পুতিনকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারবে আন্তর্জাতিক আদালত?

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-আইসিসি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে আদালত। কিন্তু আসলেই কি এতে করে মি.পুতিনকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে?

রুশ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ যে তিনি বেআইনিভাবে ইউক্রেনের শিশুদের রাশিয়াতে সরিয়ে নিয়েছেন। আদালত বলছে, এই অপরাধ গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর থেকেই ঘটে চলেছে।

একই অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের শিশু অধিকার বিষয়ক কমিশনার মারিয়া এলভোভা-বেলোভার বিরুদ্ধেও।

মস্কো এই অভিযোগ এরইমধ্যে অস্বীকার করেছে এবং গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করেছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যত অভিযোগ

আন্তর্জাতিক রেডক্রস বলে থাকে যে “যুদ্ধেরও কিছু নিয়ম আছে।”

আর এই নিয়মগুলো আরো বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আইন ও নির্দেশনার সাথে মিলে জেনেভা কনভেনশন নামে পরিচিত।

যার মধ্যে রয়েছে, সামরিক বাহিনী বেসামরিক লোককে জেনেশুনে আক্রমণ করতে পারবে না। একই সাথে এমন কোন ভবন আক্রমণ করবে না যা বেঁচে থাকার জন্য জরুরী। কিছু অস্ত্রও নিষিদ্ধ করা আছে যেমন অ্যান্টি পারসোনাল ল্যান্ড মাইন, রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্র।

অসুস্থ ও আহতদের অবশ্যই সেবা করতে হবে, আর আহত সৈন্যও যুদ্ধবন্দী হিসেবে শুশ্রূষা পাওয়ার অধিকার রাখে। হত্যা, ধর্ষণ বা গণ নির্যাতনের মতো মারাত্মক অপরাধকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বা ‘জেনোসাইড’ বলা হয়ে থাকে।

ইউক্রেন অভিযোগ করে আসছিল গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া তাদের অভিযান শুরুর পর থেকে অন্তত হাজার দশেক যুদ্ধাপরাধ করেছে। তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল রাশিয়া জোর করে দখল করা অঞ্চল থেকে শিশুদের তাদের দেশে নিয়ে আটকে রাখছে।

ইউক্রেনে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন জানায়, তারা শত শত ইউক্রেনীয় শিশুদের অবৈধভাবে রাশিয়াতে নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে।

রাশিয়া এমন কিছু নীতি গ্রহণ করেছে যেখানে শিশুদের জোর করে রাশিয়ার নাগরিকত্ব নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এরপর তাদের দত্তক দেয়ার মাধ্যমে যাতে তারা পাকাপাকিভাবে রাশিয়ায় থেকে যায় সেই ব্যবস্থা করছে, কমিশন তাদের রিপোর্টে এমনটাই বলেছে।

জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলছেন, এটা আসলে সাময়িক একটা ব্যবস্থা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বেশিরভাগই লম্বা সময়ের জন্য আটকা পড়ছে এবং বাবা-মা’র সাথে তাদের যোগাযোগ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

ইউক্রেন সরকার বলছে, এমন জোর করে নিয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা ১৬ হাজার ২২১ জন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কী বলছে?

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট-আইসিসি এক বিবৃতিতে বলেছে, এটা বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে যে মি. পুতিন এই অপরাধ সরাসরি করেছেন। একইসাথে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটি বন্ধ করার সুযোগ থাকলেও তিনি সেটা করেননি।

আইসিসির আইনজীবি কারিম খান বিবিসিকে বলেন, শিশুরা কখনোই যুদ্ধের মাধ্যমে দখল হতে পারে না, তারা দেশান্তরী হতে পারে না। এই ধরণের অপরাধ বুঝতে আইনজীবি হওয়ার দরকার পড়েনা। যে কোন মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষই বুঝবে যে কতোটা গুরুতর অপরাধ এটি।

আইসিসি জানায় তারা শুরুতে এই গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু আর যাতে এরকম অপরাধ না ঘটে সেজন্য তারা এটি প্রকাশ করেছে বলে জানায়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ২০০২ সালে গঠিত হয়। এর গঠনতন্ত্রে বলা হয় প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের নিজেদের দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধীদের বিচারকাজ পরিচালনা করা।

আইসিসি শুধু তখনই হস্তক্ষেপ করে যখন একটি রাষ্ট্র এমন অপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্তে অস্বীকৃতি জানায় বা অসমর্থ হয়।

বিশ্বের ১২৩টি দেশ এটি মেনে চলার কথা বললেও রাশিয়া এর বাইরে থেকেছে। আবার ইউক্রেন চুক্তিতে সই করলেও আইসিসির অনুমোদন দেয়নি।

গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রতিক্রিয়া

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ঘোষণার সাথে সাথেই প্রতিক্রিয়া জানায় ক্রেমলিন। সেখানকার কর্মকর্তারা এটাকে বাতিল করে দেয়। মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ বলেন, আদালতের যে কোন সিদ্ধান্তই আসলে ‘অকার্যকর।’

‘’এটা ব্যাখ্যা করার দরকার নেই যে কাগজটি কি কাজে ব্যবহার করা উচিত’’ – এই কথা লিখে একটা টয়লেট পেপারের ছবি দিয়ে টুইট করেছেন রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ।

তবে রাশিয়ার বিরোধী দলের নেতারা এটাকে স্বাগত জানাচ্ছেন।

আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি মি. খান ও আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞ ‘রাষ্ট্রের শয়তানের’ বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের জন্য।

যুক্তরাষ্ট্রও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য নয়। তবে এক প্রতিক্রিয়ায় দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, “আমি মনে করি এটা যথার্থ। মি. পুতিন পরিষ্কারভাবে যুদ্ধাপরাধ করেছেন।”

যুদ্ধাপরাধের বিচার কীভাবে হয়ে থাকে?

