তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ: যেসব ভুল বিশ্বকে প্রায় পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল

Spread the love

যারিয়া গরভেট,বিবিসি ফিউচারঃ
প্রাণীর আক্রমণ থেকে শুরু করে সস্তা ত্রুটিযুক্ত কম্পিউটার চিপ- এমন বহু জিনিসের তালিকা আছে যা দেখলে বোঝা যায়, কিভাবে একটি ভুলের কারণে খুব সহজে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে।

১৯৬২ সালের ২৫শে অক্টোবর মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের রানওয়ের দিকে দ্রুতগতিতে যাচ্ছিলো একটি ট্রাক। এটা ছিলো একটি বিমানের উড্ডয়ন আটকে দেয়ার আগ মুহূর্তের ঘটনা।

কয়েক মিনিট আগে ডুলুথ সেক্টর ডিরেকশন সেন্টারের একটি গার্ড ছায়াসদৃশ কিছু একটাকে ওই কেন্দ্রের সীমানা প্রাচীর বেয়ে উঠতে দেখেন।

তিনি সেটিকে লক্ষ্য করে গুলি করেন এবং সতর্কবার্তা জারি করেন এই ভয়ে যে হয়তো এটা সোভিয়েত হামলার একটি অংশ।
পরিস্থিতি দ্রুতই আরও জটিল হয়ে ওঠে। নিকটবর্তী বিমান ঘাঁটি ভল্ক ফিল্ডে কেউ একজন ভুল সুইচ চেপে দেন। ফলে সাধারণ নিরাপত্তা সতর্কবার্তার পরিবর্তে পাইলটদের কানে বেজে ওঠে জরুরি সাইরেন।

মুহূর্তেই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত বিমানগুলো একযোগে উড্ডয়নের উদ্যোগ নেয়। একেবারে হুড়োহুড়ি পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা।

এটা ছিলো কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময়কার কথা। এর এগারো দিন আগে একটি গোয়েন্দা উড়োজাহাজ থেকে কিউবার মিসাইল, ট্রাক ও গোপন লঞ্চারের ছবি তোলা হয়। যা দেখে মনে করা হয় যে সোভিয়েত পুরো যুক্তরাষ্ট্রে তাদের টার্গেটগুলোকে কেন্দ্র করে গুছাচ্ছিলো।

তবে পুরো বিশ্বই জানতো যে কোন পক্ষ থেকে একটি হামলা নজিরবিহীন অবনতি ঘটাতো।

কিন্তু এসব যখন ঘটছে তখন জানা যায় এগুলোর সাথে জড়িত কোন মানুষ নয় বরং ওই সীমানা প্রাচীরের কাছে ছায়া পড়েছিলো একটি বড় কালো ভালুকের।

অর্থাৎ পুরোটাই ছিলো একটা ভুল।

তবে ভল্ক ফিল্ডে তখনো এ সত্য পৌঁছায়নি। বরং তারা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো যে – তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

শেষ পর্যায়ে বিমান ঘাঁটির কমান্ডার বের করেন যে আসলে কি হয়েছিলো। তিনিই একটি ট্রাক নিয়ে গিয়ে পাইলটদের থামান।

অল্পের জন্য রক্ষা
এটা ভুলে যাওয়া সহজ যে প্রায় ১৪ হাজার পারমানবিক অস্ত্র রয়েছে এই দুনিয়া যা দুনিয়ার তিনশো কোটি মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, এমনকি মানবজাতিকে বিলুপ্তও করে দিতে পারে।

আমরা জানি এর কোনটি যদি কোন নেতা ইচ্ছা করে বিস্ফোরণ ঘটাতে চান তাহলে তিনি বা তারা আসলে পাগল।

কিন্তু আমরা যেটি ধারণা করতে পারি না তা হলো এটি আসলে দুর্ঘটনাক্রমেও হতে পারে।

এ পর্যন্ত অন্তত ২২ বার এমনটি ঘটতে যাচ্ছিলো যা শেষ পর্যন্ত অল্পের জন্য আর হয়নি।

আর যেসব বিষয় এভাবে বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলো তার মধ্যে ছিলো একদল রাজহাঁস, চাঁদ, সামান্য কম্পিউটার সমস্যা এবং মহাকাশের অস্বাভাবিক আবহাওয়া।

১৯৫৮ সালে একটি বিমান থেকে ভুলবশত একটি বাড়ির বাগানে পারমানবিক বোমা ফেলা হয় কিন্তু বিস্ময়করভাবে কেউ মারা যায়নি। তবে কিছু মুরগি পুড়ে যায় তাপে।

