প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অনুরোধ করছি, সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে

Spread the love

গত কয়েকদিন ধরেই চিন্তা করছিলাম বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর কিছু লিখব, কিন্তু ব্যস্ততার কারনে তা পেরে উঠেনি। আজ আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করছি যেখানে সময়ের বাধা আজ উপেক্ষা করতেই হবে, সময় এসেছে লিখার ও কথা বলার। যেই চিন্তা, সেই কাজ, বসে পরলাম কম্পিউটারে।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মৃত্যু আর উৎকণ্ঠার খবর পড়েই ঘুমাতে যাই, আবার ঘুম থেকে উঠেই সর্বপ্রথম খুজে দেখি আমার প্রিয় বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি, দেশে কোন কিছু ঘটলো কি না, প্রিয়জনদের কোন দুঃসংবাদ আছে কিনা। প্রতিদিনের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রত্রিকা খুলতেই নজরে আসলো সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসিম সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। যদিও গত কয়েক দিন ধরই সোশ্যাল মিডিয়া একটি খবর চাউর ছিল যে নাসিম সাহেব মারা গিয়েছেন। তার মৃত্যুর সাথে সাথে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কথা বেশ করে বলা হচ্ছে। থাক সে কথা। তবে নাসিম সাহেবের মৃত্যু থেকে একটি শিক্ষা ও কার্যকরী পদক্ষেপের রাস্তা উম্মুক্ত হয়েছে, যা আমার আজকের লিখার মূল প্রতিপাদ্য এবং এখানেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

মানুষের মৌলিক মানবীয় চাহিদা হচ্ছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসা, নিরাপদ পানি, পয়নিস্কাশন ইত্যাদি। বিশেষ করে অসুস্থ হলে, নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সময়োপযোগী, সঠিক ও উন্নত চিকিৎসা পাওয়া মানুষের অধিকারে পরিনত হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত Universal Declaration of Human Rights এর অনুচ্ছেদ ২৫ বলা হয়েছে –
(1) Everyone has the right to a standard of living adequate for the health and well-being of himself and of his family, including food, clothing, housing and medical care and necessary social services, and the right to security in the event of unemployment, sickness, disability, widowhood, old age or other lack of livelihood in circumstances beyond his control.

প্রত্যেকেরই নিজের এবং তার পরিবারের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণের সাথে মানসম্মত পরিমিত জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে খাবার, পোশাক, আবাসন এবং চিকিৎসা সেবা; বেকারত্ব, অসুস্থতা, অক্ষমতা, বিধবাত্ব, বৃদ্ধ বয়স বা জীবিকার অভাব ইত্যাদি কারণে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া পরিস্থিতিতে সামাজিক সেবা ও নিরপত্তা প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে।

আর এই অধিকারের ক্ষেত্রে সবার থাকবে সমান অধিকার, যেখানে থাকবেনা কোন বৈষম্য, ধনী–দরিদ্রের পার্থক্য, সবাই পাবে সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা।যা Declaration প্রথম অনুচ্ছেদে এভাবেই বলা হয়েছে – All human beings are born free and equal in dignity and rights. They are endowed with reason and conscience and should act towards one another in a spirit of brotherhood. সমস্ত মানুষ মর্যাদা ও অধিকারে স্বাধীন ও সমান হয়েই জন্মগ্রহণ করে। সবাই যুক্তি ও বিবেকের অধিকারী আর তাই সবার উচিত ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে একে অপরের প্রতি আচরণ করা।

জাতিসংঘের Universal Declaration থেকে প্রতীয়মান যে প্রতিটি নাগরিক অধিকার রাখে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে অসুস্থ হলে সুস্থ হওয়ার। দুঃখজনক হলেও আজ এটি চরম সত্যে পরিনত হয়েছে যে কেবল তারাই চিকিৎসা পাচ্ছে যার অর্থ আছে, ক্ষমতা আছে, দাপট আছে; যার মামা, চাচা, খালু আর দুলা ভাই আছে। যা খুবই দুঃখজনক, অনাকাঙ্খিত, অনভিপ্রেত, যা আমদের স্বাধীনতার মূল স্পিরিটেরও পরিপন্থি।

