ভাষা না জানায় মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকের হয়রানি
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই মূহুর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা কম-বেশি ২০ লাখের মতো।
এদের সিংহভাগই অদক্ষ শ্রমিক এবং প্রায়শই তাদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে।
তারা নিজেরাই অনেক সময় বলেন, আরবি ভাষা বুঝতে বা বলতে না পারার কারণে তারা নানা ধরনের বিপদে পড়েন।
ভাষা না বুঝে নির্যাতনের শিকার
সৌদি আরবে গিয়ে চাকরিদাতার ভাষা না বুঝতে পেরে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বাংলাদেশের মাদারীপুর থেকে ২০১৬ সালে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়া রাবেয়া খাতুন। এটি তার ছদ্মনাম।
তিনি বলেছেন, কাজের ধরন এবং ভাষার ওপর তিনদিনের একটি সরকারি প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি সৌদি গিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই ন্যুনতম প্রশিক্ষণে কাজ হয়নি, ভাষা বুঝতে না পারায় গৃহকর্তার নির্যাতনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে।
তিনি বলেন, “এখানে তিনদিনের কোর্স করে গেছি, কিন্তু ওইখানে গিয়া সেগুলার সাথে মিল তেমন পাই নাই। যেমন ধরেন আলুকে কী বলে, টমেটোকে কী বলে, বাথরুমকে কী বলে সেগুলো শিখাইছে। কিন্তু ধরেন কোন কাজ করতে বলল, সেটা তো শিখায় নাই। গিয়া কিছু বুঝতাম না।”
“তো বাড়িওয়ালা ধরে মারত, মার খেয়ে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হইছিল। পরে নিজের টাকা খরচ করে আমি দেশে চলে আসি।”
চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রাবেয়ার মতো মোট ৩৫,০০০ শ্রমিককে দেশে ফেরত এসেছে, যার অর্ধেকেরও বেশি এসেছে সৌদি আরব থেকে।
ভাষা প্রশিক্ষণ
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে কম মজুরিতে কাজ করেন, এবং অনেক সময়ই নির্যাতনের অভিযোগ করেন, তার সবচেয়ে বড় কারণ ভাষা না জানা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে গিয়ে কাজ করার জন্য সরকারি প্রশিক্ষণের বাইরে বেসরকারিভাবেও বিদেশী ভাষা শেখার চাহিদা বেড়েছে।
যদিও বিদেশী ভাষার মধ্যে ইংরেজি, কোরিয়ান, চীনা ও জাপানি ভাষা শেখার দিকেই মানুষের আগ্রহ বেশি।
আরবি ভাষা শেখানোর প্রতিষ্ঠান অ্যারাবিক কোচিং সেন্টারের প্রধান মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণার্থীদের ভাষার ব্যবহারিক দিকে বেশি জোর দেওয়া হয়।
“আমরা চেষ্টা করি তাদের প্র্যাকটিস করার সুযোগ বেশি দিতে। কারণ লেখার সময় যেটা সহজে লেখা যায়, বলতে সেটা কঠিন হতে পারে। তাছাড়া আমাদের ভাষার মতো না আরবি, ওই ভাষায় পুরুষ লিঙ্গ স্ত্রী লিঙ্গ আছে। দরজা, বাটি বা রাস্তারও লিঙ্গ আলাদা, ফলে এটা চর্চ্চা না করলে মনে থাকবে না।”
আরবি ভাষা শেখার জন্য তিনমাসের একটি কোর্সে পাঁচ হাজার টাকা ফি দিতে হয়।
মিঃ রহমান জানিয়েছেন, ঢাকায় এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব বেশি নয়, আর অনেক সময় কোর্স শেষ না করেই বিদেশে পাড়ি জমান অনেক প্রশিক্ষণার্থী।
সরকারের কী ব্যবস্থা?
সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া কর্মীর মধ্যে ৫৭ শতাংশই অদক্ষ ছিলেন।
এ সমস্যার সমাধানে বিদেশে পাঠানোর আগে শ্রমিকদের দুই ধরনের প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থার উপ-পরিচালক ইয়াসমিন চামেলী।
“একেবারে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে যারা যায়, তাদের মূলত দুই রকম প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। একটি তিনদিনের প্রি-ডিপার্চার ট্রেনিং এবং অন্যটি গৃহকর্মীদের জন্য একমাসব্যাপী প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে ভাষা এবং গৃহকর্মে ব্যবহৃত জিনিসপত্র ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।”
এই মূহুর্তে সারাদেশে এমন ৭১টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, যেখান থেকে ২০১৮ সালে প্রায় সাত লাখ মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
এসব প্রশিক্ষণ কি যথেষ্ট?
চাহিদার তুলনায় এ ধরনের প্রশিক্ষণকে খুবই অপ্রতুল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটা প্রতিষ্ঠান, রামরু’র পরিচালক মেরিনা ইয়াসমিন মনে করেন, ভাষা এবং সংস্কৃতি বোঝার জন্য তিনদিনের একটি কোর্স এবং একমাসের একটি কোর্স মোটেও যথেষ্ট নয়।
তিনি বলেন, “তিনদিনের প্রি-ডিপার্চার কোর্সে ওরিয়েন্টেশনটাই কেবল দেয়া যায়, সেখানে ভাষা শেখানো যায় না।”
“আবার দক্ষতা বাড়ানোর যেসব কার্যক্রম আছে সেখানেও বিশেষ কয়েকটি দেশ যেমন সিঙ্গাপুর বা কোরিয়ার জন্য কিছুটা লাভ হয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের জন্য সেটা খুবই অপ্রতুল। এছাড়া আমাদের প্রশিক্ষণগুলো এখনো আন্তর্জাতিক মানের হয়ে ওঠেনি।”
সরকার বলছে, তিনদিনের প্রি-ডিপার্চার কোর্সকে দশদিনের করা হবে। সেই সঙ্গে বাড়ানো হবে অন্যান্য প্রশিক্ষণের মানও।
সেজন্য এখন বিদেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠানো, অভিবাসীদের নিরাপত্তা এবং দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য কমানোর লক্ষ্যে সরকারি নীতিমালা নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে।