ইটালি চিকিৎসকরা বললেন ‘আমাদের বেছে নিতে হচ্ছে কোন রোগীকে চিকিৎসা দেব, কাকে দেব না

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ ইটালিতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম সারিতে থাকা চিকিৎসকরা বলছেন যে, এত রোগীর ভিড় যে কাদের তারা বাঁচানোর চেষ্টা করবেন এবং কাদের ফেলে রাখবেন তা তাদেরকে বেছে নিতে হচ্ছে।

নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখনও প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা গড়ে একশ জন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই বিপুল পরিমাণ রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য হাসপাতালের পর্যাপ্ত বিছানার ব্যবস্থা করতে রীতিমত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তারা। যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়া কোন দেশের এমন পরিস্থিতি ভাবা যায় না।

উত্তরাঞ্চলীয় লম্বার্ডিয়া অঞ্চলের বার্গামো শহরের একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের প্রধান ডা. ক্রিশ্চিয়ান সালারোলি ক্যুরিয়েরে ডেলা সেরা নামে এক সংবাদপত্রকে তার হাসপাতালের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, “৮০ থেকে ৯৫ বছর বয়সের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি ভীষণ শ্বাসকষ্টে ভোগেন তবে আপনি চিকিৎসার জন্য এগিয়ে যেতে চাইবেন না।”

“এগুলো ভয়াবহ কথা, তবে আফসোসের বিষয় যে এটি সত্যি ।”

কাকে বাঁচাতে কতটা চেষ্টা করবেন – ইটালিতে চিকিৎসকরা এখন সেই কঠিন নৈতিক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছেন।

চিকিত্সকরা নেপলসে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরেছেন।
ইতালিতে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে।

‘বেছে নেয়ার কঠিন প্রক্রিয়া’

করোনাভাইরাসে ইটালিতে শুক্রবার পর্যন্ত ১৭,৬৬০ সংক্রমিত হয়েছেন। এরমধ্যে মারা গেছেন ১,২৬৮ জন, যেটা চিনে মৃত্যুর প্রায় এক তৃতীয়াংশ।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যার দিক থেকে জাপানের পর বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইটালি। যার অর্থ যদি ভাইরাসটি ঐ বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমিত হয় তাহলে তারা মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকবেন।

এই মাসের শুরুতে, ইটালিয়ান সোসাইটি অব অ্যানাস্থেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া, পুনর্বাসন ও ইন্টেনসিভ থেরাপি (এসআইএএআরটিআই) কিছু নৈতিক সুপারিশ প্রকাশ করেছে।

সেখানে ডাক্তারদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র কাদের নিবিড় পরিচর্যার জন্য শয্যা দেয়া হবে।

যার অর্থ দাঁড়ায়, প্রয়োজন হলেও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে প্রত্যেকের জন্য জায়গা থাকবে না।

আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে রোগীদের ভর্তি করার পরিবর্তে, চিকিৎসক ও নার্সদের এক কঠিন বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

নিবিড় চিকিৎসায় যাদের সেরে ওঠার সম্ভাবনা বেশি সেই রোগীদের প্রতি মনোনিবেশ করার কথা বলা হয়েছে।

এসআইএএআরটিআই বলছে – ‘কিছু রোগীকে চিকিৎসা দেয়া এবং অন্যদের জন্য চিকিৎসা সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব তারা দেয়নি। অপর দিকে, এটি একটি জরুরি পরিস্থিতি যেখানে চিকিৎসকদের বাধ্য করা হচ্ছে তারা যেন চিকিৎসার উপযোগিতার দিকে মনোযোগ দেন। তাদেরকেই চিকিৎসা দেন যাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’

লম্বার্ডির ব্র্রেসিয়ায় একটি হাসপাতালের বাইরে অস্থায়ী জরুরি ওয়ার্ড স্থাপন করা হয়েছে
উত্তর ইতালির হাসপাতালগুলোয় শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর জন্য স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে।

‘সুনামি’

