বাংলাদেশে র‍্যাবের হাতে আটক নারীর মৃত্যু

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশের উত্তরে নওগাঁ সদরে র‍্যাবের হাতে আটক হওয়া এক নারী অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে মারা যাবার পর তার স্বজনরা অভিযোগ করছেন, হেফাজতে থাকাকালীন নির্যাতনের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে র‍্যাব এ অভিযোগ অস্বীকার করছে।

র‍্যাব বলছে, সুলতানা জেসমিন (৪২) নামে ওই নারী তাদের হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তার মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। তাদের মতে, একে ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বলা যাবে না।

তবে মানবাধিকার কর্মীরা র‍্যাবের এই যুক্তি মেনে নিচ্ছেন না। সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুকে “র‍্যাবের হেফাজতে মৃত্যু” হিসেবেই আখ্যা দেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।

নিহত সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন।

গত ২৪শে মার্চ সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

তাকে আটক করা হয়েছিল ২২শে মার্চ সকালে।

আটক ও অতঃপর

স্বজনদের দাবি, বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সুলতানা জেসমিন অফিসে যাওয়ার পথে র‍্যাব সদস্যরা রাস্তা থেকে তাকে মাইক্রোবাসে করে ধরে নিয়ে যায়।

র‍্যাবের দাবি, তার বিরুদ্ধে আরেকজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তার নামে টাকা চাওয়া বা চাকরি দেয়ার নামে বহু মানুষের সাথে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল।

এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা আর্থিক প্রতারণার মামলা করলে সুলতানা জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।

তবে আটক হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

র‍্যাব বলছে, নওগাঁয় র‍্যাবের কোন ক্যাম্প না থাকায় তাকে আটক করার পর পাশের জয়পুরহাট ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কথা ছিল।

কিন্তু তার আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ বিষয়ে র‍্যাব-৫ এর অধিনায়ক রিয়াজ শাহরিয়ার জানান, “যে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণার অর্থ লেনদেন হতো – সেটির সূত্র ধরে সুলতানা জেসমিনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসে।”

“ক্যাম্প যেহেতু দূরে, তাই আটকের পর গাড়ির ভেতরেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়” – বলেন তিনি।

“তখন র‍্যাব সদস্যরা তার মোবাইল নিয়ে লক খুলতে বললে তিনি ভীষণ ঘাবড়ে যান, ঘামতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি পাসওয়ার্ড দিলে আমরা অভিযোগের কিছু সত্যতা পাই। এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই তিনি বমি করতে শুরু করেন। তখন আমরা তাকে দ্রুত নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

র‍্যাব
র‍্যাবের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বহু অভিযোগ রয়েছে।

প্রথমে তাকে নেয়া হয় নওগাঁ হাসপাতালে

আটকের দিন দুপুরে মিসেস জেসমিনের ফোন থেকে তার ছেলেকে কল করে মায়ের অসুস্থতার কথা জানানো হয় এবং নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে আসতে বলা হয়।

পরে জেসমিনের মামা নাজমুল হক খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে তিনি দেখতে পান তার ভাগ্নিকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে।

তার সাথে র‍্যাবের পোশাক পরা কয়েকজনকেও দেখতে পান তিনি।

মি. হক বলেন, “হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ভাগ্নিকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। এসময় আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করি কিন্তু সে কোন কথা বলতে পারছিল না।”

“তাই জানতেও পারিনি যে কি হয়েছে” – বলেন তিনি।

নাজমুল হক বলেন, “আশেপাশের মানুষের থেকে জেনেছি যে তাকে নাকি র‍্যাব ধরে নিয়ে গিয়েছে। আমরা র‍্যাব অফিস, ডিবি অফিস যাই। কোথাও পাইনি। পরে খবর পাই যে সে হাসপাতালে ভর্তি।”

নওগাঁ থেকে রাজশাহী মেডিকেলে, সেখানেই মৃত্যু

নওগাঁ হাসপাতালে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন থাকার পর অবস্থার অবনতি হলে মিসেস জেসমিনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার দুপুরে র‍্যাবের সদস্যরা মিসেস জেসমিনকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন।

