ভুট্টো থেকে দিলীপ কুমার- মধুবালার প্রেমে পাগল ছিলেন যত খ্যাতিমান পুরুষ

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ খুব কম লোকই জানেন যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পারিবারিক একটা বিলাসবহুল ‘কোঠি’ বা বাংলো ছিল মুম্বাইয়ের ওরলি সি ফেস এলাকায়।

সেটা ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সালের কথা, মি. ভুট্টো প্রায়ই ওই কোঠিতে থাকতেন। তার পুরো পরিবার অবশ্য আগেই পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল।

সেই সময়ে ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবির শুটিং চলছিল বোম্বে, এখনকার মুম্বাইতে।

বলিউডের প্রখ্যাত সঙ্গীতকার নওশাদ সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, “ওই ছবিতে ‘মোহে পনঘট পে নন্দলাল ছোড় গয়ো রে’ গানটির শুটিং হচ্ছিল। মি. ভুট্টো ওই গানটি এবং মধুবালার প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে তিনি প্রতিদিন এই গানের শুটিং দেখতে আসতেন।“

জুলফিকার আলি ভুট্টো মনের কথা বলেই ফেলেছিলেন মধুবালাকে
জুলফিকার আলি ভুট্টো মনের কথা বলেই ফেলেছিলেন মধুবালাকে

মধুবালাকে বিয়ে প্রস্তাব ভুট্টোর

কবার তো তিনি মধ্যাহ্নভোজের সময়ে মধুবালার সামনে তাঁর মনের কথা প্রকাশ করেই ফেললেন। মধুবালা কথাটাকে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তখন কেউ কল্পনাও করেনি যে একদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন।

‘মুঘল-এ-আজম’-এর নৃত্য পরিচালক লাচ্ছু মহারাজ এমন একজন নৃত্যশিল্পী চাইছিলেন, যিনি মুখের অভিব্যক্তি এবং হাতের ভঙ্গিমা দিয়েই গানের শব্দগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারবেন।

মধুবালা শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী ছিলেন না কিন্তু তিনি এই একটি মাত্র গানের জন্য খুব পরিশ্রম করেছিলেন। লাচ্ছু মহারাজ তাকে কয়েক মাস ধরে কত্থক শিখিয়েছিলেন।

‘মুঘল-এ-আজম’-এর শুটিং দেখতে যে ভবিষ্যতের পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট মি. ভুট্টো একাই আসতেন তা নয়। ওই সিনেমার সেটে এসেছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, সৌদি আরবের শেখ সাউদ, পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, বিখ্যাত ইতালীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা রবার্তো রোসেলিনি এবং ডক্টর জিভাগো আর লরেন্স অফ আরাবিয়ার পরিচালক ডেভিড লিন প্রমুখরাও।

মেরিলিন মনরোর সঙ্গে তুলনা করা হত মধুবালা সৌন্দর্য্যের
মেরিলিন মনরোর সঙ্গে তুলনা করা হত মধুবালা সৌন্দর্য্যের

ভারতের সেরা সুন্দরীদের একজন

অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন মধুবালা। বলা হয় যে তার প্রকাশিত কোনও ছবিই তার সৌন্দর্যের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি।

তাকে প্রায়ই হলিউড অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর সাথে তুলনা করা হত। দুজনের সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা হত সব জায়গাতেই।

দুজনেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান। মেরিলিন মনরো ১৯৬২তে, আর মধুবালা ১৯৬৯ সালে।

মধুবালা কখনই নিজেকে যৌনতার প্রতীক হিসাবে মেলে ধরেন নি। সংবাদমাধ্যম আর সাধারণ মানুষকে তার জীবন থেকে দূরেই রাখতেন তিনি, আর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন মেরিলিন মনরো। তার জীবনের মূল মন্ত্রই ছিল মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে চলা।