ইউক্রেনের আদালত এরই মধ্যে এক রুশ সৈন্যের শাস্তি দিয়েছে। এক নিরস্ত্র লোককে গুলি করার ঘটনায় ২১-বছর বয়সী ট্যাঙ্ক কমান্ডার ভাদিম শিশিমারিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে।

তবে একজন সৈন্যকে শাস্তি দেয়া সহজ হলেও কোন মিলিটারি কমান্ডার বা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে এটি আসলে কঠিণ হয়ে উঠতে পারে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইউক্রেনে ২০১৩ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধের তদন্ত করছে।

কিন্তু আইসিসি সাধারণত সেসব দেশেই যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজ নিজেরা পরিচালনা করে যেসব দেশে বিচার ব্যবস্থা সাধারণত খুব দুর্বল হয়ে থাকে।

রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধেও ‘আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা’ এই অভিযোগে আইসিসি তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে। সেক্ষেত্রে দেখা হয় অহেতুক অভিযান অথবা সংঘর্ষ যা আত্মরক্ষার জন্য নয় এমন কার্যকলাপকে।

কিন্তু এক্ষেত্রেও আইসিসি ভ্লাদিমির পুতিনের মতো রাশিয়ান নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করাতে পারবে না কারণ রাশিয়া এর সদস্যই নয়, বলছিলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডস।

তাত্ত্বিকভাবে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আইসিসিকে এই অভিযোগের তদন্ত করতে বলতে পারে। কিন্তু রাশিয়ার আবার সেটা ভেটো দেবার ক্ষমতা আছে।

পুতিন কি কোন শাস্তির মুখোমুখি হবেন?

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আসলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ক্ষমতা নেই। আর আইসিসি বিচারকাজও পরিচালনা করে শুধুমাত্র তার সদস্য দেশগুলোতেই। কিন্তু রাশিয়া আইসিসির সদস্য নয়। তাই দা হেগের কাঠগড়ায় পুতিন বা মারিয়া বেলোভার হাজির হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।

কাউকে গ্রেফতারে আইসিসিকে সরকারের সহযোগিতার উপরই নির্ভর করতে হয়। আর ‘রাশিয়া নিশ্চিতভাবেই কোন সহযোগিতা করবে না এক্ষেত্রে’, বিবিসিকে বলছিলেন কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিক্ষক জোনাথন লিডার মেনার্ড।

এছাড়া অভিযুক্তের উপস্থিতি ছাড়া কোন শুনানি হতে পারে না দা হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে। আইসিসির এমন নিয়ম নেই। তাই এটাও আরেকটা বাধা মি.পুতিনকে বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে।

তাই মি. পুতিন যতদিন তার নিজ দেশে থাকছেন তার গ্রেফতারের কোন সুযোগ নেই। তাকে আটক করা হতে পারে যদি তিনি অন্য দেশে যান।

কিন্তু যেহেতু আগে থেকেই তার চলাফেরা নানান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় সীমিত হয়ে গিয়েছে তাই তিনি যে অন্য কোন দেশে যাবেন আর সেখানে তাকে ধরে শুনানিতে আনা হবে এমন সম্ভাবনাও নেই।

তবে আইনজীবি মি. খান আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন সার্বিয়ান নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের কথা, যাকে ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও কসোভোতে যুদ্ধাপরাধের জন্য দা হেগে শুনানিতে হাজির হতে হয়েছিল।

যারা মনে করে যে দিনেদুপুরে কোন অপরাধ করে রাতে শান্তিতে ঘুমানো যাবে ইতিহাসের পাতায় তাদের চোখ বুলানো উচিত।

তাহলে এর প্রভাব কী?

আইনি দিক থেকে এটি মি. পুতিনের জন্য কিছুটা সমস্যা তৈরী করবে। বিশেষ করে তার বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে।

যেহেতু তিনি জি-২০ ভুক্ত একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, এবং খুব শিগগিরই আশা করা হচ্ছে যে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক সাক্ষাতে মিলিত হবেন। আবার একই সঙ্গো তার বিরুদ্ধে জারি হলো আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি প্ররেয়ানা। ফলে তিনি কোন কোন দেশে ভ্রমণ করতে পারবেন সে ব্যাপারে একটা নিষেধাজ্ঞা থাকবেই।

এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়াটা আসলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে এমন একটা সংকেত যে ইউক্রেনে যা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী। যদিও রাশিয়া একে পুরোপুরি অর্থহীন মনে করছে, কিন্তু আইসিসির মতো একটা সংস্থার এমন পদক্ষেপ ক্রেমলিনকে কিছু অস্বস্তিতেই ফেলেছে।

আর আইসিসি মনে করছে এর ফলে এমন অপরাধ ভবিষ্যতে কমে আসবে।

কিন্তু সবকিছু মিলে যা বাস্তবতা তাতে মনে হচ্ছে না আইসিসির পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে কোন ভূমিকা রাখবে। বরং প্রেসিডেন্ট পুতিনের “বিশেষ সামরিক অভিযান” সামনে চলমান থাকবে বলেই ধরে নেয়া যায়।


Spread the love

Leave a Reply