ফ্রান্সে বর্বরতা
* মহানবী (সাঃ) নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ *পত্রিকা অফিসে গুলিবর্ষন * সম্পাদক – পুলিশ সহ নিহত ১৩ *প্রতিবাদে মসজিদে মসজিদে হামলা *ব্রিটেনে সতর্কতা
* মুসলমান সংখ্যাঃ ফ্রান্স ৫০ লাখ,জার্মানিতে ৪০ লাখ এবং ব্রিটেন ৩০ লাখ
বাংলা সংলাপ রিপোর্টঃ
ফ্রান্সের প্যারিসে শার্লি হেবদো নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার কার্যালয়ে গত বুধবার কালাশনিকভ রাইফেল ও রকেট লঞ্চার নিয়ে হামলা চালিয়েছে তিন ব্যক্তি। এতে পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক ও তিন ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী এবং পুলিশ সদস্যসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। তাঁদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর। এদিকে বৃহস্পতিবার এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছেন পুলিশের এক নারী কর্মকর্তা। গুরুতর আহত হয়েছেন আরেকজন। প্যারিসের দক্ষিণে শহরতলি মঁরুজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে বন্দুকধারী পালিয়ে গেছে। আজ বিবিসির এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়।
এ ঘটনায় ইউকে বর্ডারে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে । যাতে করে কোন সন্ত্রাসী ব্রিটেনে প্রবেশ করতে না পারে সে লক্ষে ইউকে বর্ডারে অতিরিক্ত সিকিউরিটি বসানো হয়েছে । বিশেষ করে ফ্রান্স থেকে আগত যাত্রীদের অতিরিক্ত তল¬াশি করা হচ্ছে । প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরুন বৃহশপ্রতিবার এক বার্তায় অতিরিক্ত সিকিউরিটির বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং ইউকে বর্ডারে সর্বোচ্চ সতর্কতার নির্দেশ দেন ।
ফ্রান্সে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হিসেবে দেখা হচ্ছে একে। হামলাকারীরা পাকড়াও না হওয়ায় আরও হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। খবর এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসির।
ব্যঙ্গধর্মী পত্রিকা শার্লি হেবদো ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে। ওই সময় তারা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি ব্যঙ্গচিত্র পুনর্মুদ্রণ করলে মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ব্যঙ্গচিত্রটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ডেনমার্কের দৈনিক জিল্যান্ডস-পোস্টেন পত্রিকায়। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরেও শার্লি হেবদো মহানবী (সা.)-এর একটি অবমাননাকর ছবি ছাপে। এ ছাড়া পত্রিকাটির সর্বশেষ একটি টুইটে ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির ব্যঙ্গচিত্র প্রচার করা হয়।
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, তিন ব্যক্তি গতকালের হামলায় অংশ নেয়। কালো মুখোশে ঢাকা ছিল তাদের মুখ। স্থানীয় সময় গতকাল সকালে প্যারিসের বুলেভা রিশা-লোনোয়া সড়কের কাছে অবস্থিত পত্রিকা কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে তারা। তাদের মধ্যে একজনের হাতে ছিল কালাশনিকভ রাইফেল। একজন বহন করছিল রকেট লঞ্চার।
বোনোয়া ব্রিনে নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘অস্ত্র হাতে কালো মুখোশধারী কয়েকজন ব্যক্তি ভবনটিতে ঢুকে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা একের পর এক গুলির শব্দ শুনি। এরপর ভবনটি থেকে তারা বের হয়ে যায়।’
