দুই মার্কিন জিম্মিকে মুক্তি, গাজায় ত্রাণের পথ খুলছে

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃগাজায় জিম্মি অবস্থায় থাকা দুই মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে হামাস। এরা হলেন জুডিথ রানান (৫৯) এবং তাঁর মেয়ে নাতালি রানান (১৮)। তাঁদের মুক্তির মধ্য দিয়ে গাজায় মানবিক ত্রাণ সহায়তা যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শুক্রবার বলেছেন, আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রথম ২০টি ট্রাক গাজায় পৌঁছাবে।

হামাস শুক্রবার মা–মেয়েকে মুক্তি দেওয়ার পর তাঁরা ইসরায়েল সীমান্তে পৌঁছে গেছেন বলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তরের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

দুই মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দেওয়াকে শুভেচ্ছার নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন হামাস নেতা গাজী হামাদ। বন্দীদের মধ্যে যাঁরা ইসরায়েলি নন, সম্প্রতি তাঁদের ‘অতিথি’ হিসেবে সম্বোধন করেছিল হামাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছিল সংগঠনটি।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূ–খন্ডে ঢুকে হত্যাকাণ্ড চালানোর পাশাপাশি অন্যদের সঙ্গে এই মা–মেয়েকে ধরে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। সে সময় জুডিথ ও তাঁর মেয়ে গাজা সীমান্তবর্তী দক্ষিণ ইসরায়েলের নাহাল ওজ কিববুৎসে আত্মীয়দের বাসায় বেড়াচ্ছিলেন। দুজনের মুক্তির পরে এখনো প্রায় ২০০ মানুষ গাজায় জিম্মি অবস্থায় আছে।

গাজায় মৃত্যু চার হাজার ছাড়াল

‘এত দিন আমি যেসব স্বপ্ন দেখেছিলাম, তিলে তিলে যেসব অর্জন করেছিলাম, সব মাটিতে মিশে গেল। বাসাটা ঘিরে কত স্বপ্ন ছিল। সন্তানদের সঙ্গে, স্ত্রীর সঙ্গে ছিল কত স্মৃতি। ছিল ভালোবাসা আর নিরাপত্তার অনুভূতি।’ কথাগুলো ফিলিস্তিনের বিধ্বস্ত–রক্তাক্ত গাজা উপত্যকার আল–জাহরা এলাকার বাসিন্দা আলীর। ইসরায়েলের বেপরোয়া হামলায় তাঁর বাসাটি গুঁড়িয়ে গেছে।

শুধু আলীর বাসা-ই নয়, অন্যান্য দিনের মতো শুক্রবারও ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় আল–জাহরার অন্তত ২৫টি আবাসিক ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। তাতে স্বজনহারা হয়েছেন অনেক ফিলিস্তিনি।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ৪ হাজার ১৩৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। নিহতদের মধ্যে শিশু ১ হাজার ৫২৪, আর নারী ১ হাজারের বেশি। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ১১ সাংবাদিকও। এ ছাড়া পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের হামলায় গতকাল পাঁচ শিশুসহ ১৩ জন নিহত হয়েছেন।

অন্যদিকে ইসরায়েলের সূত্রে জানা গেছে, এ কয়দিনে হামাসের হামলা ও তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় তাদের নাগরিক নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি। আহত ৪ হাজার ৬২৯ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৬৩ জন সেনা ও পুলিশ সদস্য।

এ তো গেল হতাহতের হিসাব। জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি বাড়ি। সংখ্যাটি গাজার মোট বাড়ির তিন ভাগের এক ভাগ। এর জেরে উপত্যকাটিতে ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন।

