ইউক্রেন তার পাল্টা অভিযানে কতটা সাফল্য পেতে পারে?

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘এটাকে পাল্টা অভিযান বলবেন না’ – বলছেন ইউক্রেনীয়রা, “এটাই আমাদের আসল অভিযান, রাশিয়ন বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে আমাদের ভূমি থেকে তাড়ানোর জন্য এটাই সুযোগ।”

ঠিক আছে, কিন্তু এতে সাফল্য পেতে গেলে আসলে কী কী দরকার?

প্রথম কথা হচ্ছে, অভিযান শুরু হবার পর ইউক্রেনীয় বাহিনী পূর্ব দোনেৎস্ক এবং দক্ষিণ-পূর্ব জাপোরিশা অঞ্চলে কিছু অপরিচিত এবং প্রায়-জনশূন্য গ্রাম পুনর্দখল করেছে – তবে এসব খবর যেন আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে না নেয়।

এগুলোর জন্য তীব্র লড়াই হয়েছে, তবে পুনর্দখল করা ভূমির পরিমাণ খুবই সামান্য।

তা ছাড়া গত কয়েক মাসের অচলাবস্থার পর – বুলেটে-ঝাঁঝরা কিছু ভবনের সামনে নীল-হলুদ পতাকা ওড়ানো রণক্লান্ত বিজয়ী ইউক্রেনীয় সৈন্যদের ছবি যে সেদেশের লোকের মনোবল বাড়িয়ে দেবে তাতেও সন্দেহ নেই।

কিন্তু আপনি যদি বৃহত্তর কৌশলগত চিত্রটির দিকে তাকান – তাহলে এগুলো তেমন বড় ব্যাপার নয়।

আসল লক্ষ্য ক্রাইমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা

রাশিয়ার দখলে থাকা যে জায়গাটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো দক্ষিণাঞ্চলটি – যে জায়গাটার অবস্থান জাপোরিশা শহর এবং আজোভ সাগরের মাঝ বরাবর।

এটিই হচ্ছে সেই ‘ল্যান্ড করিডোর’ যা অবৈধভাগে অঙ্গীভূত করা ক্রাইমিয়ার সাথে রাশিয়ার মূলভূমিকে যুক্ত করেছে। নিচের ম্যাপে যে স্থানটিকে গোলাপি রঙে চিহ্নিত করা আছে – তার মাঝখানের অংশটি।

গত বছর রুশ অভিযান শুরুর পরের প্রথম কিছু সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত এই জায়গাটির পরিস্থিতিতে তেমন কোনই পরিবর্তন হয়নি।

ইউক্রেন যদি এ জায়গাটিকে দু-টুকরো করে ফেলতে পারে এবং মাঝখানের অংশটি দখলে রাখতে পারে – তাহলেই বলা যাবে যে তাদের এই পাল্টা অভিযান একটা সাফল্য পেয়েছে।

সেটা করতে পারলে পশ্চিম দিকে থাকা রুশ সৈন্যদেরকে তারা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারবে এবং ক্রাইমিয়াতে থাকা তাদের গ্যারিসনগুলোতে রসদপত্র পাঠানো কঠিন করে তুলতে পারবে।

এর ফলে কিন্তু এই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে না – বরং অনেকে এখন বলছেন যে এ যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে ।

তবে যখন অবধারিতভাবেই একটা শান্তি আলোচনা শুরু হবে – তখন এটা ইউক্রেনকে দরকষাকষি করার জন্য একটা শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাবে।

ইউক্রেনের পুনর্দখল করা চারটি গ্রাম
ইউক্রেনের পুনর্দখল করা চারটি গ্রাম

রাশিয়া ঠিক এখানেই দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলেছে

কিন্তু এই মানচিত্র রাশিয়াও দেখেছে বেশ কিছুকাল আগেই এবং তারাও এই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।

এ জন্যই , যখন ইউক্রেন পাল্টা অভিযানের জন্য ১২পি সাঁজোয়া ব্রিগেডকে তৈরি করছিল এবং তার সৈন্যদেরকে প্রশিক্ষণের জন্য নেটো দেশগুলোতে পাঠাচ্ছিল, সে সময়টাকে মস্কোও কাজে লাগিয়েছে এবং এর মধ্যে তারা এমন এক ব্যুহ গড়ে তুলেছে – যাকে বলা হচ্ছে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যূহ।’

ইউক্রেনীয় বাহিনী যেন দক্ষিণের উপকুল পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে – সেই পথ আটকে এখানে পাতা হয়েছে একের পর এক মাইনফিল্ডের সারি, কংক্রিটের ‘ট্যাংক ব্লকার’ বাংকার ( সামরিক ভাষায় একে বলা হয় ‘ড্রাগন’স টিথ’ বা ড্রাগনের দাঁত), ফায়ারিং পজিশন অর্থাৎ গোলাবর্ষণের জন্য কামান বসানোর জায়গা, এবং ট্রেঞ্চ বা পরিখা। এসব পরিখা এতই গভীর যে লেপার্ড-টু বা এমওয়ান এব্রামস ট্যাংকও এগুলো পার হতে পারবে না।

এগুলোকে ‘কভার’ দেবার জন্য আছে আগে থেকে নির্ধারিত ‘আর্টিলারি ইমপ্যাক্ট জোন’।

এগুলো এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে ইউক্রেনের সাঁজোয়া যান এবং তাদের ক্রুরা যখন সামনে এগুনোর রাস্তা বের করতে ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে – তখন তাদের ওপর বৃষ্টির মত উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা যাবে।