ইতালিতে প্রায় ৫,২০০টি নিবিড় পর্যবেক্ষণ শয্যা রয়েছে। কিন্তু শীতকাল হওয়ায় এর মধ্যে অনেক রোগী শ্বাসকষ্টজনিত রোগ নিয়ে ওই শয্যাগুলোয় ভর্তি আছেন।

লম্বার্ডি এবং ভেনেটোর মতো উত্তরাঞ্চলীয় শহরগুলোয় বেসরকারি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাত্র ১৮০০টি শয্যা রয়েছে।

লম্বার্ডির একটি হাসপাতালে কর্মরত ডাঃ স্টেফানো ম্যাগনান বিবিসিকে বলেন, তারা তাদের সক্ষমতা শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন।

“দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, কারণ আমরা করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য আইসিইউ শয্যার সংখ্যা, পাশাপাশি সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর সক্ষমতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।”

“আমাদের প্রদেশে, জনবল ও প্রযুক্তি দুটি সম্পদ সম্পূর্ণভাবে ফুরিয়ে গেছে, আমরা এখন কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের নতুন যন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করছি।”

এই সপ্তাহের শুরুতে, বার্গামোর আইসিইউ চিকিতৎসক ডা. ড্যানিয়েলে ম্যাশিনির একটি সাক্ষ্য টুইটারে ভাইরাল হয়।

সেখানে তিনি বর্ণনা করেন যে কীভাবে তাঁর দল রোগীদের ‘সুনামিতে’ ডুবে গিয়েছিল এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম যেমন ভেন্টিলেটর কতটা মূল্যবান হয়ে উঠেছিল। তার কথায় অনেকটা “স্বর্ণের মতো”।

“আক্রান্তের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই একটি কারণে আমাদের এখানে প্রতিদিন ১৫-২০ জন রোগী ভর্তি হতে আসছেন। মুখের লালা পরীক্ষার ফলাফল আসছে একের পর এক। সবই পজিটিভ, পজিটিভ, পজিটিভি। হঠাৎ জরুরি বিভাগ যেন মানুষের ভিড়ে ভেঙে পড়ছে, ” তিনি বলেন।

“আমাদের কিছু সহকর্মী যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত, তারা তাদের স্বজনদের সংক্রমিত করেছেন। এবং তাদের কয়েকজন আত্মীয় ইতিমধ্যে জীবন এবং মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।”

ডাঃ সালারোলি, ক্যুরিয়েরে পত্রিকাকে বলেছেন যে, চিকিৎসা কর্মীদের উপর যে আবেগের বোঝা চাপানো হয়েছে এর প্রভাবে তারা ভেঙ্গে পড়েছেন।

তার দলের কিছু চিকিৎসক, যাদেরকে রোগী বেছে নেয়ার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তারা “চূর্ণ-বিচূর্ণ” হয়ে গেছেন।

“একজন প্রধান চিকিৎসকের পাশাপাশি একজন তরুণ চিকিৎসক যিনি সবেমাত্র যোগ দিয়েছেন, তাকেও এমন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হতে পারে। তিনি এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারেন যে তাকে একজন মানুষের ভাগ্যের সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। এটি ব্যাপক হারে হচ্ছে, আবারও বলছি।,” তিনি বলেন।

“আমি ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞ একজন নার্সকে কাঁদতে দেখেছি।”

ইতালির পাদোয়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসক ও নার্সরা কাজ করছেন
চিকিত্সা কর্মীরা বলছেন যে তারা বিশাল মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন।

বিবিসির সাথে কথা বলতে গিয়ে ইটালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইজি ডি মাইও, ইউরোপজুড়ে থাকা সমস্ত হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সামগ্রী ও সেবা সমন্বিত করার জন্য একটি একক ইউরোপীয় ইউনিট প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে তিনি আশার একটি কথাও বলেছেন যে উত্তর ইটালির দশটি শহরে- যেগুলোকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল- কোনও সংক্রমণ রেকর্ড করা হয়নি।

“ইটালি, ইউরোপের প্রথম দেশ যেটি এত গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়েছে,” বলেন ডি মাইও। “তবে আমি আশা করি এটা এই অর্থও বহন করে যে ইটালিই সবার আগে জরুরি অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।”


Spread the love

Leave a Reply