আরও একটা বৈপরীত্য ছিল মধুবালা আর মনরোর মধ্যে।

ছবির সেটে সময়মতো আসার অভ্যাস ছিল মধুবালার। অনেক সময় তিনি পরিচালকের আগেও সেটে পৌঁছে যেতেন। অন্যদিকে দেরিতে আসার জন্য কুখ্যাত ছিলেন মেরিলিন মনরো।

মধুবালার দিন শুরু হতো ভোর পাঁচটায়।

নিয়মিত মুম্বাইয়ের কার্টার রোড সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে যেতেন তিনি।

বিখ্যাত অভিনেতা প্রেমনাথ মধুবালাকে তার সকালের এলার্ম ঘড়ি বলে মনে করতেন। প্রতিদিন সকাল ছয়টায় মধুবালার ডাকে উঠে পড়তেন প্রেমনাথ, যাতে তিনি সময়মতো টেনিস খেলতে যেতে পারেন।

‘ফিল্মফেয়ার’ ম্যাগাজিন ১৯৫২ সালে, ভারতের সবচেয়ে সুন্দরী অভিনেত্রী কে তা জানতে একটি সমীক্ষা চালায়। নলিনী জয়বন্ত এই জরিপে প্রথম, নার্গিস ও বীণা রায় যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। মধুবালা চতুর্থ স্থান পেয়েছিলেন।

কিন্তু ১৯৯৩ সালে আরেকটি সমীক্ষা করা হয়, যেখানে প্রথম স্থান পান মধুবালা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিলেন নার্গিস ও মীনা কুমারী।

ভীষণ ফর্সা ছিলেন মধুবালা
ভীষণ ফর্সা ছিলেন মধুবালা

হলিউডে যেতে বাধা বাবার

ধীরে ধীরে পশ্চিমা বিশ্বেও মধুবালার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

বিদেশি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও তার ছবি ছাপা হচ্ছিল। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ফ্রাঙ্ক কাপরা যখন ভারতে আসেন, তিনি বলেছিলেন যে তিনি মধুবালার জন্য হলিউডে কাজ করার পথ খুলে দিতে পারেন।

বিখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক বি কে করঞ্জিয়া তার আত্মজীবনী ‘কাউন্টিং মাই ব্লেসিংস’-এ লিখেছেন, “আমি যখন মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খানের কাছে হলিউডে যাওয়ার কথাটা তুললাম, তিনি মধুবালাকে হলিউডে পাঠাতে মানা করে দিলেন। প্রস্তাব নাকচ করার কারণটা ছিল যে মধুবালা ছুরি-কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে অভ্যস্ত নন।“

মধুবালার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে গিয়ে বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা মেহমুদের বোন ও অভিনেত্রী মীনু মমতাজ একবার বলেছিলেন, “ওর গায়ের রং এত ফর্সা ছিল যে তিনি যদি পান খেতেন, তার লাল রংটা স্পষ্ট দেখা যেত গলা দিয়ে নীচের দিকে নামছে।“

মধুবালা - পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
মধুবালা – পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

দেবিকা রানী নাম রাখেন মধুবালা

মধুবালার জন্ম দিল্লিতে, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৩ সালে। তার ছোটবেলার নাম ছিল মমতাজ জাহান বেগম।

মমতাজ তার ১১ ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন। মাত্র নয় বছর বয়সে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন তিনি। তার প্রথম ছবি ছিল ‘বসন্ত’।

মুম্বাইতে ওই ছবিটি শেষ করার পর তিনি দিল্লিতে ফিরে আসেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই মুম্বাই থেকে অমিয় চক্রবর্তী মধুবালাকে ফোন করে জানান যে তিনি তাকে পরবর্তী ছবি ‘জোয়ার ভাটা’-তে নিতে চান।

মধুবালা মুম্বাই ফিরে যান কিন্তু কোনও এক কারণে তিনি ‘জোয়ার ভাটা’ ছবিতে কাজটা পান নি। সেই সময়েই মধুবালার বাবা মুম্বাইতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

নামকরা অভিনেত্রী দেবিকা রানী মধুবালার কঠোর পরিশ্রম দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

