কারণে যদি আপনার কাজ চলে নাও যায়, একসময় হয়তো আপনাকে এআই নিয়েই কাজ করতে হবে।

চাকরি হারানোর পর কয়েকমাস ফ্রি-ল্যান্স কাজ করার পর কপি-রাইটার ডিন মিডোক্রফট নতুন রাস্তা নেন।

তিনি এখন এমন এক প্রতিষ্ঠানে কাজ নিয়েছেন যারা কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পরামর্শ দেয়। নতুন এই কাজে তিনি এআই ব্যবহার করছেন।

“আমার মনে হয় এআই নিয়ে ভবিষ্যতে এমনটাই ঘটবে, পুরোপুরি মানুষের জায়গা না নিয়ে এগুলো মানুষের কাজ সহজ করে দেবে,“ তিনি বলেন।


Spread the love

Leave a Reply