তাহেরা সাদাতের ব্রিটেনজয়; স্বপ্ন এবং সফলতার গল্প

Spread the love

আহমাদ সালেহ: UKIM হচ্ছে ‘ইউনাইটেড কিংডমস ইসলামিক মিশন’, যেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৬২ সালে। ব্রিটেনের ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় এবং প্রতিনিত্বশীল সংগঠন UKIM, যার শুরুটা হয়েছিলো বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ব্রিটেনে আসা মুসলিম অভিবাসীদের তাৎক্ষণিক ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে। কিন্তু সময়ের আবর্তনে এই চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের কাজ গ্রেট ব্রিটেন ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে বিস্তৃত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ব্রিটেনজুড়ে এই সংগঠন পাঁচ হাজারের বেশি মুসলমান ছেলেমেয়ের ধর্মীয় শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আঞ্জাম দিচ্ছে। অন্যান্য সেবাকাজও বিস্তর, যা তাঁদের ওয়েবসাইটে একবার ঢুঁ মারলেই ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু ব্রিটেনের ইসলাম হৃদয়ে ধারণকারী শিশু-কিশোরদের মধ্যে UKIM একটা স্বপ্নের বাতিঘর, অন্যরকম এক আশার নাম, ভালোবাসার নাম। UKIM তাঁদেরকে বায়তুল্লাহ এবং মসজিদে নববীর প্রেম শেখায়, আল্লাহ এবং রাসুলকে (সা.) ভালোবাসতে শেখায়, ভালোবাসার প্রতিযোগিতায় নামায়। UKIM ব্রিটেনের মাদরাসাগুলোর সবচেয়ে বড় বোর্ড, এর মাধ্যমেই হাজার হাজার শিশু-কিশোর প্রয়োজনীয় ইসলামিক শিক্ষা অর্জন করে।

প্রতি বছর শিশু-কিশোরদের জন্য একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে UKIM. ‘Creativity Competition for Childrens’ বা ‘শিশুদের জন্য সৃজনশীল প্রতিযোগিতা’, যেটি তিন ক্যাটাগরিতে অনুষ্ঠিত হয়। ক্বেরাত, বক্তৃতা, ইসলামী সংগীত, পোস্টার, কবিতা ইত্যাদি অনেকগুলো বিষয় থাকলেও একজন প্রতিযোগি দুইটির বেশি বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে না। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের এই প্রতিযোগিতা উপলক্ষে ব্রিটেনবাসী মুসলিম ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়। বিভিন্ন মাদরাসা থেকে হাজার হাজার প্রতিযোগি অংশগ্রহণ করে আর অপেক্ষায় থাকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের।
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের ভয়াল হামলা সত্ত্বেও UKIM এবারও এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। কিন্তু অন্যান্য বারের মতো নয়, এবার সম্পূর্ণ অনলাইনেই অনুষ্ঠিত হবে প্রতিযোগিতাটি।

আমাদের শিরোনামের ছোট্ট বোন তাহেরা সাদাত, যে কিনা এই প্রতিযোগিতার অন্যতম সেলিব্রেটি কম্পিটিটর। দুর্দান্ত মেধাবী। অনেক ভালো কবিতা লেখে, বক্তৃতায় সুদক্ষ, ছবি আঁকায়ও দারুণ পারদর্শিতা আছে তার। আজকে আমি তারই গল্প বলবো আপনাদের।

২০১৭ সাল, তাহেরার বয়স তখন ছিল মাত্র ৯ বছর। সেবার ইউকিমের বক্তৃতা প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল হযরত খাদিজা (রা.)। প্রিয় রাসুলের (সা.) প্রিয় সহধর্মিনী মা খাদিজা (রা.), যাঁকে জাহেলী যুগেই আরবরা উপাধি দিয়েছিলো ‘তাহেরা’, অর্থাৎ ‘পবিত্রতমা’, আর আমাদের ছোট্ট তাহেরার মূল নামটিই তো ‘তাহেরা’। সেই কারণেই কি অন্যরকম একটা আনন্দ কাজ করেছিলো তাহেরার মনে? চিত্তাকর্ষক এক বক্তৃতা দিয়ে তাহেরা সে বার প্রাইমারি ক্যাটাগরির বক্তৃতায় তৃতীয় পুরস্কার জিতে নেয়।

