গাজা-ইসরাইল যুদ্ধঃ ইসরায়েলের যে গ্রামে ঢুকে গণহত্যা চালায় হামাস

Spread the love

বাংলা সংলাপ রিপোর্টঃ 

সতর্কতা: এই নিবন্ধে এমন বিবরণ রয়েছে যা কিছু পাঠক বিরক্তিকর বলে মনে করতে পারে ।

গাজা এবং ইসরায়েল সীমান্তের কাছের গ্রাম কাফার আজা। এ গ্রামটি যেন যুদ্ধের প্রথম কয়েক দিনের একটি প্রতিচ্ছবি। এখান থেকে ধারণা পাওয়া যায়, এরপর কী ঘটতে পারে।

সীমান্তের কাছে ইসরায়েলি অধ্যুষিত এলাকায় মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত লড়াই চলেছে। শনিবার সকালে সীমান্তের কাঁটাতার ভেঙ্গে হামাস সদস্যরা গ্রামে ঢুকে যাদের হত্যা করেছে তাদের মৃতদেহ সংগ্রহ করতেই এখন ব্যস্ত গ্রামবাসী।

সারাদিন ধরে বেসামরিক নাগরিকদের মৃতদেহের ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন যেসব ইসরায়েলি সেনা, তারা বলছেন সেখানে আসলে গণহত্যা হয়েছে। তাদের কাছে মনে হয়েছে শনিবার আক্রমণের প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

ইসরায়েলের প্যারাট্রুপারদের একটি অভিজ্ঞ দলের ডেপুটি কমান্ডার দাভিদি বেন জায়ন জানিয়েছেন যে ইসরায়েলি সেনাদের ১২ ঘণ্টা লেগেছে গ্রামটিতে পৌঁছাতে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমরা অনেক শিশু ও তাদের অভিভাবকদের জীবন রক্ষা করতে পেরেছি। দু:খজনকভাবে ককটেলে অনেকের শরীর পুড়ে গেছে। তারা (হামাস) ছিল খুব আগ্রাসী, পশুর মতো,” বলছিলেন তিনি।

মি. বেন জায়ন বলছেন যে হামাস বন্দুকধারীরা শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে।

“তারা সবাইকে খুন করেছে, যাদের কোন অস্ত্র ছিলো না, কিছুই ছিলো না। একেবারেই সাধারণ নাগরিক যারা সকালের নাশতা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন”।

এর মধ্যে কয়েকজনের শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে।

“তারা এদের হত্যা করেছে এবং তাদের শিরোচ্ছেদ করেছে। এটা দেখাটাই মারাত্মক ব্যাপার। এবং আমাদের মনে রাখা দরকার যে আমাদের শত্রু কারা এবং ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের লক্ষ্য কী। এবং বিশ্বকে এখন আমাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত”।

মৃতদেহ বহনকারী একটি ব্যাগের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরেকজন বললেন যে তাকে খুন করার পর তার শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে সামনের বাগানে।

Israeli troops stand guard outside Kfar Aza kibbutz

কয়েক গজ দূরেই হামাসের এক মৃত বন্দুকধারীর শরীরের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছিলো।

কাফার আজা গ্রামটিই আসলে হামাস বন্দুকধারীদের মানবতা বিরোধী অপরাধের একটি প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

আরও অন্য প্রতিবেশী গ্রামগুলোর মতো এই গ্রামের মানুষের কাছে এটি এসেছে একটি বিস্ময় হয়ে।

কিবুতয গ্রামের নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা আসলে সামরিক অভিজ্ঞতা আছে এমন গ্রামবাসীদের নিয়েই তৈরি হয়েছিলো। তারা হামলাকারীদের সাথে লড়াইয়ে নিহত হয়েছে।

অপরাপর ইসরায়েলিদের মতো কালো প্লাস্টিক ব্যাগে করে গ্রামের কেন্দ্র থেকে তাদের মৃতদেহ সরানো হয়েছে মঙ্গলবার সকালে।

এর আগে ২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকে গাজার সীমান্ত সংলগ্ন ইসরায়েলি গ্রামগুলোর মানুষ বিভিন্ন সময়ে রকেট হামলা দেখেছে।

হামাসের হুমকি সত্ত্বেও কাফার আজা এবং অন্য ইসরায়েলি কমিউনিটিগুলোতে একটি সুন্দর জীবনই উপভোগ করে আসছিলেন।

কিন্তু ঘরবাড়িগুলো বা কিবুতযের লন ও খোলা জায়গাগুলো কিংবা কংক্রিটের আশ্রয়স্থলগুলো হানাহানি থেকে দূরে ছিলো না।

