নির্যাতনের ভয়ে আত্মগোপনে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ শিশু-কিশোর আন্দোলন। শুরুতে বাহবা। দাবি পূরণের আশ্বাস। আহ্বান, হুঁশিয়ারি। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। বিরোধীদের সুযোগ নেয়ার চেষ্টা।
রাজপথে হেলমেট বাহিনী। ব্যাপক পিটুনি। সংঘর্ষ। পরিস্থিতির ওপর সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। বাড়ছে মামলার সংখ্যা। হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়েছে এরইমধ্যে। আসামি চার সহস্রাধিক। গ্রেপ্তার একশ’।সরকারি-বেসরকারি নজরদারি।বিশেষ করে ফেসবুকে।
গ্রাম থেকে শহর। ফেসবুক বদলে দিয়েছে বহু কিছুই। জাকারবার্গের বিস্ময়কর উদ্ভাবনের সবকিছুই যে ইতিবাচক তা নয়। কখনো কখনো এই যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহৃত হয়েছে সংঘাতের উস্কানিতে। বিভ্রান্তি আর মানহানিতে একে হাতিয়ার করেছেন কেউ কেউ। তবে ফেসবুক যে বহু ভাষাহীনের মুখে ভাষা দিয়েছে সে সত্যও অস্বীকারের জো নেই। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষ তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন।
দুনিয়ার অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়েছে ফেসবুক। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ঐতিহাসিক শাহবাগ আন্দোলনের ডাক প্রথম আসে ফেসবুকেই। কোটা সংস্কার আর সাম্প্রতিক শিশু আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে শাসক মহল থেকে বারবারই অভিযোগ করা হচ্ছে, ফেসবুক ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ষড়যন্ত্র করা হয়েছে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেয়ার।
এটা সত্য যে, ফেসবুক ব্যবহার করে কেউ কেউ গুজব রটিয়েছেন। আবার এসব গুজবের বিরুদ্ধেও প্রচারণা হয়েছে ফেসবুকেই। এখন আবার ফেসবুকে তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের প্রচারণা। কোটা সংস্কার ও শিশুদের আন্দোলনে গুজব ছড়িয়েছেন এমন অভিযোগে অভিযুক্ত করে কারো কারো বিরুদ্ধে চলছে ঘৃণাত্মক প্রচার। কোটা আন্দোলনের নেতা বিন ইয়ামিন অভিযোগ করেছেন, একটি ফেসবুক পেজ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নামে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এসব তথ্য আমলে নিয়ে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন।
নজরদারি, মামলা আর ধরপাকড়কে কেন্দ্র করে এখন তৈরি হয়েছে নজিরবিহীন এক পরিস্থিতি। ছাত্রলীগ কর্মীরা পুরোদমে নিজেদের শামিল করেছেন নজরদারির কাজে। ফেসবুকে গুজব ছড়ানো তথা উস্কানি দেয়ার অভিযোগে অনেককে আটক করে তারা পুলিশে সোপর্দ করেছেন। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও উস্কানি দাতাদের খোঁজে পুরোদমে মাঠে নেমেছে। এ অভিযোগে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২ জনকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এডিসি নাজমুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমরা অন্তত এক হাজার আইডিকে টার্গেট করেছি। এরমধ্যে ৫০-৬০টি আইডিকে চিহ্নিত করেছি যারা উস্কানি দিয়েছে। কয়েকশ’ আইডিকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা পোস্ট দিয়েছে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যারা সেই সংগ্রামের আদলে সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছে এবং সহিংসতায় একমত পোষণ করেছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
একদিকে উস্কানির অভিযোগ।
অন্যদিকে, হামলা-সংঘর্ষের মামলায় ধরপাকড়। সবমিলিয়ে অভিনব এক পরিস্থিতি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সর্বত্র। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। তাদের অনেকেই এখন ফেসবুক থেকে নিজেকে ঘুটিয়ে নিয়েছেন। আত্মগোপনে চলে গেছেন বহু মানুষ, বহু পরিবার।
যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তাদের জামিন মিলছে না। এতে আতঙ্ক আরো বাড়ছে। ফেসবুক অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার বিষয়টি এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে খবর হয়েছে। গত ৫ই আগস্ট থেকেই তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। তার স্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত। বিবৃতি দিয়েছেন তার পিতা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক শ্যামল ভট্টাচার্য।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক ড. শাহদীন মালিকের কাছে অবশ্য পরিষ্কার নয় ঠিক কী অভিযোগে গ্রেপ্তার চলছে। তিনি বলেন, কোনো আইনে ‘গুজবের’ বিষয়টি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত নয়। কারো গুজবে প্ররোচিত হয়ে অন্য কেউ যদি অপরাধ সংঘটন করে কেবল তখনই গুজব অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। না হয় নয়। ড. মালিক বলেন, এই মুহূর্তে ঢালাওভাবে যেভাবে মামলা ও গ্রেপ্তার হচ্ছে তার উদ্দেশ্য অপরাধ দমন নয়, বরং অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
রিপোর্টটি দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের। যাতে বলা হয়েছে- নারী উদ্যোক্তা বর্ণালী চৌধুরী লোপা ৫ই আগস্ট দুপুরে নিউ মার্কেট থেকে শিশুর পোশাক কিনে ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছিলেন। পথে মেডিনোভার কাছে তাকে আটক করে পুলিশে দেয়া হয়। এরপর তাকে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়সহ ধানমন্ডিতে হামলা-ভাঙচুরের তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। এই ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল ৪ঠা আগস্ট।
বর্ণালীর মা আম্বিয়া খাতুন ও বোন কানিজ ফাতেমা এসব অভিযোগ করেন। বর্ণালীর বয়স ৩৫। ৪ঠা আগস্টের ভাঙচুরের ঘটনায় এই ব্যবসায়ী নারী কীভাবে আসামি হলেন? এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, বর্ণালীর মুঠোফোন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তিনি আন্দোলনকারীদের মাঝে খাবার বিতরণ করেছিলেন। এর মানে তিনি এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। তবে তাকে অন্যরা ধরে পুলিশের কাছে দিয়েছে।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এমন ঘটনা ঘটছে আরো। মামলা আর আসামি সংখ্যার কারণে উদ্বেগের মাত্রাও বাড়ছে। বাড়ছে আত্মগোপনে যাওয়া মানুষের সংখ্যা। গুজব ক্ষতিকর। তেমনি ক্ষতিকর আতঙ্কও।