ইতালির ভুতুড়ে নগরী মিলান থেকে বাংলাদেশি নারী: ‘অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে জানি না’

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ জেল থেকে বন্দীদের পলায়ন। জেলখানায় আগুন। রাস্তায় পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ। সরকারি নিষেধাজ্ঞার এড়িয়ে পালানোর জন্য রেলস্টেশন-বাস টার্মিনালে শত শত মানুষের ভিড়। জনশূন্য শপিং মল। বন্ধ দোকানপাট। অর্থনীতিতে বিরাট মন্দার আশংকা।

কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের খবর নয় এগুলি। গত কদিন ধরে ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি ইতালি থেকে এসব খবরই এখন সারা দুনিয়ায় সংবাদ শিরোনাম। করোনাভাইরাস যেন মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশটিতে বিরাট ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়েছে।

পরিস্থিতি এখন এতটাই আয়ত্ত্বের বাইরে চলে গেছে বলে মনে করছে সরকার, গতকাল প্রধানমন্ত্রী জুসেপে কন্টি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে পুরো দেশজুড়েই এখন কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছেন। যারা এসব বিধিনিষেধ উপেক্ষা করবেন, তাদের জেল-জরিমানা পর্যন্ত হতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালি জুড়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এরকম ব্যাপক ব্যাঘাত আর দেখা যায়নি।

হাঙ্গামা ঠেকাতে ইটালির নগরীগুলোর রাস্তায় রাস্তায় এখন পুলিশ
হাঙ্গামা ঠেকাতে ইটালির নগরীগুলোর রাস্তায় রাস্তায় এখন পুলিশ

প্রধানমন্ত্রী জুসেপে কন্টি পরিস্থিতি কতটা গুরুতর তা বর্ণনা করতে গতকাল ধার করেছিলেন দ্বিতীয় যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের কথা। তিনি বলেছেন, ইতালির জন্য এটি হয়তো অন্ধকারতম সময়, কিন্ত সঠিক আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতালিয়ানরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে নিতে পারবে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর জন্য ইতালি প্রথমে কেবল উত্তরাঞ্চলের আক্রান্ত প্রদেশগুলোতেই মানুষের চলাফেরা এবং অন্যান্য কাজকর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা এড়াতে যখন হাজার হাজার মানুষ দেশের অন্যত্র পালিয়ে যেতে শুরু করলো, তখন সারাদেশকেই এর আওতায় আনা ছাড়া আর উপায় রইলো না।

‘আমরা আতংকের মধ্যে আছি’

ইতালির করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান কেন্দ্র যে অঞ্চলটি, সেই অঞ্চলের বড় একটি নগরী মিলানে থাকেন বাংলাদেশের সাংবাদিক ফেরদৌসি আক্তার। দেশজুড়ে জারিকরা নিষেধাজ্ঞার পর তাদের এখনকার জীবনযাত্রা সম্পর্কে বিবিসিকে জানিয়েছেন তিনি।

“আমরা চীনের উহান শহরের কথা শুনেছিলাম। সেই শহরটি নাকি একদম আলাদা করে ফেলা হয়েছিল। এখন আমরাই সেরকম এক রেড জোনের বাসিন্দা। শনিবার রাতে যখন প্রথম এই ঘোষণা শুনি, আমরা আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম।”

মিলানের জনশূন্য রাস্তায় স্বামীর সঙ্গে বাংলাদেশি সাংবাদিক ফেরদৌসী আক্তার।
মিলানের জনশূন্য রাস্তায় স্বামীর সঙ্গে বাংলাদেশি সাংবাদিক ফেরদৌসী আক্তার।

“আমরা ভয় পাবো না কেন? শুধু আমাদের অঞ্চলেই আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬,০০০। হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে ৬৯৫ জন মানুষকে। খুবই ভয়ে আছি। অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে জানি না। আমি আজ কাজে যেতে পারিনি।”

“বাইরে গেলেই পুলিশ কাগজপত্র দেখতে চাইছে। কেন তাদের বাড়ির বাইরে যেতে হচ্ছে তার কারণ জানতে চাইছে।”

“বাইরে দোকানপাট-রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ। আমি গতকাল কাজে যাব বলে বেরিয়েছিলাম। তখন দেখেছি রেস্টুরেন্টগুলো ফাঁকা, কেউ নেই। মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি মেট্রো, বাস কিছুই সময়মত চলছে না। মনে হচ্ছে একটা ভুতুড়ে পরিবেশ। এরপর ভয়ে আর কাজে যাইনি। ডাক্তারখানায় গিয়ে দেখলাম সবাই ডাক্তারের কাছ থেকে অসুস্থতার ছুটি যাওয়ার জন্য চিঠি নিচ্ছে। ডাক্তার কিছু জিজ্ঞেস না করেই সবাইকে চিঠি দিয়ে দিচ্ছে।”

“সুপারমার্কেটগুলোতে সব জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। আজ সকালে সুপারমার্কেটে গিয়ে দেখি সকালবেলাতেই তাক খালি, পাস্তা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বেবি ফুড পর্যন্ত নেই। আমি কয়েক পিস পাউরুটি নিয়ে ঘরে ফিরলাম।”

“আমার পরিচিত এক প্রবাসী বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। উনি আটদিন ছিলেন হাসপাতালে। তবে এখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছেন।”

কিন্তু এসব ব্যবস্থায় কি কাজ হবে?

জেলখানাগুলোতে বন্দীরা বিদ্রোহ করেছে, অনেক বন্দী পালিয়ে গেছে
জেলখানাগুলোতে বন্দীরা বিদ্রোহ করেছে, অনেক বন্দী পালিয়ে গেছে

পুরো দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ। ফুটবল ম্যাচ, কনসার্ট থেকে শুরু করে বড় বড় শপিং মল বন্ধ। লোকজনকে বাড়ি থেকে বাইরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। ইতালির নামকরা যেসব ফ্যাশন ব্রান্ড- সেগুলোর অর্ডার কমে গেছে। একটা বড় ধরণের অর্থনৈতিক মন্দা ইতালিতে এখন সময়ের ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাস ঠেকাতে এই যে এত ব্যাপক এবং কঠোর সব পদক্ষেপ নিয়েছে ইতালি, তাতে কি শেষ পর্যন্ত ফল পাওয়া যাবে? এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা ধরণের মত দেখা যাচ্ছে।

ট্রেনগুলো ফাঁকা, লোকজন ভয়ে বাইরে বেরুচ্ছে না
ট্রেনগুলো ফাঁকা, লোকজন ভয়ে বাইরে বেরুচ্ছে না

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের ভেটেরিনারি এপিডেমিওলজি এবং ডাটা সায়েন্সের অধ্যাপক রোবল্যান্ড কাও বলছেন, এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা ইটালির অর্থনীতির ওপর এক মারাত্মক বোঝা চাপিয়ে দেবে। আর এটি যদি খুব বেশিদিন চলে লোকে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠবে।

লন্ডন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জন এডমান্ডস বলেন, ইটালি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা অভূতপূর্ব এবং নিশ্চিতভাবেই এরকম নিষেধাজ্ঞা বেশিদিন জারি রাখা যাবে না। তবে এতে করে করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব কিছুটা পিছিয়ে দেয়া যাবে।

ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার মেডিসিনের অধ্যাপক পল হান্টার বলছেন, গত ৫০ বছরে কোন দেশে কোন রোগ দমনের জন্য এরকম ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই। এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা যদিও চীনের উহানে সফল হয়েছে, ইতালিতে তা কতটা ফল দেবে সেটা দেখতে হবে।


Spread the love

Leave a Reply