একই ভবনে কর্মরত আরেক ব্যক্তি গিল বুলঁজে বলেন, ‘ভবনে সশস্ত্র ব্যক্তিদের প্রবেশের বিষয়ে প্রতিবেশী একজন ফোন করে আমাকে সতর্ক করেন। এরপর আমরা সব দরজা বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান নিই। কয়েক মিনিট পর বিভিন্ন দিক থেকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের একের পর এক গুলির শব্দ শোনা যায়। তখন জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে পাই, বুলেভা রিশা-লোনোয়া সড়কের ওপর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকধারীদের গোলাগুলি চলছে। দেখে মনে হচ্ছিল, কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে আছি।’
পুলিশ জানায়, হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক স্তিফান শার্বোনিয়ে (৪৭)। তিনি শার্ব নামে পরিচিত ছিলেন। আল-কায়েদা ২০১৩ সালে যে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকা প্রকাশ করে, তাতে তাঁর নাম ছিল। অতীতে বেশ কয়েকবার মৃত্যুর হুমকি পাওয়া শার্বোনিয়ে পুলিশি নিরাপত্তায় ছিলেন। নিহত অন্য তিন ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী জঁ কবু, তিনু এবং জর্জ ওলিনস্কি নামে পরিচিত ছিলেন। আর যে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, তাঁরা ভবনটির নিচে গোলাগুলির সময় প্রাণ হারিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশ জানায়, হত্যাযজ্ঞ শেষে হামলাকারীরা একটি কালো রঙের গাড়ি ছিনতাই করে দ্রুত পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা ‘আমরা মহানবী (সা.)-কে অবমাননা করার প্রতিশোধ নিয়েছি’ বলে চিৎকার করছিল। হামলাকারীদের ধরতে প্যারিসজুড়ে বড় ধরনের অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।
হামলার ঘটনার পর ঘটনাস্থলে যান ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। তিনি বলেন, ‘এটা যে সন্ত্রাসী হামলা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ এ ঘটনাকে ‘ব্যতিক্রমধর্মী বর্বর কাজ’ আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন তিনি।
ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয় আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফ্রান্সের যোগদানের ঘোষণা দেওয়ার পর জঙ্গিরা গত বছরের শেষের দিকে ফরাসি নাগরিকদের ওপর হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়েছিল। এরপর দেশটিতে ছোটখাটো বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত ডিসেম্বরে দিজন শহরে পথচারীদের ওপর গাড়ি চালিয়ে দেন এক ব্যক্তি। এতে ১৩ জন আহত হয়। একই মাসে মধ্যাঞ্চলীয় জু-লে-তুর এলাকায় এক ব্যক্তি ছুরি নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে তিন পুলিশ আহত হওয়ার পর পুলিশের গুলিতে ওই ব্যক্তি নিহত হয়। ঘটনাগুলোর পর থেকে দেশটিতে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা জারি রয়েছে। এরই মধ্যে গতকালের হামলা ঘটল।
বিশ্বজুড়ে নিন্দা: হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, তুরস্ক, কাতার, আরব লিগ, মিসরের আল-আজহার কর্তৃপক্ষ, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন।
এই হামলাকে ভয়ানক, অযৌক্তিক ও ঠান্ডা মাথার খুন আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন, গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর, গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এ এক সরাসরি আঘাত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ হামলাকে ভয়ংকর উলে¬খ করে সন্ত্রাসীদের ধরতে প্রয়োজনীয় যেকোনো সহায়তার প্রস্তাব দেন।
হামলার নিন্দা করে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফ্রান্সের জনগণের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।
মসজিদে মসজিদে হামলাঃ
ফ্রান্সে বুধবার রাতে বেশ কয়েকটি মসজিদে হামলা হয়েছে। দুর্বৃত্তরা দুটি মসজিদে আগুনও দিয়েছে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি।
প্যারিসে বুধবার কার্টুন পত্রিকা ‘শার্লি হেবদো’র কার্যালয়ে হামলার প্রেক্ষাপটে মসজিদে হামলা চালানো হলো।