যদিও এ যুদ্ধ এখনো প্রাথমিক স্তরে আছে, তার পরও আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে রাশিয়ার এই প্রতিরক্ষাব্যুহ ভালোভাবেই কাজ করছে।

দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেন জুড়ে রাশিয়ার দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যূহ
দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেন জুড়ে রাশিয়ার দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যূহ

যেসব বিষয় ইউক্রেনীয়দের সুবিধা দেবে

ইউক্রেন এখনো এ অভিযানে তাদের পুরো বাহিনীকে নামায় নি। তাই এগুলোকে বলা যায় পর্যবেক্ষণমূলক আক্রমণ – যার মাধ্যমে বের হয়ে আসবে যে কোথায় কোথায় রুশ কামানগুলো বসানো আছে এবং তাদের প্রতিরক্ষাব্যূহে কোথায় ফাঁকফোকর আছে।

ইউক্রেনের পক্ষে যা আছে তা হলো মনোবল। তার সৈন্যরা মানসিকভাবে উজ্জীবিত এবং একটি অনুপ্রবেশকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের নিজ দেশকে মুক্ত করতে তারা লড়ছে।

রুশ বাহিনীর বড় অংশেরই এ ধরনের মনোবল নেই। অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণ, সাজসরঞ্জাম এবং নেতৃত্ব ইউক্রেনের চেয়ে নিকৃষ্ট।

কিয়েভের জেনারেল স্টাফ আশা করছে যে তারা যদি রুশ ব্যূহে একটা বড় ভাঙন ধরাতে পারে, তাহলে রুশ মনোবল ভেঙে পড়বে এবং তা পুরো যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, হতোদ্যম রুশ সৈন্যরা লড়াই করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলবে।

ইউক্রেনের জন্য আরো যেটি সুবিধা তা হলো – নেটো দেশগুলোর দেয়া উন্নত মানের সরঞ্জাম।

রুশদের সোভিয়েত-যুগের সাঁজোয়া যানের তুলনায় নেটোর ট্যাংক ও সামরিক যানগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই সরাসরি গোলার আঘাত সহ্য করতে পারে। বা অন্তত তার ভেতরে থাকার ক্রুদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে – যাতে তারা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।

ইউক্রেনীয়দের দুর্বলতা কোথায়

একটি লড়াইয়ে পশ্চিমাদের দেয়া ইউক্রেনীয় ট্যাংক ধ্বংস করার দাবি করছে রাশিয়া
একটি লড়াইয়ে পশ্চিমাদের দেয়া ইউক্রেনীয় ট্যাংক ধ্বংস করার দাবি করছে রাশিয়া

কিন্তু সেটা কি রাশিয়ার কামান ও ড্রোন হামলার শক্তির মোকাবিলা করার জন যথেষ্ট?

রাশিয়া যেহেতু অনেক বড় দেশ তাই তাদের সম্পদ ইউক্রেনের চেয়ে বেশি।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন যুদ্ধ শুুরু করেন, তখন তিনি জানতেন যে ইউক্রেনকে যদি একটা অচলাবস্থায় আটকে ফেলা যায় এবং যুদ্ধকে পরের বছর পর্যন্ত টেনে নেয়া যায় – তাহলে এমন সম্ভাবনা আছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই ব্যয়বহৃল যুদ্ধ চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং একটা আপোষরফার যুদ্ধবিরতি করার জন্য ইউক্রেনের ওর চাপ সৃষ্টি করবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে ‘এয়ার কভার’ অর্থাৎ মাটিতে যুদ্ধরত বাহিনীকে আকাশ থেকে সুরক্ষা দেবার প্রশ্নটি।

বিমান সুরক্ষা ছাড়া ঘাঁটি গেড়ে বসা শত্রুকে আক্রমণ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

ইউক্রেন এটা জানে বলেই অনেক দিন ধরে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পাবার জন্য আবেদন জানিয়ে আসছে।

এফ সিক্সটিন বিমান তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মে-র শেষদিক পর্যন্ত এ আবেদনে সাড়া দেয়নি। ততদিনে ইউক্রেনের পাল্টা অভিযানের প্রথম পর্ব শুরু হয়ে গেছে।

ইউক্রেনের জন্য সমস্যা হলো, তাদের পাল্টা অভিযানের শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার মতো এই জেট বিমানগুলো আসতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

ইউক্রেন এখনো জিততে পারে

একথা বলার বলার অর্থ এই নয় যে ইউক্রেনীয়রা এ যুদ্ধে হেরে যাবে।

তারা এ পর্যন্ত বার বার নিজেদের ক্ষিপ্র এবং সৃষ্টিশীল বলে প্রমাণ করেছে। তারা খেরসন থেকে রুশ বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। সেখানে তারা এমনভাবে রুশ রসদপত্র আনা-নেয়ার কেন্দ্রগুলোতে আক্রমণ চালিয়েছে যাতে ওই শহরে থাকা সৈন্যদেরকে রুশরা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাঠাতে পারেনি।

ব্রিটেনের স্টর্ম শ্যাডোর মত দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পাবার পর ইউক্রেন হয়তো আবার সেই একই কৌশল নিতে পারে।

তবে যুদ্ধের সময় দাবি-পাল্টা দাবির প্রপাগান্ডা লড়াইও চলতে থাকে। এর ভেতরে কে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জয় পাবে তার স্পষ্ট চিত্র পেতে হলে আমাদের হয়তো কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।


Spread the love

Leave a Reply