আল–জাহরার অবস্থান গাজার উত্তরে। শুক্রবার উপত্যকাটির দক্ষিণাঞ্চলেও ইসরায়েল ভয়াবহ বোমাবর্ষণ করেছে। সেখানকার খান ইউনিস এলাকায় ধ্বংসস্তূপে হতাহত মানুষদের খুঁজতে দেখা গেছে উদ্ধারকারীদের। তাঁদেরই একজন একটি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে এক শিশুর মরদেহ বের করে আনেন। এ সময় পাশের একটি বাড়ির বাসিন্দা জৌমানা খরেইস বলেন, ‘আমরা ত্রাণ চাই না। আমরা চাই, ঘুমের মধ্যে শিশুদের হত্যা বন্ধ করা হোক। এসব দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত।’

হামলা থেকে রেহাই পায়নি গির্জাও

৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায়। এরপর থেকে গাজায় নারকীয় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত মঙ্গলবার রাতে মধ্য গাজার একটি হাসপাতালে হামলায় নারী ও শিশুসহ ৪৭১ জন নিহত হন। শুক্রবার আক্রান্ত হয়েছে একটি গ্রিক অর্থোডক্স গির্জাও। গির্জাটিতে শত শত মুসলিম ও খ্রিষ্টান প্রাণ বাঁচাতে ঠাঁই নিয়েছিলেন।

চার্চ অব সেন্ট পরফিরিয়াস নামের উত্তর গাজার এ গির্জায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, রাতের আঁধারে ধ্বংসস্তূপ থেকে আহত এক কিশোরকে বের করে আনা হচ্ছে।

উদ্ধারকারী একজন জানান, গির্জার ওপর তলায় থাকা দুজন বেঁচে গেছেন। আর যাঁরা নিচতলায় ছিলেন, তাঁরা মারা গেছেন। মরদেহগুলো ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে।

গির্জায় হামলায় ১৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হামলার বিষয়ে গির্জা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই হামলা ‘যুদ্ধাপরাধ ও কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।’

এদিকে শুক্রবার ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, উত্তর গাজার আল–কুদস হাসপাতাল খালি করার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। হাসপাতালটিতে ৪০০ রোগী ভর্তি আছেন ও ১২ হাজার ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছেন।

সময় ফুরিয়ে আসছে, সীমান্তে এখনো আটকে ত্রাণবাহী গাড়ি

অবরুদ্ধ গাজায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাবার, পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে বাসিন্দাদের অবস্থা এখন দুর্বিষহ। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউর কর্মকর্তা জুলিয়েট টোউমা বলেছেন, দুই সপ্তাহে গাজা নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছে। এখানকার বেসামরিক মানুষের কাছে দ্রুত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সময় ফুরিয়ে আসছে।

এদিকে গাজাবাসীর হাতে ত্রাণ পৌঁছে দিতে তৎপর হয়েছে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। মিসর সীমান্তের রাফাহ ক্রসিংয়ে ত্রাণবাহী বহু ট্রাক গাজায় প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়নি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের মধ্যে একটি চুক্তিতে প্রতিদিন ২০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।

শুক্রবার রাফাহ ক্রসিংয়ে যান জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, গাজায় যেন আরও বেশি ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করছে।

‘হামাস ও রাশিয়া একই রকম’

হামাস–ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর বেশির ভাগ পশ্চিমা নেতা ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুক্রবারও এক বক্তব্যে হামাসের বিরুদ্ধে লড়তে ইসরায়েলকে শত শত কোটি ডলার দেওয়ার কথা বলেছেন জো বাইডেন। তিনি এ–ও বলেন, ‘নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের প্রতি মানবতার বিষয়টিও আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।’

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথা উল্লেখ করে বাইডেন আরও বলেন, হামাস ও পুতিন বিভিন্ন হুমকি দিয়ে বেড়ায়। তবে উভয়ের সাধারণ হুমকি হলো, প্রতিবেশীর গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করতে চাওয়া। বাইডেনের এ বক্তব্যের সমালোচনা করে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ওয়াশিংটন মূল্যবোধের কথা বলে সব সময় বিশ্বকে বোকা বানিয়েছে।

এদিকে শুক্রবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসসহ মধ্যপ্রাচ্যের ছয় নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। বিবিসিকে সুনাক বলেছেন, বর্তমানে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হলো গাজার মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া।


Spread the love

Leave a Reply