এসময় তিনি কথা বলতে পারছিলেন বলে সূত্রটি জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ সূত্রটি বলেন, “রোগী সেসময় শরীরের দুর্বলতা, মাথা ঘোরানো ও বমি বমি ভাবের কথা চিকিৎসককে জানান। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।”

তবে বিকেলের দিকে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকলে তিনি অর্ধ-চেতন হয়ে পড়েন।

তখন নওগাঁ হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে রাজশাহী মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।

কিন্তু রাজশাহীতে নেয়ার পর তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তিনি মারা যান।

তবে শুক্রবার সকালে তার মৃত্যু হলেও স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয় শনিবার বিকালে। শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের বুঝিয়ে দেয় র‍্যাব।

জানাজা শেষে শনিবার রাতে তাকে নওগাঁ সরকারি গোরস্থানে দাফন করা হয়।

র‍্যাব

মাথায় ‘আঘাতের চিহ্ন’

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এফ এম শামীম আহাম্মদ বিবিসিকে জানান, মিসেস জেসমিনকে বুধবার সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় এনে ভর্তি করেছিল র‍্যাব।

“তার মাথার ডানদিকে কানের ওপরের অংশে হালকা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়” বলেন মি. আহম্মদ – “ওই সময় নিউরোসার্জারি বিভাগে তার সিটি স্ক্যান করালে মস্তিষ্কের কয়েকটি জায়গায় রক্তক্ষরণ দেখা যায়।”

পরে তাকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে সুলতানা জেসমিন মারা যান।

শামীম আহম্মদ বলেন, তার মেডিকেল রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে “মস্তিষ্কে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণের” কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে তার শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

শামীম আহম্মদ জানান, “র‍্যাবের ভাষ্যমতে ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। রোগীর হিস্ট্রিতে এমনটাই জানতে পেরেছি।”

কিন্তু পরে র‍্যাবের কর্মকর্তা রিয়াজ শাহরিয়ারের কাছে হাসপাতালকে তাদেরই দেয়া এই ‘ভাষ্যের’ কথা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মত কিছুই ঘটেনি।”

র‍্যাব কর্মকর্তা আরো বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের দেয়া সুরতহাল রিপোর্টেও মিসেস জেসমিনের শরীরের কোথাও আঘাতের কথা উল্লেখ নেই।

তার আগে নওগাঁ সদর হাসপাতালের দেয়া মেডিকেল রিপোর্টেও রোগীর শরীরের কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা উল্লেখ ছিল না।

সেখানে রোগীকে “হৃদরোগে আক্রান্ত” বলে উল্লেখ করা হয়।

‘নির্যাতনের’ অভিযোগ পরিবারের

নিহতের পরিবার র‍্যাবের বিরুদ্ধে ‘নির্যাতনের’ অভিযোগ তুললেও এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের বা এখন পর্যন্ত কোন মামলা দায়ের করেনি।

এ নিয়ে মিসেস জেসমিনের মামা নাজমুল হক বলেন, “জেসমিনের ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া আর কোনও পেপার আমাদের হাতে নাই। পোস্টমর্টেমের কাগজসহ অন্য নথি পাওয়া গেলে পারিবারিকভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।”

“যদি রিপোর্টে অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখায় অবশ্যই মামলা করবো। ভয় করে লাভ আছে?” – বলেন তিনি।

মিসেস জেসমিনকে সকালে রাস্তা থেকে তুলে নেয়ার পর তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ পরিবারের সদস্যদের।

মি. হক বলেন, “যদি কোন অভিযোগ থাকে তাকে তো অফিস থেকেই আটক করতে পারতো। রাস্তা থেকে তুলে নেয়ার কি হল? তাও আমরা এখন কিছু বলবো না। রিপোর্ট পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেব।”

হেফাজতে মৃত্যু প্রতীকী
হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে বাংলাদেশে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ রয়েছে

নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার

র‍্যাব বলছে, সুলতানা জেসমিন অসুস্থ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরিবারের লোকজন তার সঙ্গেই ছিল।

