ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাস্টার বোমা পাঠানো নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা সরবরাহের বিষয়ে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি মিত্র দেশ অস্বস্তি প্রকাশ করেছে।

শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে যে তারা ইউক্রেনে ওই বিতর্কিত অস্ত্র পাঠাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একে ‘খুব কঠিন সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেছেন।

তবে প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং স্পেন বলেছে যে তারা এ অস্ত্র ব্যবহারের বিরোধী।

একশোটিরও বেশি দেশ ক্লাস্টার বোমা নিষিদ্ধ করেছে, কারণ তা বেসামরিক মানুষের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনে।

ক্লাস্টার বোমা বলতে সাধারণত অনেকগুলো ছোট ছোট বোমাকে বোঝায়, যা লক্ষ্যবস্তুতে একসাথে নিক্ষেপ করা হয়। এতে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে নির্বিচারে হত্যা করা যায়।

এই যুদ্ধাস্ত্রের ব্যর্থতা অর্থাৎ বোমা অবিস্ফোরিত থাকার হার নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কারণ অবিস্ফোরিত বোমাগুলো বছরের পর বছর মাটিতে পড়ে থাকতে পারে এবং যখন তখন তার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভান সাংবাদিকদের বলেছেন যে ইউক্রেনে পাঠানো আমেরিকান ক্লাস্টার বোমাগুলো, ইতিমধ্যে সংঘাতে রাশিয়া যেগুলি ব্যবহার করছে তার চেয়ে অনেক কম বার ব্যর্থ হয়েছে।

তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ‘একটি সময়োপযোগী, বিস্তৃত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়’ সামরিক সহায়তা প্যাকেজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

মি. বাইডেন শুক্রবার সিএনএনকে বলেছেন যে, তিনি এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে মিত্রদের সাথে কথা বলেছেন। এই ক্লাস্টার বোমাগুলো মূলত ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সহায়তা প্যাকেজের অংশ ছিল।

প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে ‘এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হতে কিছুটা সময় লেগেছে’, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত এই বোমা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কারণ “ইউক্রেনীয়দের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে”।

এদিকে, এ সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে যে ক্লাস্টার বিস্ফোরক “সংঘাত শেষ হওয়ার অনেক পরেও বেসামরিক মানুষের জীবনের জন্য বড় ধরণের হুমকির কারণ হয়ে থাকে”।

শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পশ্চিমা মিত্র মি. বাইডেনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে অস্বীকার করেছে।

মার্কিন সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন যে, “ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্র বিষয়ক কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী ১২৩টি দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্য একটি, যারা যা এ জাতীয় অস্ত্র উৎপাদন বা ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে এবং অস্ত্রটি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেছে।”

স্পেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্গারিটা রবলেস আরও এক ধাপ এগিয়ে সাংবাদিকদের বলেন যে তার দেশের ‘দৃঢ় অবস্থান’ ছিল যে এ ধরণের অস্ত্র এবং বোমা ইউক্রেনে পাঠানো যাবে না।

“ক্লাস্টার বোমাকে না এবং ইউক্রেনের বৈধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে হ্যাঁ, যা ক্লাস্টার বোমা দিয়ে নিশ্চিত করা উচিত নয়,” বলে তিনি তার দেশের অবস্থান তুলে ধরেন।

এদিকে, কানাডার সরকার বলেছে যে, তারা শিশুদের উপর এই বোমার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন – বিশেষ করে যেসব বোমা কখনও কখনও বহু বছর ধরে অবিস্ফোরিত থাকে৷

কানাডা আরও বলেছে যে তারা ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিল এবং দেশটি ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্রের কনভেনশনের শর্তগুলো পুরোপুরি মেনে চলে।

“আমরা কনভেনশনের দেয়া শর্তগুলোকে গুরুত্ব সহকারে মেনে চলি এবং সবাই যেন তাই করে সেজন্য উৎসাহিত করি,” এক বিবৃতিতে দেশটি জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন এবং রাশিয়া ওই চুক্তিতে কোন স্বাক্ষর করেনি, এবং মস্কো এবং কিয়েভ উভয়ই যুদ্ধের সময় ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করেছে।

এদিকে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী আরেক ইউরোপিয় দেশ জার্মানি বলেছে যে তারা ইউক্রেনকে এই ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করবে না, তবে তারা আমেরিকার অবস্থান বুঝতে পেরেছে।