চিকিৎসা এমনই একটি উল্লখযোগ্য ক্ষেত্র যেখানে পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত সব দেশই দিয়ে থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব। এইতো দেখুন মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার আগে তার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিলেন তিনি আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজাবেন এবং তিনি তাই করেছিলেন।নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন যা তারই লিখিত বই The Audacity of Hope তে তুলে ধরেছেন।তার একটি উল্লেখ যোগ্য কথা ছিল “ …I’m not talking about blind optimism here — the almost wilful ignorance that thinks unemployment will go away if we just don’t talk about it, or the healthcare crisis will solve itself if we just ignore it. No, I’m talking about something more substantial”.
আমি অন্ধ আশা করে থাকার কথা বলছি না, বেকারত্ব আর স্বাস্থ্য সমস্যা আমরা চুপ করে থাকলে এমনি এমনি চলে যাবে না, এমনিতেই ফেলে রাখলে স্বাস্থ্য সেবা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। বরং আমি বলছি আরও দৃঢ় কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার সম্পর্কে। তাই ওবামা, ক্ষমতায় আসার পর পরই ২০১০ সালে Patient Protection and Affordable Care Act নামে একটি আইন পাশ করেন যেটি Obamacare নামে সর্বাধিক পরিচিত। Obamacare এর অনেক গুলোর মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য ছিল –
১। সাধারণভাবে চিকিৎসা ব্যয় এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় হ্রাস করা
২। স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি করা, ভাল প্রতিরোধক তৈরি ও উদ্ভাবন করা এবং আমেরিকানদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
৩। স্বাস্থ্য ক্ষেত্র থেকে লিঙ্গ বৈষম্যকে দূর করা যাতে কোনও ব্যক্তিই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয় এবং কাউকেই যেন স্বাস্থ্য বীমার জন্য অতিরিক্ত পয়সা গুনতে না হয়।
উন্নত দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলই এই খাতকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। বাংলাদেশের গত ২০১৮ সালের নির্বাচনের বড় দল যেমন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ইশতেহার পর্যালোচনা করলে সচেতন মহলের চোখ কপালে উঠার অবস্থা হবে। কোন দলের ইশতেহারে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে Practical and Pragmatic কোন নির্দেশনাই ছিলনা।

ব্রিটেন এর প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার নির্বাচনী ইশতেহারে।স্বাস্থ্য খাত ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ বা ব্রেক্সিটের একটি অন্যতম কারন। স্বাস্থ্য খাতকে কেমন গুরুত্বের সাথে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট দেখে তার একটি উদাহরন পাওয়া যায় গত ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দেশবাসীর উদ্দেশে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বানী থেকে।বরিস জনসন তার বানীতে বলেন “ …So the NHS will always be my top priority. One our first actions will be to pass a bill enshrining in law a record funding settlement for the NHS, providing an extra £34 billion a year. We will undertake the largest hospital building programme in living memory, delivering 40 new hospitals and 20 upgrades. We’ll ensure there are 50,000 more nurses, 6,000 more GPs, and 50 million more GP surgery appointments.” যেখানে তিনি National Health Service (NHS/ জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা)এর সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি বিল পাশ করে প্রতিবছর ৩৪ বিলিয়ন পাউন্ড দিতে চেয়েছেন, আরও বেশী হাসপাতাল বানাতে চেয়েছেন, আরও বেশী ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ দিতে চেয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কিভাবে করোনার সময়ে স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছে, তা সকলেরই জানা। সেখানকার প্রত্যেকটি নাগরিক উন্নত স্বাস্থ্য সেবা ভোগ করেছে। বিশ্ব মহামারী করোনার সময়েও এই দেশগুলো ঠিকই উন্নত স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করেছে। ICU নিয়ে সেখানে কোন হাহাকার দেখা দেয়নি, পর্যাপ্ত ICU ছিল। ICU র অভাবে কোন লোককে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয়নি। চিকিৎসার জন্য রোগীকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তায় কোন নাগরিকের মৃত্যু হয়নি। চিকিৎসার অভাবে রোগীকে নিয়ে সারা রাত রাস্তায় কাটাতে হয়নি, চিকিৎসার অভাবে সন্তানকে তার বাবার বা বাবাকে সন্তানের করুন মৃত্যু দেখতে হয়নি। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের সাধারন হাসপাতালে আর সব রোগীর মতোই চিকিৎসা নিয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার আশায় অন্য কোথাও পাড়ি জমাননি । বড় বড় শিল্পপতিরাও বাঁচলে এখানেই, নইলে চিকিৎসা নিয়ে নিজদেশেই মানে ইউকেই মৃত্যুবরন করেছেন।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আরে ভাই, বাংলাদেশ তো আর আমেরিকা বা ব্রিটেন নয়। আচ্ছা বলুনতো ভাই বাংলাদেশে কয়টি বড় বড় সমস্যা আছে? হাতে গোনা পাঁচ থেকে দশটি সমস্যা আছে; এইতো ধরুন, আবাসন সমস্যা, নিরাপদ পানির সমস্যা, সবার জন্য সার্বজনীন শিক্ষা সমস্যা, বর্ষার মৌসুমে জলাবদ্ধতার সমস্যা, ট্রাফিক সমস্যা, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণসহ আরও কয়েকটি, যার তালিকার অন্যতম হল চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা।

বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলেছে। একেকটি নির্বাচিত সরকার যদি তাঁদের প্রতিটি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা কালীন সময়ে কমপক্ষে একটি করে সমস্যার সমাধান করতেন, তাহলে কিন্তু বাংলাদশে আমি মনে করি চিকৎসা ব্যবস্থা সমস্যার মতো অতিবড় সমস্যাটি আজ থাকতো না।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ, ৯৪ বছর বয়সে পুনঃনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর পরই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন আজ থেকে প্রায় তিন যুগ আগে। মাহাথির পার্শ্ববর্তী দেশ সিঙ্গাপুর মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা করার সময়ই উপলব্দি করেছিলেন কি ভাবে স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি করা যায়। তাইতো তিনি প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে একবার অসুস্থ হলেও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করাতে না গিয়ে বরং তার নিজের দেশের স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি করার জন্য ভাল মানের হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন। অন্য দেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়া কে তিনি মনে করেছেন নিজের দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাকে ভিনদেশীদের সামনে তুলে ধরা যা একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খুবই অপমানজনক। পাশাপাশি মজার বিষয় হোল কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের সমসাময়িক কালেই স্বাধীনতা প্রাপ্ত কিছু দেশ। তাঁদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা আর নাইবা বললাম।

গবেষণা থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের চাইতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, অনগ্রসর ও কমসুবিধা প্রাপ্ত দেশ যেমন নেপাল, ভূটান, ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা ভিন দেশে দাঁত, কান, গলা ও চোখের চিকিৎসা করাতে যাননা। তারা এটি বিশ্বাস করেন যে বিদেশে চিকিৎসা করার অর্থ হল নিজের দেশের স্বাস্থ্য খাতের অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ করা, তারা মনে করেন এটি দেশের জন্য অসম্মানের।বরং তারা দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন হাসপাতাল ও প্যাথলজি সেন্টার তৈরি করতে মনোনিবেশ করেন এবং সেখানেই চিকিৎসা গ্রহন করে থাকেন।

কিন্তু বাংলাদশের মন্ত্রী, এমপি আর ব্যবসায়ীরা জ্বর, ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশি নিয়ে দৌড়ে ছুটে যান পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য। একবারের জন্যও ভাবেন না যাদের অর্থ নেই তারা কেমন করে বিদেশে চিকিৎসা করাবে? তারা যদি একটু স্বাস্থ্য খাতে সুনজর দেন তাহলে স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি হয়। আবার বাংলাদেশে কিছু ভিনদেশীদের দালাল শ্রেনির ডাক্তার রয়েছে যারা কিনা কথায় কথায় মন্ত্রী, এমপি ও শিল্পপতিদেরকে পরামর্শ দেয় অমুক দেশের অমুক হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়ার জন্য। বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক রিপোর্টে বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশীরা বিদেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন টাকা খরচ করে থাকেন। এই অর্থ বাংলাদেশের মোট আয়ের ১.৯৪ শতাংশ। যেমন একটি উদাহরন দেয়া যাক, ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী নাগরিককে ভারতে যাওয়ার মেডিক্যাল ভিসা দিয়েছে তারা। এ সংখ্যা ২০১৬ সালে ভারতগামী চিকিৎসা প্রার্থীদের তুলনায় দ্বিগুণ। একই বছরে থাইল্যান্ডে গিয়েছে প্রায় ৬৫০০০, আর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালতো খরচের দিক দিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে, তাতেও সেখানে চিকিৎসা নিতে যাওয়া লোকের অভাব নেই।