২০১০ সালে আরেক বিপর্যয় তৈরি হয় যখন মার্কিন বিমান বাহিনী অন্তত ৫০টি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে। এর মানে হলো ওই সময়ে এগুলো চিহ্নিত করা কিংবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হওয়া ঠেকানোর সুযোগ ছিলো না।

পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপক আধুনিকায়ন সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এ খাতে ২০১৯ থেকে পরবর্তী আট বছরে অন্তত ৪৯৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।

যদিও ইতিহাস বলছে মানবিক ভুল বা উৎসাহীর বন্যপ্রাণী কারণে কিভাবে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকিতে পড়তে পারে।

ইয়েলিৎসনের জন্য প্রথম
১৯৯৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি তখনকার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিৎসিন প্রথম বিশ্বনেতা হিসেবে নিজের ‘নিউক্লিয়ার ব্রিফকেস’ সক্রিয় করেছিলেন। এ ব্রিফকেসেই পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য নির্দেশনা ও প্রযুক্তি থাকে।

ইয়েলেৎসিনের রাডার অপারেটর খেয়াল করেছিলেন যে একটি রকেট নিক্ষেপ হয়েছে নরওয়ে উপকূল থেকে এবং তারা দেখেন যে এটি অস্বাভাবিকভাবে আকাশের দিকে উঠছে।

ব্রিফকেস হাতে নিয়েই মিস্টার ইয়েলিৎসিন তার উপদেষ্টাদের সাথে পাল্টা হামলা নিয়ে আলোচনায় বসেন।

কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা বুঝতে পারেন যে এটি সাগরের দিকেই গেছে এবং এটি কোন হুমকি ছিলো না।

পরে জানা যায় এটি কোন পারমাণবিক হামলা ছিলো না। তবে ভিন্ন একটি গবেষণার অংশ ছিলো সেটি।

তবে বিষয়টি নরওয়ের কর্মকর্তাদের অবাক করেছিলো, কারণ তারা এক মাস আগেই এ সম্পর্কিত ঘোষণা দিয়েছিলো।

পেছনে ফেরা নয়
ভুল কারণে হোক আর সত্যিকার হুমকি হোক- পারমাণবিক অস্ত্র একবার সক্রিয় করা হলে সেটি আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব না।

“প্রেসিডেন্ট যদি কোন মিথ্যা অ্যালার্মে সাড়া দেন তাহলে তিনি দুর্ঘটনাবশত একটি পারমাণবিক যুদ্ধের সূচনা করবেন,” বলছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম পেরি।

“তার আর কিছু করার নেই। মিসাইলকে ফিরিয়ে আনা যায় না এবং এগুলো ধ্বংস করে ফেলা যায় না”।

পারমাণবিক হামলা হয়েছে এটা কিভাবে বোঝা যায়
সম্ভাব্য ভুলের কারণে স্নায়ুযুদ্ধের সময় একটি আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিলো।
টার্গেটে হামলার জন্য অপেক্ষার পরিবর্তে আগে থেকেই সতর্ক হওয়ার উপায় কি যাতে করে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া যায় কি না।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু স্যাটেলাইট ভূপৃষ্ঠের ৩৫ হাজার ৪শ কিলোমিটার উপর থেকে এ বিষয়গুলো সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে।

তবে স্যাটেলাইট মিসাইলের ছুটে চলার গতিপথ দেখাতে পারে না। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শত শত রেডার স্টেশন আছে যারা অবস্থান চিহ্নিত করে রুট হিসেব করে।

যখন যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে হামলা আসছে তখন প্রেসিডেন্ট অবহিত হয়ে থাকেন।

“এ কারণে ৫-১০ মিনিট এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পেতে পারে,” বলছিলেন মিস্টার পেরি।

অবাধ্য প্রযুক্তি
ফলস অ্যালার্মের জন্য দুটি ভুল দায়ী হতে পারে – প্রযুক্তিগত ও মানবিক। এ দুটি একসাথেও হতে পারে।

এমন ঘটনা ঘটেছিলো ১৯৮০ সালে। মিস্টার পেরি তখন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সাথে কাজ করছিলেন।

একটি তিন মিনিটের কল থেকে এর সূচনা হয়েছিলো। এয়ার ডিফেন্স কমান্ড থেকে তাকে জানানো হয়েছিলো যে নজরদারিতে থাকা একটি কম্পিউটার আবিষ্কার করেছে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দুশো মিসাইল সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রর দিকে আসছে।

কিন্তু এর মধ্যেই তারা বুঝতে পারেন যে এটি সত্যিকারের হুমকি নয়। কম্পিউটার কোনোভাবে এ ভুল তথ্যটি পেয়েছে।

“আমাকে কল দেয়ার আগে তারা হোয়াইট হাউজে কল দিয়েছিলো। নিরাপত্তা উপদেষ্টার মাধ্যমে তারা প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেছিলো,” বলছিলেন মিস্টার পেরি।