জার্মান সরকারের মুখপাত্র স্টেফেন হেবস্ট্রেইট বার্লিনে সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা নিশ্চিত যে আমাদের মার্কিন বন্ধুরা এ ধরনের গোলাবারুদ সরবরাহের সিদ্ধান্তকে হালকাভাবে নেয়নি।”

তবে, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যে ক্লাস্টার বোমাগুলো শুধুমাত্র শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলার জন্য ব্যবহার করা হবে, শহরাঞ্চলে নয়।

মার্কিন আইন লঙ্ঘন, জাতিসংঘ এবং রাশিয়ার সমালোচনা

মি. বাইডেনের পদক্ষেপ একটি মার্কিন আইন লঙ্ঘন করছে – যেখানে কোন অস্ত্রের ব্যর্থতার হার এক শতাংশের বেশি হলে সেটি উৎপাদন, ব্যবহার বা স্থানান্তর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ক্লাস্টার বোমার ব্যর্থতার হার এক শতাংশের বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মি. সালিভান, সাংবাদিকদের বলেছেন যে মার্কিন ক্লাস্টার বোমার ব্যর্থতার হার আড়াই শতাংশের কম, যেখানে রাশিয়ার ক্লাস্টার বোমার ব্যর্থতার হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।

ইউএস ক্লাস্টার মিউনিশন কোয়ালিশন, যা অস্ত্র নির্মূল করা বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের প্রচারণার অংশ, তারা বলছে যে এই সিদ্ধান্ত “আজ এবং আগামী কয়েক দশকের জন্য বড় ধরণের দুর্ভোগ বয়ে আনবে”।

জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরও এর সমালোচনা করেছে, সেখানকার এক প্রতিনিধি বলেছেন যে “এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত এবং কোন জায়গায় তা ব্যবহার করা উচিত না”।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এই পদক্ষেপকে ‘বেপরোয়া পদক্ষেপ’ এবং ইউক্রেন ‘পাল্টা-আক্রমণ’ বলে যে প্রচারণা চালিয়েছে সেই ব্যর্থতার ঢাকতে ‘পুরুষত্বহীনতার প্রমাণ’ বলে বর্ণনা করেছেন।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভাও বলেছেন যে, “ইউক্রেনের আশ্বাস তারা এই ক্লাস্টার বিস্ফোরক দায়িত্বের সাথে ব্যবহার করবে। কিন্তু তাদের এমন বক্তব্য মূল্যহীন।”

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এর আগে ইউক্রেনে প্রক্সি যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের অভিযুক্ত করেছিলেন।

গত মাসে শুরু হওয়া ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ পূর্ব দোনেৎস্ক এবং দক্ষিণ-পূর্ব জাপোরিশা অঞ্চলে এখনও চলছে।

গত সপ্তাহে, ইউক্রেনের সামরিক কমান্ডার-ইন-চিফ ভ্যালেরি জালুঝনি বলেছেন যে, পর্যাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্রের অভাবের কারণে অভিযানটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিনি পশ্চিমাদের প্রতিশ্রুত অস্ত্রের ধীরগতিতে হতাশা প্রকাশ করেন।

বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনারের বিশ্লেষণ

আমেরিকার নেটো মিত্ররা একের পর এক ইউক্রেনকে বিতর্কিত ক্লাস্টার বোমা সরবরাহের সিদ্ধান্ত থেকে নিজেদের দূরে রাখার বিষয়ে একমত হয়েছে। ব্রিটেন, কানাডা, স্পেন এ ধরণের অস্ত্র পাঠানোর সমালোচনা করেছে।

এমনকি রাশিয়াও এর নিন্দা করেছে, যদিও দেশটি নিজেরাই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করেছে।

তবে ইউরোপে নেটোর প্রাক্তন ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল স্যার রিচার্ড শিরেফ এই সিদ্ধান্তের পক্ষে বলেছেন, এই অস্ত্রের ফলে ইউক্রেনের জন্য রাশিয়ান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া সহজ হবে।

তিনি বলেছেন, পশ্চিমারা যদি আরও দ্রুত অস্ত্র সরবরাহ করত, তাহলে এখন এই অস্ত্র দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।


Spread the love

Leave a Reply