ব্রিটেনের স্কুলে মাতৃভাষার তালিকায় ‘সিলেটি ভাষা’

Spread the love

map_sylhetমুনজের আহমদ চৌধুরী
সিলেটের নাগরি লিপি ব্রিটেনের স্কুলগুলোতে স্বকীয় ভাষা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে সিলেটি ভাষা। বাংলা ভাষার পাশাপাশি কিছু স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার তালিকায় সিলেটি ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে স্কুলগুলো।
সিলেটি পরিবারগুলোর বহু ব্রিটিশ ছাত্রছাত্রী প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী নন। বাংলা ভাষা বলতে তারা ঘরে মা-বাবার কাছে শোনা সিলেটি ভাষাকেই জানেন। এমন বাস্তবতায় ব্রিটেনের কিছু স্কুলে মাতৃভাষার তালিকায় বাংলা ভাষার পাশাপাশি সিলেটি ভাষাকেও স্বতন্ত্র একটি ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ফরহাদ হোসেন টিপু নামে লন্ডন প্রবাসী একজন অভিভাবক বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘ব্রিটেনে কলকাতার বাঙালিও অনেক। ব্রিটেনের অনেক বাঙালিই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে অনভ্যস্ত। তারা দুটি ভাষা জানেন- সিলেটি ও ইংরেজি। এমন বাস্তবতায় স্কুলগুলো এই পদক্ষেপ নিয়েছে।’ ফরহাদ হোসেন টিপু আরও জানান, শুধু লন্ডনের রেডব্রিজের একটি স্কুলেই নয়, বিভিন্ন স্কুল এই পদক্ষেপ নিয়েছে। নাগরি বর্ণমালা ও সিলেটি ভাষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা ড. মুমিনুল হক বলেন, ‘এটি ব্রিটেনের বুকে সিলেটের অর্জন।’ এ ব্যাপারে ব্রিটেনের প্রথম ব্রিটিশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এমপি রুশনারা আলী বলেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে শিশুদেরকে নিজের মায়ের ভাষার আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে ।’
95d624319ec660a2764ae5d7fe4d4ff7-594b9f2be643cবিলুপ্তির পথে সিলেটের নাগরি লিপি :এদিকে  তুহিনুল হক তুহিন নাগরি লিপির গবেষকদের বরাত দিয়ে জানান, ৫০ থেকে ৭০ বছর আগে নাগরি লিপি প্রায় বিলুপ্তি হয়ে যায়। সময়ের ব্যবধানে এ লিপির মূদ্রণ, চর্চা আর পাঠকও কমে যায়।
১৮৬০ সালে নাগরি লিপির মুদ্রণ শুরু হলে এর সাহিত্য আবেদন সিলেট অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ধারা মধ্য বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চলমান ছিল। তখন কলকাতা, শিলচর, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে নাগরি লিপিতে রচিত পুঁথি প্রকাশিত হতো। সিলেট অঞ্চলে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের চেয়ে নাগরি লিপির ব্যবহার একসময় বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দলিল-দস্তাবেজ ও হিসাব-নিকাশে এ ভাষা ব্যবহার হতো।
সিলেটি নাগরি লিপির উদ্ভব চতুর্দশ শতকে আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী অনুসরণে। এ লিপিতে রচিত হয়েছে দু’শতাধিক গ্রন্থ, দলিল-দস্তাবেজ এবং পরিচালিত হয়েছে সেকালের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কার্যক্রম। নাগরি লিপির সাহিত্য ধারণ করেছে সিলেটি উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা।
নাগরি লিপির গবেষক, পুঁথি সংগ্রহক ও প্রকাশক মোস্তফা সেলিম  বলেন, ‘নাগরিক লিপি আমাদের অমূল্য সম্পদ। এই লিপিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেই বললেই চলে। বাংলা ভাষার যে বৈচিত্র্য রয়েছে তার মূলে রয়েছে নাগরি লিপি।যত দ্রুত সম্ভব এই সম্পদকে সংরক্ষণের জন্য উদ্যেগ গ্রহণ করতে হবে। ’
তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার প্রচলিত বর্ণমালার বাইরে একটি পৃথক বর্ণমালা সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে। নানা কাহিনি, সাহিত্য, গল্প ও গান রচনা থেকে শুরু করে দলিল-দস্তাবেজ ও হিসাব-নিকাশে অধিকাংশ সিলেটি তখন নাগরি লিপি ব্যবহার করতেন। সিলেট ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ভৈরব এবং ভারতের করিমগঞ্জ, শিলচর ও আসামে এ লিপির ব্যবহার ছিল। তবে ৫০ থেকে ৭০ বছর আগে এ লিপির ব্যবহার ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে আসে।’
তিনি বলেন, ‘নাগরি লিপির উৎপত্তি স্থান সিলেটে। এই লিপিটি সম্পূর্ণ আলাদা। এ ভাষার বর্ণসংখ্যা ৩২। বর্ণনাম এবং উচ্চারণ হুবহু বাংলার মতো। সিলেট নগরের বন্দরবাজারে ইসলামিয়া প্রেস থেকে নাগরি পুঁথি প্রকাশিত হতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা ওই ছাপাখানায় হামলা চালালে নাগরি লিপির পুঁথি প্রকাশ ও চর্চা পুরোপুরিই বিলুপ্ত হয় ।’

Spread the love

Leave a Reply