ঘরগুলো সেইফরুম ছিলো। এর বাইরে বাগান, বারবিকিউ, বাচ্চাদের খেলার জায়গা এবং বিশুদ্ধ বাতাস- সবই ছিলো।

Homes attacked in Kfar Aza kibbutz

তবে ইসরায়েলের অন্য সব জায়গার মতো এখনকার মানুষও ভাবতে পারেনি যে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙ্গে হামাস সেখানে হামলা চালিয়ে এত মানুষ খুন করতে পারে।

ভয় আর নৃশংসতার মধ্যে তারা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দেখেছে রাষ্ট্র ও সামরিক বাহিনী নাগরিকদের সুরক্ষার মৌলিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

নিহত হামাস বন্দুকধারীদের মৃতদেহ খোলা আকাশের নীচেই পড়েছিলো। সেখানেই ছিল তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলগুলো যেগুলো ব্যবহার করে তারা গ্রামটিকে এসেছিলো।

পাশেই দেখা গেছে প্যারাগ্লাইডারের ধ্বংসাবশেষ। এগুলোতে করে হামাস বন্দুকধারীরা এসেছিল।

ঘটনার পর তাদের আরেক অভিজ্ঞতা ছিলো গ্রামটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য ইসরায়েলি সেনাদের লড়াই। সেখানে এখন মোতায়েন আছে অনেক সেনা।

একজন কমান্ডারকে দেখা গেল গাজার দিকে একটি ভবনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার আদেশ দিতে। এরপরই শোনা গেলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ।

গাজায় তখন বিমান হামলা চলছিল। শনিবারের ঘটনায় নিজেদের বহু নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় পুরো ইসরায়েল এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

তবে গাজাতেও অনেক বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। আন্তর্জাতিক আইনে বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষার কথা বলা হয়েছে।

এটা পরিষ্কার যে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক হত্যা করে হামাসের হামলাকারীরা যুদ্ধ সম্পর্কিত আইনগুলোর মারাত্মক লঙ্ঘন করেছে।

তবে হামাসের হামলায় নিহত বেসামরিক নাগরিকদের সাথে ফিলিস্তিনের বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুর তুলনাকে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল।

মেজর জেনারেল আইতাই ভেরুব কিবুতয পুনর্দখলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার দাবি ইসরায়েল যুদ্ধ আইনকে সম্মান করে এর বাধ্যবাধকতা মেনে চলেছে।

“আমি নিশ্চিত আমরা যুদ্ধ করছি আমাদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির জন্য…আমরা শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক কিন্তু আমরা আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখি। আমরা ইসরায়েলি, আমরা ইহুদি”।

যুদ্ধ আইনগুলো লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।

তবে এটা নিশ্চিত যে যত বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হবে ইসরায়েলকে তত বেশি সমালোচনার মুখে পড়তে হবে।

একজন সেনা তার নাম বলতে রাজী হননি। তিনি বলছিলেন যে যখন তারা গ্রামটিতে পৌঁছান তখন সেখানকার ‘সব জায়গায় সন্ত্রাসীরা’।

Homes attacked in Kfar Aza kibbutz

লড়াই কতটা কঠিন ছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না”।

সৈন্য হিসেব এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে?

“না, এমন না”।

এরপর কী হবে?

“আমি জানি না, আমাকে যা বলা হয় তাই করি। আমি ভেতরে যাব”।

গাজার ভেতরে ? কঠিন লড়াই হবে ।

“হাঁ, আমরা প্রস্তুত এর জন্য”।

এসব সৈন্যরা মূলত রিজার্ভ ফোর্সের। ঐতিহাসিকভাবে মিলিটারি সার্ভিসকে জাতি গঠন বা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দাভিদি বেন জায়ন অবশ্য স্বীকার করেন যে ইসরায়েলে রাজনৈতিক বিভক্তি গভীর- তবে এখন আক্রমণের মুখে পড়ায় সবাই ঐক্যবদ্ধ।

গ্রামটিতে দেখা যাচ্ছিলো সৈন্যরা ধ্বংস হওয়া বাড়িঘর থেকে সাবধানে মৃতদেহগুলো সরিয়ে আনছিলেন। কারণ এগুলোর সাথেও ফাঁদ হিসেবে রাখা হতে পারে বিস্ফোরক। একটি বাগানের কাছেই দেখা গেলো গ্রেনেড।

এর মধ্যেই হামাসের রকেট হামলার সতর্কবার্তাও বেজে যাচ্ছিলো মাঝে মধ্যেই।


Spread the love

Leave a Reply