ইউকিম অ্যানুয়েল এক্সাম অ্যাওয়ার্ড, যেটি সব ক্লাস থেকে সর্বোচ্চ মার্কস পাওয়া শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়
তার পরের বছর তো রীতিমত বর্ণাঢ্য। ইউকিম পরিচালিত সবগুলো মাদরাসার মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে ‘অ্যানুয়েল এক্সাম অ্যাওয়ার্ড ২০১৮’ জিতে নেয় সে, এবং সেটা সকল ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে।
কিন্তু সে বছর আরো আকর্ষণীয় পুরস্কারও বগলদাবা করতে ভুলেনি তাহেরা। ‘মুসলিম তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য’ বিষয়ে মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে তাহেরা এবার অর্জন করে নেয় দ্বিতীয় পুরস্কার। আর ‘ব্রিটেনের উন্নয়নে মুসলিমদের অবদান’ বিষয়ে অসাধারণ এক পোস্টার ডিজাইন করে সেটাতেও নিজের বিভাগ থেকে দ্বিতীয় পুরস্কারটি দখল করে নেয়।

কিন্তু নিজেকে প্রমাণের এই প্রতিযোগিতায় তাহেরার একটি জায়গায় তখনও অতৃপ্তি ছিলো। প্রাথমিক পর্যায়ের শেষ বছর না আসা পর্যন্ত কবিতায় অংশগ্রহণ করা যেতো না। ২০১৯ সালে এসে তাহেরা সেই সুযোগটি পেলো। My Ideal Mosque নামে একটি দুর্দান্ত কবিতা লিখে ফেললো সে। চলুন পড়া যাক সেই কবিতাটি-

My Ideal Mosque
By Taherah Saadat
October 2019

بسم هللا الرحمن الرحيم

A mosque is where I go to worship everyday,
And I also go there to prostate five times a day.
I find a smile on everybody’s face,
Worshipping Allah in this holy place.

When I go to the mosque I am never alone ,
Because the house of Allah is my second home.
I love my Rabb who is Allah,
And on Friday afternoon there’s Jummah salah.

We are in the prayer room reading Quran,
And seek peace in prayers led by the Imam.
It’s where we learn Arabic to read and write,
And this is how we can make our future bright.

With our hands raised to Allah our hearts feel at content,
As this is the time we can truly repent.
A mosque is a place where you can never feel in despair,
As angels surround you and you are aware.

When we go to the mosque we perform Eid prayer,
Family and friends around the world gather there.
Masjid is a place that makes me feel at peace and makes me feel good
When it’s the holy month of Ramadan we sit together and share food.

Islam is my religion which is all about peace,
And at Al Furqan Masjid is where my knowledge will increase.
We must work together to make our mosques ideal,
So tranquility and spirituality we can feel.

أمين

“যখন আমি মসজিদে যাই, তখন আর একলা থাকি না
কারণ আল্লাহর ঘরই আমার দ্বিতীয় ঘর
ভালোবাসি আমার পালনকর্তাকে, তিনি আল্লাহ
এবং ভালোবাসি শুক্রবারের দুপুর, সালাতুল জুমাহ”

কী চমৎকার না কথাগুলো!! পাঠ করার পর থেকেই আমায় ভাবাচ্ছে। আর কবিতাটির স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকটা খেয়াল করুন। ব্রিটেনের একটি মসজিদে কী কী হয়, তার একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা উঠে এসেছে এর মধ্যে। এই সময় এবং এই সময়ের ব্রিটেনের একটি মসজিদ কেমন, বিষয়টাকে অসাধারণভাবে ধারণ করে ১১ বছরের ছোট্ট তাহেরার কবিতাটি তাই স্বকালের সৌন্দর্যস্বাদ পূরণ করে মহাকালের জন্য একটি দলীল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এমন কবিতা তবে কততম স্থান অর্জন করতে পারে?
ঠিক ধরেছেন। এই কবিতা দিয়েই তাহেরা ২০১৯ সালে প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে কবিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে নিয়েছিল।

এ বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে এসে তাহেরা প্রাইমারি থেকে জুনিয়র ক্যাটাগরিতে প্রবেশ করেছে। এবার প্রতিযোগিতাটি হবে তারচেয়ে বয়সে বড় আরো অনেকের সাথে। কেমন হবে তবে এবারকার প্রতিযোগিতা? নিশ্চয়ই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই যাকে বলে!! এবারও তাহেরা বিভিন্ন বিষয়ে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অংশগ্রহণও করেছে তার পছন্দের বিষয়গুলোতে। একটি কবিতাও লিখেছে, যেটার নাম ‘My Ramadan’. দুর্দান্ত সুন্দর কবিতা, আমার পড়ে অন্তত সেরকমই মনে হলো। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও প্রতিযোগিতার ফলাফল বের না হওয়া পর্যন্ত সেটা প্রকাশ করা সমীচিন মনে হচ্ছে না।

যাইহোক, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই অসাধারণ মেধাবী তাহেরা জন্মস্থানসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকও বটে! উন্নত দেশগুলো এদেশের মেধাবীদের সম্মান দিয়ে নিজেদের দেশের নাগরিকত্ব দেয়। আমরাও একদিন তাহেরা এবং তাহেরার মতো অসাধারণ মেধাবীদের যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে দেশের কাজে লাগাতে পারবো, এমন আশা তো করতেই পারি।

তাহেরা সাদাত কী ভাবে তার স্বদেশ নিয়ে? হাজার মাইল দূরে থেকে অদেখা বাংলাদেশের জন্য তার কোনো ভালোবাসা আছে?
হ্যাঁ, তাহেরার স্বপ্নের কথা জানলে আপনারাও আমার মতো রীতিমত বিস্মিত হবেন!
এ বছরই পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে তাহেরা বাংলাদেশের দরিদ্র ও অবহেলিত এতিম-বিকলাঙ্গ শিশু ও বিধবা মায়েদের সহযোগিতার জন্য একটি ফান্ড গঠন করেছে। যার নাম- Taherah’s Fair Foundation.
তাহেরার আম্মু, বড় দুই ভাই আব্দুল খালেদ রহমান ও ড. আব্দুল কবির রহমান, বোন জিবরান সাদাতসহ আরো অনেকেই এ ব্যাপারে তাকে খুবই উৎসাহ আর সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। সকলের সহযোগিতা নিয়ে ফান্ড তৈরি করে তাহেরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। তাহেরা’স ফেয়ার ফাউন্ডেশনের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান হয়েছে তাহেরা, আর বড় ভাই আব্দুল খালেদ রহমান তো এর সার্বিক দায়িত্ব নিতে পেরে রীতিমত আনন্দিত।

NAME: TAHERAH’S FAIR FOUNDATION
Purpose: Work for Orphans and Disable Childrens, and also for Poor and Widows.

বারো বছরের ছোট্ট তাহেরা, কিন্তু মানুষ কত বড়?
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ভাষায়- “মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়!” ঠিক না?
কিন্তু কোনও মহান দার্শনিক বা বড় লেখক নন, তাহেরার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তার মহিয়সী আম্মু নাসিমা রহমান। নিজের জীবন থেকে তিনি তার সন্তানদের শিখিয়েছেন কীভাবে অন্যের সুখের জন্য নিজের সব সুখ-প্রত্যাশাকে পরিত্যাগ করতে হয়, অন্যের আনন্দের তরে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে হয়। তাইতো এই বয়সেই তাহেরার স্বপ্নগুলো এমন দরদমাখা, এতোটাই উন্নত সুন্দর! মহান সৃষ্টিকর্তা তাহেরার স্বপ্নগুলোকে সফল করুন। সারা দুনিয়ার সৃষ্টিকে উপকৃত করুন তার দ্বারা।

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্য সমালোচক

ইমেইল: 71.ahmadsaleh@gmail.com


Spread the love

Leave a Reply