নির্যাতনের যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয় বলে দাবি করেন দুই র‍্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মুইন ও রিয়াজ শাহরিয়ার।

র‍্যাব-৫ এর অধিনায়ক রিয়াজ শাহরিয়ার বিবিসিকে বলেন, “আমরা তাকে শুধুমাত্র মৌখিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনিও একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন, তার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করা হয়নি। আমাদের সাথে এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ছিলেন। এর মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।”

নিহতের মাথায় আঘাতের বিষয়ে জানতে চাইতে তিনি বলেন, তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তিনি কোন ধরণের আঘাত পাননি। সুরতহাল রিপোর্টেও আঘাতের কোন উল্লেখ নেই।

তবে র‍্যাবের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে সেটি কেন্দ্রীয়ভাবে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার মঈন।

এই ঘটনাকে “হেফাজতে মৃত্যু” বা “হেফাজতে নির্যাতন” বলে যে খবর প্রচার হচ্ছে – একে ভিত্তিহীন বলে দাবি করছেন তিনি।

তার মতে, র‍্যাবের হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়েছেন। কিন্তু মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এখন পর্যন্ত পাওয়া মেডিকেল রিপোর্টে নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ মেলেনি।

মি. মঈন বলেন, “র‍্যাবের হেফাজত থেকে কাউকে যদি মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয় বা ডেথ বিফোর অ্যারাইভাল হয়, সেটাকে হেফাজতে মৃত্যু বলা যেতে পারে। কিন্তু উনি তো হাসপাতালে দুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। তো এটা হেফাজতে অসুস্থ হতে পারে। কিন্তু হেফাজতে মৃত্যু বলা নীতিসিদ্ধ হবে না।”

সুলতানা জেসমিন প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী, এবং তাকে সব নিয়ম মেনেই আটক করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

র‍্যাব বলছে, তাকে পথিমধ্যে আটক করা হলেও জোর জবরদস্তি করা হয়নি – তিনি স্বেচ্ছায় গাড়িতে উঠেছেন।

প্রতীকী

‘এটি র‍্যাবের হেফাজতে মৃত্যু’

তবে একজন নারী সরকারি কর্মচারীকে র‍্যাব যেভাবে রাস্তা থেকে আটক করেছে কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই। সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

তাদের মতে, একজন মানুষকে রাস্তা থেকে আটক করা কোন বিধিসম্মত পদ্ধতি নয়।

এছাড়া সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুকে “র‍্যাবের হেফাজতে মৃত্যু” হিসেবেই আখ্যা দেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।

তার মতে, যখনই একজন অভিযুক্তকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের হাতে তুলে নেয় তখন থেকেই তিনি তাদের হেফাজতে চলে যান।

এই হেফাজতে থাকা অবস্থায় কেউ যদি অসুস্থ হন বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান, তার দায় ওই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই নিতে হবে। কারণ তিনি তখনও আটক অবস্থাতেই ছিলেন।

মি. খান বলেন, “ওই নারীর মাথায় চিকিৎসকরা আঘাত পেয়েছেন। আমাদের আরও কয়েকটি সূত্র আঘাতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।”

“মাথার আঘাত তো তাদের হেফাজতেই হয়েছে। তাই র‍্যাবের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।”

তিনি জানান, বাংলাদেশে এই ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটে আসছে এবং র‍্যাবের বিরুদ্ধে এর আগেও হেফাজতে নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। আর এটিই শেষ ঘটনা নয়।

অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে যতক্ষণ না কোন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে ততোক্ষণ পর্যন্ত এই নির্যাতনের মাত্রা বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

“র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন না। তাদের কার্যক্রমের কারণে তারা বিদেশিদের নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়েছে। এটি দেশের জন্য মানহানিকর। এখন যা অবস্থা, এতে একটি-দুটি ঘটনার তদন্তে কাজ হবে না। সরকারের উচিত হবে পুরো বাহিনীকে ঢেলে সাজানো,” বলেন মি. খান।


Spread the love

Leave a Reply