ভারতে নাগরিকত্ব আইন: শঙ্কিত আসামের যেসব হিন্দু-মুসলিম
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ সকাল থেকেই প্রস্তুতি চলছিল নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে একটি অবস্থান ধর্মঘটের। অনুষ্ঠানে মাইকে বাজছিল ভূপেন হাজারিকার গান।
পাশেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে পোস্টার সাঁটছিলেন কয়েকজন যুবক। তাদের কাছে খোঁজখবর করে গিয়ে পৌঁছুলাম কিছুটা দূরের গ্রাম ষোলাগাঁওতে যেখানে এন আ রসি থেকে বাদ পড়েছেন অনেক মানুষ।
বাঙালি হিন্দু প্রধান এই গ্রামের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের নাম এন আর সি থেকে বাদ পড়েছে।
এক চায়ের দোকানে কথা হলো জগবন্ধু রায়ের সঙ্গে যার পরিবারে চারজন সদস্যের মধ্যে তিনজনেরই নাম এন আর সিতে ওঠে নি।
নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের পরে কি তারা আশায় আছেন যে এন আর সি থেকে বাদ পড়লেও এখন তারা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন?
জগবন্ধু রায় যে খুব স্বস্তিতে রয়েছেন, তা মনে হলোনা। “কেউ কেউ বলছে যে এন আর সিতে যাদের নাম আসে নি, তারা নাগরিকত্ব পাবে ঠিকই কিন্তু শরণার্থী হিসাবে। আমরা কেন শরণার্থী হিসাবে নাগরিকত্ব নিতে যাব! আমরা তো এখানকারই বাসিন্দা!”
পাশেই ছিলেন গ্রামেরই আরেক বাসিন্দা ঈশ্বর চন্দ্র রায়। তিনিও ভরসা পাচ্ছেন না।
“আমাদের কোনও লাভ-অলাভ কিছুই হবে না। উল্টে অশান্তি ডেকে এনেছে। এখানে আমরা বাঙালী হিন্দু আছি, অসমীয়ারা আছে, আর মুসলমানরা আছে, তারাও বাঙালী। এই আইনের পরে তিনপক্ষের মধ্যে একটা অশান্তি লাগিয়ে দিল সরকার।”
বাড়ির কাজে ব্যস্ত ছিলেন গ্রামের দুই নারী সরস্বতী রায় আর সুস্মিতা রায় – একজন প্রবীণ, আরেকজন মধ্যবয়সী।
নাগরিকত্ব আইনে হিন্দু বাঙালীরা কতটা লাভবান হবেন – এই প্রশ্নে সরস্বতী রায় বলেন, “নতুন আইনটা ঠিক কী জানি না, তবে শুনছি এন আর সি থেকে যারা বাদ গেছে, তাদের ভালই হবে। তাদের নাম এন আর সিতে ঢুকবে।”
আর সুস্মিতা রায়ের কথা ছিল, “সরকার বলছে এতে আমাদের ভাল হবে, আবার অনেকে বলছে এটা খারাপ। এখন সরকারই বুঝবে আমাদের কীসে ভাল হবে। আমরা সাধারণ মানুষ তো অতশত বুঝি না!”
মুসলিম প্রধান এক গ্রামের কথা
ষোলাগাঁও থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের দিকে এগিয়ে বেশ কিছুটা দূরে সনতলী মূলত মুসলমান প্রধান এলাকা।
গ্রামের বাজারে দেখা হল গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়র গবেষক ইউনুস আলি মোল্লার সঙ্গে।
তার আশঙ্কা এই আইন করা হয়েছে মুসলমানদের দেশছাড়া করতে।
“নাগরিকত্ব আইনের জোরে এন আর সি থেকে বাদ পড়া হিন্দু ভাইদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এন আর সি থেকে তো অনেক লাখ মুসলমানও বাদ পড়েছেন। তাদের কী হবে! আমার মনে হয় সরকার চাইছে মুসলমানদের দেশ ছাড়া করতে।”
ওই সনতলি বাজারে দেখা হয় সিরাজুল হক ভুঁইয়ার সঙ্গে।
নাগরিকত্ব আইনের প্রসঙ্গ তুলতেই রাগে ফেটে পড়েলেন তিনি,”এটা মুসলিম বিদ্বেষী আইন! অন্যান্য যত ধর্মের মানুষ আছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এই আইনে – শুধু মুসলমানরা বাদ ! এর অর্থটা কী!”
ফেরার পথে সমরিয়ার হাটে দেখলাম নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যে সত্যাগ্রহের প্রস্তুতি চলছিল সকালে, সেখানে বহু নারী পুরুষ – হিন্দু মুসলমান- অসমীয়া মানুষ জড়ো হয়েছেন।
তাদের মধ্যে অষ্টমী কলিতা নামে একজনের সাথে কথা হলো।
তার কথা ছিল এরকম – আসামে হিন্দু-মুসলমান সকলেই একসঙ্গে বসবাস করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। কারও মধ্যে কোনও ঝগড়া নে।. কিন্তু নতুন আইন করে যদি বিদেশীদের এখানে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয় – তা কখনই মেনে নেওয়া যায় না।
“হিন্দু হোক বা মুসলমান – স্থানীয় ছেলেমেয়েরাই বেকার বসে আছে – এই অবস্থায় বাইরের মানুষকে নতুন করে নিয়ে আসা হলে স্থানীয়রা কী করবে?”
তার সঙ্গে কথা শেষের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল তালি বাজিয়ে গান।
অসমীয়ারা চরমভাবে ক্ষেপে গেছে নতুন এই নাগরিকত্ব আইন নিয়ে যেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
অসমীয়াদের আশঙ্কা – এর ফলে সেখানে লাখ লাখ বাংলাভাষী হিন্দু নাগরিকত্ব তো পাবেই, সেই সাথে নাগরিকত্বের লোভে বাংলাদেশে থেকে নতুন করে হিন্দুরা এসে ঢুকবে।