ভাগ্য ভালো প্রেসিডেন্টকে জাগানোর আগে তিনি কয়েক মিনিট সময় নিয়েছিলেন।

যদি তারা জিমি কার্টারকে তখনি জাগাতে পারতেন তাহলে এখনকার বিশ্ব হয়তো ভিন্ন কিছু হতো।

ওই ঘটনার মূলে ছিলো একটি ত্রুটিপূর্ণ কম্পিউটার চিপ। পরে তা পরিবর্তন করা হয়।

এক বছর আগে আরও একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিলো মি. পেরির যখন একজন টেকনিশিয়ান ভুলে একটি প্রশিক্ষণ টেপ কম্পিউটারে আপলোড করে ফেলেন। এট ভুলে প্রধান সতর্কীকরণ কেন্দ্র ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তথ্য দিয়েছিলো।

নিউক্লিয়ার ফুটবল বহন করছেন একজন সামরিক কর্মকর্তা।

অ্যালকোহল, ড্রাগ বা মানসিক অস্থিরতা
এটাও অনেকবার ঘটেছে যে প্রেসিডেন্ট বেশি মাত্রায় মদ্যপান করেছেন বা তাকে ঔষধ নিতে হয়েছে। হয়তো কোন মানসিক রোগে ভুগছেন।

সেটাও হয়েছে বলে বলছেন মিস্টার পেরি।

কিন্তু যদি রাতের বেলা এমন পরিস্থিতি হয় আর প্রেসিডেন্ট যদি ঘুমিয়ে থাকেন?

কয়েক মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চেতনা ফিরে পাওয়া বা কফি খেয়ে নিজেকে সতেজ করারও সময় নেই।

১৯৭৪ সালের অগাস্টে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়ে পদত্যাগের দ্বারপ্রান্তে।

তখন তিনি বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন এবং মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।

গুজব ছিল, তখন তিনি নিয়মিতভাবে মার্টিনি পান করতেন এবং অদ্ভূত আচরণ করতেন – একজন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট তাকে একবার কুকুরের বিস্কুটও খেতে দেখেছিলেন বলে খবর।

অতিমাত্রা ক্রোধ, মদ্যপানের সমস্যা এবং উচ্চশক্তির ঔষধ খাওয়ার অভ্যাস ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের। তারপরও তার হাতে ছিল পারমানবিক অস্ত্রের সুইচ চেপে দেয়ার ক্ষমতা।

যেসব সামরিক সদস্য পারমানবিক অস্ত্র পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিত, তারা যদি মাদকাসক্ত হয় সেটাও একটা সমস্য বৈকি।

২০১৬ সালে আমেরিকার একটি মিসাইল ঘাঁটিতে কর্মরত কয়েকজন বিমান সেনা কোকেন ও এলএসডির মত মাদক গ্রহণের কথা স্বীকার করেন। এদের মধ্যে চারজনের পরে শাস্তি হয়।

বিপর্যয়কর দুর্ঘটনা কিভাবে এড়ানো যাবে
মিস্টার পেরি ও টম কলিনা একটি বই লিখেছেন যেটির নাম – দ্য বাটন: দ্য নিউ নিউক্লিয়ার আর্মস রেস অ্যান্ড প্রেসিডেনশিয়াল পাওয়ার ফ্রম ট্রুম্যান টু ট্রাম্প। এ বইতে তারা এখন পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষা ও কিছু সমাধান বিষয়ে লিখেছেন।

প্রথমত তারা কারও একক কর্তৃত্বের অবসান চেয়েছেন যাতে করে হামলার সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিকভাবেই নেয়া যায়।

সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে পারমাণবিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত বিশেষ করে পাল্টা হামলা চালানোর সক্ষমতা হারানোর আগেই।

দ্বিতীয়ত, কখনোই প্রথম আক্রমণকারী হওয়া যাবে না। পরমাণু শক্তি হবে শুধুমাত্র হামলার জবাব দেয়ার জন্য।

প্রথম হামলা না করার বিষয়ে চীন একটি নীতি আগেই গ্রহণ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার এ ধরনের কোন নীতি নেই। আক্রমণের কর্তৃত্ব তাদের হাতেই সংরক্ষিত।

ওবামা প্রশাসন এটি নিয়ে চিন্তা করলেও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।

টম কলিনা বলছেন সিস্টেমে একটি ক্যানসেল অপশন থাকা উচিত।

কারণ হ্যাকিংয়ের মতো প্রযুক্তির কারণে বা ফলস অ্যালার্মের কারণে ভুলে হামলা হয়ে যেতে পারে।


Spread the love

Leave a Reply