ঢাকায় ঘনঘন আগুন লাগার ঘটনায় নাশকতার সন্দেহ কেন?

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে গত সাড়ে তিন মাসের মধ্যে বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগ ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। সবচেয়ে ভয়াবহ কয়েকটি আগুনের ঘটনা ঘটেছে গত একমাসে ঢাকার বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটের মতো বড় মার্কেটগুলোতে।

বাংলাদেশে বড় মার্কেট বা ভবনে আগুনের ঘটনা বিরল না হলেও এতো কাছাকাছি সময়ের মধ্যে পরপর কয়েকটি বিপণি বিতানে এরকম বড় মাত্রার আগুন লাগার ঘটনা নজিরবিহীন।

এরকম ঘটনায় খোদ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারাও বিস্ময় প্রকাশ করে তদন্ত করার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তাগিদ দিয়েছে।

কিন্তু এরকম ঘনঘন আগুন লাগার পেছনে কী কারণ রয়েছে? কেন এ নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন কর্মকর্তারা?

পরপর আগুন নিয়ে সন্দেহ

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা বলছেন, যদিও বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট কিংবা মশার কয়েল বা সিগারেট থেকে আগুন লেগে থাকতে পারে বলে তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, কিন্তু নাশকতা নিয়েও তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাইন উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’আমরা দুইটা কারণ নিয়ে এগোচ্ছি। এক হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট অথবা মনুষ্য সৃষ্ট কোন কারণ, হয়তো কয়েল বা কোন কিছু থেকে।

পরপর কয়েকটি আগুনের ঘটনায় নাশকতা হচ্ছে কিনা, সেই সন্দেহ তৈরি হওয়ায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন।

‘’আমি বলেছি, খতিয়ে দেখার জন্য। সেটা ইন্টেলিজেন্স বলতে পারবে। কারণ সেটা বের করার ক্যাপাবিলিটি আমাদের নেই। অনেকগুলো আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলেই আমরা বলেছি, এটা নাশকতা কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কম সময়ে এতোগুলো আগুনের ঘটনা এবং টাইমগুলোও একই রকমের, সেজন্যেই সন্দেহটা তৈরি হয়েছে,’’ তিনি বলছেন।

শুক্রবার নিউ সুপার মার্কেটের আগুনে দুইশ থেকে আড়াইশো দোকান পুড়ে গেছে। এর মাত্র কয়েকদিন আগে ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনে চার হাজারের বেশি দোকান পুড়ে যায়।

এই দুইটি মার্কেটেই আগুন লেগেছে ভোরে। একই প্যাটার্নের আগুন সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

শনিবার পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। নাশকতার প্রমাণ পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অবশ্য রবিবার বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অবশ্য বলেছেন, আগুন লাগার কারণ নিয়ে তদন্ত শেষ করার আগে তিনি কোন মন্তব্য করতে চান না।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘’প্রত্যেকটা আগুন লাগার পেছনে কারণ থাকে। ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট কিংবা এটা সেটা। নাশকতাও থাকে, আমরা এখনো সুনিশ্চিত নই। আমরা ইনকোয়ারি করছি।‘’

‘’সবার কাছে একটা প্রশ্ন জাগছে, এত ঘন ঘন এবং শেষ রাতেই দুর্ঘটনাগুলি ঘটে। এটা সবাই প্রশ্ন করছে। আমরা ইনকোয়ারির আগে, সঠিক তদন্তের আগে বলতে পারবো না। আমি সুনিশ্চিত না হয়ে কিছু বলছি না,’’ বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শনিবার ভোরে চাঁদনী চক ও আশেপাশের মার্কেটের মধ্যে থাকা একটি ফুট ওভারব্রিজ সরিয়ে নেয়ার কাজ করছিল ডিএসসিসি। সেই সময় বিদ্যুতের লাইনে আগুন লেগে যায়।

তবে সেই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে ডিএসসিসি বলেছে, ফুট ওভারব্রিজ থেকে অগ্নিকাণ্ডের স্থানটি অন্তত চারশো গজ দূরে। এছাড়া সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নও করে দেয়া হয়েছিল।

কেন এতো ঘনঘন আগুন লাগছে?

বাংলাদেশে এই বছরের সাড়ে তিন মাসেই অন্তত আটটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকার নবাবপুরে ১৪ই এপ্রিল রাতে লাগা একটি আগুনে গুদামঘর পুড়ে গেছে। ওই গুদামঘরে নবাবপুর মার্কেটের প্রায় অর্ধশত দোকানের মালামাল রাখা ছিল। তার তিনদিন আগে ১১ই এপ্রিল চকবাজারের একটি সিরামিক গুদামে আগুন লাগে।

বঙ্গবাজারে ৪ এপ্রিল আগুনে প্রায় চার হাজার দোকানপাট পুড়ে যায়।

এর কয়েকদিন আগে ২৭শে মার্চ ঢাকার মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুন আর কাপ্তান বাজারের জয়কালী মন্দির সংলগ্ন সুইপার কলোনিতে আগুন লাগে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার কড়াইল বস্তিতে আর ১৯শে ফেব্রুয়ারি গুলশানের একটি বহুতল ভবনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল।

অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব) আলী আহমেদ খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’যে ভবনগুলোয় আগুন লেগেছে, সেগুলো কিন্তু ফায়ার সার্ভিস আগে পরিদর্শন করে বলেছে যে, সেগুলো পুরোপুরি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এখানে ইলেকট্রিক্যাল লাইন, এয়ার কন্ডিশনিং,- এগুলো নিয়ম অনুসরণ করে করা হয়নি। তারা ভবনের নানারকম এক্সটেনশনও করেছেন, যা ফায়ার কোড মেনে হয়নি।‘’

‘’এখন অত্যধিক গরম পড়েছে। মার্কেটিংয়ের জন্য জিনিসপত্র বেশি নিয়ে আসা হয়েছে, সেগুলো হ্যাজার্ড অবস্থায় আছে। মানুষজনের চলাফেরা বেশি, সব মিলিয়ে পুরো জিনিসটাই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ফলে আগুন না লাগাটাই আসলে একটা মিরাকলের মতো ব্যাপার,‘’ তিনি বলছেন।

অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক স্থানে অনেকটা একই প্যাটার্নে আগুন লাগা কতটা স্বাভাবিক?

এই প্রশ্নের জবাবে অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার (অব) আলী আহমেদ খান বলছেন, ‘’এখানে একটা চিন্তার বিষয় আছে। তবে তদন্ত ছাড়া সেটা বলা ঠিক হবে না। আমার মনে হয়, ইন্টেলিজেন্সগুলোর উচিত এটা তদন্ত করে দেখা। যেভাবে মার্কেটগুলোয় আগুন লাগার ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।‘’

ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বঙ্গবাজার, ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের মতো বিপণি বিতানগুলোকে বহুদিন আগে থেকেই তারা অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন।

কিন্তু মার্কেট কর্তৃপক্ষ যেমন তাদের সেই নোটিশ আমলে নেয়নি, তেমনি কোন সংস্থাও সেসব কার্যকরে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাজধানীতে তারা ৫৮টি ভবনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এর সবগুলোই বাণিজ্যিক ভবন। এর মধ্যে নয়টি ভবন রয়েছে ‘অধিক ঝুঁকিপূর্ণ’।

অধিক ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় গাউছিয়া, ফুলবাড়িয়ার বরিশাল প্লাজা মার্কেট, টিকাটুলির নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, সদরঘাটের শরীফ মার্কেট, লালবাগের আলাউদ্দিন মার্কেট, চকবাজারের শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, সিদ্দিক বাজারের রোজ নীীল তিস্তা মার্কেট, মাশা কাটারা মার্কেট।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাইন উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’আমাদের কর্তব্য অতটুকু, ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা এবং নোটিশ দেয়া। তারপরে তো তারা কিছু করছেন না। এরপরেও তো আরও অনেকগুলো অর্গানাইজেশন আছে, তাদের কাজ করার কথা, করছেন না।‘’

‘’আমরা এখন থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভবনগুলোয় নোটিশ টাঙিয়ে দিচ্ছি। আমাদের আইন অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব সেটুকুই,’’ তিনি বলছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো ক্ষমতা দেয়া হয়নি। আবার তারা যেসব ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দেন, সেসব কার্যকরে একাধিক সংস্থার দায়িত্ব থাকে। তাদেরও সমন্বিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায় না।

অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার (অব) আলী আহমেদ খান বলছেন, ‘’সরকারিভাবে ফায়ার সার্ভিসকে তেমন ক্ষমতা দেয়া হয়না। অগ্নি নিরাপত্তা বাস্তবায়ন করা, জরিমানা করা বা আইনগত কোন ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। সেই সুযোগটা অনেকে নিয়ে থাকে। ‘’

অনেক ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার সার্টিফিকেট নেয়া হলেও পরবর্তীতে আর সেটা বাস্তবায়ন করা হয়না। আধুনিক ভবনগুলোয় কিছুটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও নব্বই দশকের আগের ভবনগুলোয় অগ্নি নিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয় বেশি দুর্বলতা রয়েছে।

মি. খান বলছেন, ‘’সেফটির বিষয়টা তারা গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। মনে করে, একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখলাম মানেই হয়ে গেল। কিন্তু জনবহুল মার্কেটে আগুন ঠেকানোর ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি থাকে না। ফলে আগুন লাগলেও সহজে সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না।‘’

ভবনগুলো যাতে ফায়ার কোড অনুসরণ করতে বাধ্য হয়, অগ্নি নিরাপত্তার নিয়মগুলো মানতে বাধ্য হয়, সেজন্য সরকারের তরফ থেকে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। সেটা কার্যকর করা গেলে এরকম দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে আসতে পারে বলে তারা মনে করছেন।

‘’গার্মেন্ট খাতে সরকার, বায়ার্সরা মিলে কারখানাগুলোকে ফায়ার সেফটির আওতায় নিয়ে এসেছে। ফলে সেখানে কিন্তু দুর্ঘটনা, হতাহতের সংখ্যা কমে গেছে। কিন্তু বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, মার্কেট- অন্যান্য স্থাপনাগুলোকে এখনো এরকম নজরদারির মধ্যে আনা যায়নি,’’ বলছেন ফায়ার সার্ভিসের এই সাবেক মহাপরিচালক।


Spread the love

Leave a Reply