ফেরত আসি আগের কথায়, মোহাম্মদ নাসিম সাহেবের মৃত্যু যেন আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল যে বাংলাদশের বিত্তশালীরা কোন ভাবেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখতে পারছেনা। সরকারী হাসপাতালগুলোর নাজেহাল অবস্থা, দুর্নীতি, আর নিম্ন মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা আজ জনসম্মুখে প্রতীয়মান। করোনায় আক্রান্ত কোন একজন বিত্তশালীও সরাকারি হাসপাতালে ভর্তি হননি। বরং অন্তিম মুহূর্তেও বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। যেমনটি করেছেন নাসিম সাহেবের পরিবারবর্গ, আবার অন্য দিকে করোনা কালীন সময়ে মোরশেদ খানের মতো লোকেরা দেশ ছেড়েও পালিয়েছে। মহামারী করোনার সময়ে কিন্তু কেউ বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারেনি। যত সামান্য চিকিৎসা দেশের মধ্যেই হয়েছে, বা চলছে। এখনও কি আমাদের শিল্পপতিরা ও কর্তা ব্যক্তিরা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কিছু ভাববেন না, কিছু করবেন না, তাঁদের বিবেক কি এখনও জাগ্রত হবে না? সময় এখনও শেষ হয়ে যায় নি, তাইতো প্রধানমন্ত্রীকে এখনই ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এতই নিম্নমানের হয়ে পড়েছে যে আজ অজপাড়াগাঁয়ের বা গ্রামের মানুষও দেশীয় চিকিৎসার উপর আস্থা রাখতে পারছেনা। দেখা যাচ্ছে গ্রামের মানুষও আজ কিছু হলেই চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া চলে যায়। হ্যাঁ, বাংলাদেশে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে যেখানে ভাল চিকিৎসা সম্ভব, তবে খুবই ব্যয়বহুল। শুধুমাত্র একটি নীতিমালার মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিশেষ করে Pathological ও Diagnosis সেন্টার গুলোর দৌরাত্ম লাগামহীন। গোপনে রয়েছে হীন মনবিকতা সম্পন্ন কিছু ডাক্তার নামের অমানুষের কমিশন বাণিজ্য, যার কারনে একই পরীক্ষা বিভিন্ন Diagnosis সেন্টারে বিভিন্ন ভাবে করিয়ে রোগীকে হয়রানি করা হয়। একটি কেন্দ্রিয় Pathological টাস্কফোর্সের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে; কেবল মাত্র অনুমোদিত Pathological সেন্টারের মাধ্যমে কৃত সকল Pathological পরীক্ষা ও তার ফলাফল সমগ্র দেশ ব্যাপী সমান গ্রহনযোগ্য হবে।এতে করে সাধারন জনগনের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসবে, পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয়ও অনেকাংশে কমে যাবে আর বিদেশে পাড়ি দেওয়ার প্রবনতাও অনেকাংশে কমে যাবে এবং দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।

মানুষের আস্থা আপনাকেই ফিরাতে হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী; আপনি একটি উদ্যোগ নিলে, বাংলাদেশে প্রতিটি বিভাগে একটি করে ভাল মানের হাসপাতাল করা সম্ভব। বাংলাদেশে অসংখ্য ধনী, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা ইচ্ছে করলেই ভাল মানের হাসপাতাল করতে পারেন। আপনি যদি বসুন্ধরা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, কনকর্ড গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, অরিয়ন গ্রুপের শিল্পপতিদের কে ডেকে বলে দেন; তোমরা বাংলাদেশে উন্নত মানের হাসপাতাল তৈরি করো, যাতে আমার দেশের টাকা যেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে না যায়; আমার দেশের সবাই যাতে ভাল চিকিৎসা দেশেই পায়। দেখবেন, বাংলাদেশে ভাল মানের হাসপাতাল হয়ে যাবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যেমন সাহস করে বলেছিলেন যে “আমি যদি কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে আপনারা আমাকে বিদেশে নেবেন না। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ওঠাবেন না। আমি দেশের মাটিতেই চিকিৎসা নেব। দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নেব।” আপনি যদি আপনার কথা রাখেন, আর চিকিৎসা খাতে নজর দেন, যেমন দুর্নীতি নির্মূলের জন্য মাঠে নেমেছেন তেমনি ভাল হাসপাতালের জন্য মাঠে নামেন, বিশ্বাস করুন, টাকার অভাব হবে না, হাসপাতাল হয়ে যাবে। দুর্নীতিবাজদের টাকা উদ্ধার করেও কিন্তু ভাল মানের হাসপাতাল গড়ে তোলা সম্ভব। দরকার শুধু আপনার সিদ্ধান্তের।