বুধবার মধ্যরাতের পর প্যারিসের পশ্চিমে লে ম্যান্স নগরীতে একটি মসজিদে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এতে মসজিদটির জানালায় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
দক্ষিণ ফ্রান্সের নরবোনে মাগরিব নামাজের পরপরই একটি নামাজ-ঘরে গুলিবর্ষণ করা হয়। ওই সময় সেখানে কেউ ছিলেন না বলে স্থানীয় আইনজীবী জানিয়েছেন।
ভিলেফ্রাসিস-সাওয়ান নগরীর কাছে বৃহস্পতিবার সকালে একটি মসজিদের নিকটস্থ একটি কাবাব দোকানে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতেও কেউ হতাহত হয়নি।
জঙ্গিবাদ নিয়ে সংকটে ইউরোপঃ
ফ্রান্সে বিতর্কিত ব্যঙ্গাত্মক পত্রিকার কার্যালয়ে গত বুধবারের ভয়াবহ হামলা পাশ্চাত্যকে স্তম্ভিত করেছে। এ ঘটনা তাদেরকে সেসব কট্টরপন্থী তরুণের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, যারা উগ্রপন্থীদের মৌলবাদী ব্যাখ্যায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভিন্নমতাবলম্বী যে কাউকে হত্যা করতে তৈরি।
ইসলামি উগ্রপন্থার বিস্তারের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন সমাজে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। চরমপন্থী ইসলামি মতবাদকে কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত, তা নিয়ে নানা ধরনের চিন্তাভাবনা হচ্ছে।
ইসলাম ধর্মে সন্ত্রাসবাদের স্বীকৃতি নেই—এ কথা উল্লেখ করে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মূলধারার মুসলিম সংগঠনগুলো প্যারিসে জঙ্গি হামলার দ্ব্যর্থহীন নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু ইউরোপের কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠনের তীব্র প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে সেখানকার সাধারণ মুসলমানরা নানা রকমের হয়রানির শিকার হতে পারে। ধর্মের নামে সহিংসতা মোকাবিলায় এখন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং ইউরোপের ধর্মীয় নেতাদের সঠিক পথ বেছে নিতে হবে।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে সহিংসতার ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশ বাড়ছে। শিল্পকলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রভূত বিকাশের যুগের (এনলাইটেনমেন্ট) পরবর্তী সময়ে ইউরোপে ধর্মীয় ব্যাপারে উদার মনোভাবের প্রচলন হয়েছে। সেক্যুলার পশ্চিমা সমাজে ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে অবাধ সমালোচনা হয়। তবে ইসলামের ব্যাপারটা ভিন্ন।
প্যারিসে সর্বশেষ জঙ্গি হামলার ঘটনাটির জন্য হয়তো গুটিকয়েক ব্যক্তি দায়ী, কিন্তু ওই সহিংসতার পরিণাম গোটা পশ্চিমা বিশ্বকেই স্পর্শ করবে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে অভিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি সন্দেহ ক্রমশ বাড়ছে। ওই দুটি দেশ এবং যুক্তরাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যার দিক থেকে ফ্রান্সই এগিয়ে। দেশটিতে প্রায় ৫০ লাখ মুসলমানের বসবাস, যা মোট জনসংখ্যার সাড়ে ৭ শতাংশ। জার্মানিতে ৪০ লাখ এবং যুক্তরাজ্যে ৩০ লাখ মুসলমান রয়েছে, যা দুটি দেশেরই মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ। অভিবাসন নিয়ে জনগণের অসন্তোষের ব্যাপারটি এই তিন দেশেই মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে ইহুদিবিদ্বেষ ক্রমশ বাড়তে থাকায় এবং জঙ্গিদের হামলায় ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ হতাহত হওয়ায় তাদের অনেকে ইসরায়েল ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
জার্মানিতে চরমপন্থী কিছু সংগঠন ও রাজনৈতিক দল মুসলিম অভিবাসীদের প্রবেশ সীমিত করার দাবিতে সম্প্রতি বড় ধরনের আন্দোলন শুরু করেছে। দেশটির প্রধান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা এ ধরনের আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।