বরাবরের মতো চিকিৎসা খাত এবারের বাজেটেও অনুল্লেখেতি।করোনা মহামারীতে দেশ যখন বিপর্যস্ত তখনই জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করা হল। দেশবাসী আশা করেছিল অন্তত এবারের বাজেটে চিকিৎসা খাত উন্নয়নে আলাদা করে একটি ভাল বরাদ্দ দেওয়া হবে। যাতে উন্নত মানের হাসপাতাল দেশে গড়ে তোলা সম্ভব হয়। যেখানে পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সব মিলে নতুন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা সেখানে চিকিৎসা খাত অবহেলিত।

হাসপাতাল স্থাপন একটি অনেক বড় চ্যারিটেবল কাজ, যার সুফল পাবে দেশবাসী আর সওয়াব পাবেন যিনি এর উদ্যোক্তা, অর্থদাতা, পরামর্শ দাতা এবং এই মহতি কাজের সাথে জড়িত সবাই। মানুষ মরে গেলে তার সমস্ত ভাল কাজ ও আমলের পথ বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু ভাল কাজ যেমন হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ সংস্কার মূলক কাজ করে গেলে একদিকে যেমন এর বিনিময় কবরে পেতে থাকবেন, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি ঐ ব্যক্তির স্মৃতি বহন করবে যুগ যুগ ধরে।সুরা মুনাফিকুনের ১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়লা বলেছেন – “আমি তোমাদের যা কিছু অর্থ সম্পদ দিয়েছি তা থেকে তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো তোমাদের মৃত্যু আসার আগেই, কেননা মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়ালে সে বলবে হে আমার রব, তুমি যদি আমাকে আরও কিছু অবকাশ দিতে তাহলে আমি তোমার পথে দান করতাম এবং এভাবেই তোমার নেক বান্দাদের দলে শামিল হয়ে যেতাম”. সেদিন যাতে আফসোস করতে না হয়।তাই এখনও সময় আছে সুন্দর ও জনকল্যাণ মুলক কাজ করে Legacy বা ঐতিহ্য রেখে যাওয়ার। বিশেষ করে বাংলাদেশের শিল্পপতি, মন্ত্রি পরিষদ, ব্যবসায়ীরা একটু উদ্যোগ নিলেই বাংলাদেশে গড়ে তোলা সম্ভব বিশ্ব মানের আধুনিক হাসপাতাল। আর এই ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভুমিকা অনস্বীকার্য।

আন্তর্জাতিক কর্পোরেট নির্বাহী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফল ব্যবসায়ী হিসাবে দু’বার নির্বাচিত ব্যক্তিত্ব, যিনি মানুষের কল্যাণের জন্য দারিদ্রতা নিরসনে, অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনে, উন্নত শিক্ষা, উন্নত চিকিৎসা, ও উন্নত পরিবেশ নিশ্চিতকরণে, সামাজিক সুবিচার স্থাপনে, এবং বর্ণ-বৈষম্য দুরিকরন নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন তিনি হলেন E Cabell Brand. তার If Not Me, Then Who? নামক গ্রন্থে অর্থনৈতিক সুবিধা ও ন্যায়-বিচার, শিক্ষা, চিকিৎসা, জাতিগত ন্যায়-বিচার, মৌলিক মানবাধিকার, ও নানাবিধ সামাজিক সমস্যা সমাধানে তিনি ব্যাক্তিকে সবার আগে এগিয়ে এসে সমস্যা সমাধানে অন্তর্ভুক্ত হতে এবং কার্যকরী ভুমিকা রাখতে বেশী বেশী উৎসাহিত করেছেন, তাই আমারাও বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, If Not You, Then Who?, আপনি যদি চিকিৎসা ব্যবস্থা সমস্যার এখনই সমাধান করতে না পারেন, তাহলে কে পারবে?

পরিশেষে, বারাক ওবামার ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ সংকলিত Words that Changed a Nation বইয়ের সাথে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই Your decision that can change the medical system in Bangladesh। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপানকেই ভাল হাসপাতাল করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে, আপানার সিদ্ধান্তই পারবে বাংলাদেশে উন্নত মানের হাসপাতাল গড়ে তুলতে, তাই সিদ্ধান্ত আপনার।পদক্ষেপ আপনাকেই নিতে হবে।

লেখকঃ ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব, সলিসিটর, ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস


Spread the love

Leave a Reply