তিনিই তার নতুন নাম দেন মধুবালা।

মধুবালার পরিচিতি শুরু হয় ১৯৪৮ সালে ‘সিঙ্গার’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে, যদিও তার পার্ট ছিল একটা পার্শ্বচরিত্রের। ছবিটির নায়িকা ছিলেন সুরাইয়া।

ধীরে ধীরে মধুবালার খ্যাতি বাড়তে থাকে এবং তিনি নায়িকা হিসেবে অনেক ডাক পেতে থাকেন।

বিখ্যাত পরিচালক কিদার শর্মা তাকে রাজ কাপুরের বিপরীতে ‘নীলকমল’ ছবির জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন।

দিলীপ কুমার ও মধুবালা
দিলীপ কুমার ও মধুবালা

‘মহল’ ছবি থেকেই নাম ছড়ায় মধুবালার

মধুবালাকে যে ছবিটি জাতীয় স্বীকৃতি দেয় তার নাম ‘মহল’। এটি একটি অপূর্ণ প্রেমের গল্প যা এক জন্ম থেকে অন্য জন্ম পর্যন্ত চলতে থাকে।

লতা মঙ্গেশকর তার বেশ কয়েক বছর আগেই প্লেব্যাকের জগতে এসেছেন।

এই ছবিতে তার গাওয়া ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি তাকে প্লেব্যাক জগতের শীর্ষে পৌঁছিয়ে দেয়।

ওই ছবির জন্যই প্রয়োজন ছিল এমন একজন নায়িকা, যিনি অসাধারণ সুন্দরী হবেন।

কামাল আমরোহি এই ছবির জন্য মধুবালাকে বেছে নিয়েছিলেন, যদিও তখনও পর্যন্ত সিনেমার জগতে তার যে খুব নামডাক হয়েছিল, তা নয়।

প্রযোজক সংস্থা ‘বোম্বে টকিজ’ ওই চরিত্রে সুরাইয়াকে নেওয়ার কথা ভেবেছিল, কিন্তু কামাল আমরোহি মধুবালাকে নেওয়ার জন্য অনড় থাকেন।

তখন মধুবালার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। তার বিপরীতে নায়ক অশোক কুমারের বয়স ছিল দ্বিগুণ অর্থাৎ ৩২ বছর।

মধুবালা পুরো ছবিটি প্রায় একাই টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ছবিটি বক্স অফিসের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেয়।

মুঘল-এ-আজমের সেটে বাঁদিক থেকে পৃথ্বীরাজ কাপুর, কে আসিফ, রবার্তো রোসেলিনি, মধুবালা এবং দিলীপ কুমার
মুঘল-এ-আজমের সেটে বাঁদিক থেকে পৃথ্বীরাজ কাপুর, কে আসিফ, রবার্তো রোসেলিনি, মধুবালা এবং দিলীপ কুমার

মধুবালার হৃদপিণ্ডে ছিদ্র ধরা পড়ল

হঠাৎ করেই মধুবালার স্বাস্থ্যের অবনতি শুরু হয় ১৯৫০ সালে।

চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান যে তার হৃদপিণ্ডে একটা ফুটো আছে। তখন ভারতে হার্টের অপারেশনকে কঠিন অপারেশন হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

মধুবালা তার অসুস্থতা সবার থেকে লুকিয়ে রেখে শুটিংয়ের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।

মাদ্রাজ, বর্তমানের চেন্নাইতে ‘বহুত দিন হুয়ে’ ছবির শুটিং করার সময়ে হঠাৎই তার রক্ত বমি হয়। তার অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে নি।

অন্যদিকে ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবির জন্য অভিনেতা অভিনেত্রী বাছাই করছিলেন কে আসিফ। মধুবালার অসুস্থতার খবরে তার মাথায় প্রায় বাজ ভেঙ্গে পড়ার যোগাড় হয়েছিল।

সাংবাদিক রাজ কুমার কেশওয়ানি তার ‘দাস্তান-এ-মুঘল-এ-আজম’ বইতে লিখেছেন, ‘পৃথ্বীরাজ কাপুর তখন একাধিক রোগের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। মধুবালাও হৃদরোগের কারণে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে আটকিয়ে পড়েছিলেন।

চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ দীর্ঘ অংশে, মধুবালাকে ভারী লোহার শিকল পড়তে হয়েছিল।

ছবিটির একটি দৃশ্যে যখন কারাগারের ভেতরে মধুবালার লিপে গাওয়া গান ‘বেকাস পে করম করিয়ে সরকার-এ মদিনা’-র শুটিং হবে, তখন চিকিৎসকদের কঠোর নির্দেশ ছিল যে কোনো অবস্থাতেই ওজন তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

কিন্তু মধুবালা সেই নিষেধ অমান্য করেই শুটিং চালিয়ে যান। মধুবালার শরীর না মানলেও কাজ বন্ধ করেন নি।

মুঘল-এ-আজম ছবির একটি দৃশ্যে মধুবালা
মুঘল-এ-আজম ছবির একটি দৃশ্যে মধুবালা

‘মুঘল-এ-আজম’

‘মুঘল-এ-আজম’-এ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য প্রথমে নার্গিসকে ডাকা হয়েছিল কিন্তু তিনি এই ছবিতে সই করতে অস্বীকার করেন। তখন তিনি রাজ কাপুরের ঘনিষ্ঠ শিবিরে ছিলেন আর দিলীপ কুমারের সঙ্গে তার কথাবার্তা বন্ধ ছিল। তারপরে নূতনকেও ওই ছবির প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনিও ওই ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হননি।

মধুবালা যখন এই ছবির জন্য চুক্তিবদ্ধ হন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর।

ছবিটা শেষ করতে আট বছর লেগেছিল।

‘মুঘল-এ-আজম’ ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবি। হিন্দি, ইংরেজি ও তামিল তিনটি ভাষায় নির্মিত হয়েছিল ছবিটি।

প্রতিটি সংলাপ তিনটি ভাষায় রেকর্ড করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ছবিটির এত নেগেটিভ জমেছিল যে সেগুলো দিয়েই অন্তত তিনটি ছবি তৈরি করা যেতে পারত।

মধুবালা - পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
মধুবালা – পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

দিলীপ কুমার যখন চড় মারেন মধুবালার গালে

‘মুঘল-এ-আজম’-এর সবথেকে জনপ্রিয় দৃশ্য ছিল যখন দিলীপ কুমার একটি পালক দিয়ে মধুবালার ঠোঁট স্পর্শ করেন।

সুভাষ ঘাই বলেছেন, “কে আসিফ খুব সংবেদনশীলভাবে এই দৃশ্যটি শ্যুট করেছিলেন। যে কোনও চুম্বন দৃশ্যের চিত্রায়নের থেকে এই দৃশ্যটা অনেক বেশি কঠিন ছিল।“

মহেশ ভাটের চোখে, “এটি সম্ভবত ভারতীয় সিনেমার সবচেয়ে ইরোটিক দৃশ্য ছিল”।

পরে, কে আসিফের স্ত্রী সিতারা দেবী একটি সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, “মুঘল-এ-আজমের সেটে তখন একটা থমথমে পরিবেশ। দিলীপ কুমার এবং মধুবালা কেউ কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলেন না। হঠাৎই একদিন চাপা অনুভূতিগুলি প্রকাশ্যে এসে যায় যখন একটি দৃশ্যে দিলীপ কুমার মধুবালার গালে এত জোরে চড় মেরেছিলেন যে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল।

“সবাই ভাবতে শুরু করেছে এরপর কী হবে? মধুবালা কি সেট থেকে বেরিয়ে যাবেন? শুটিং কি বাতিল হবে?

মধুবালা কিছু বলার আগেই পরিচালক আসিফ তাকে এক কোণে নিয়ে গিয়ে বলেন, “আমি আজ খুব খুশি কারণ এটা তো স্পষ্ট হল যে সে এখনও তোমাকে ভালোবাসে। এরকমটা শুধুমাত্র একজন প্রেমিকই করতে পারে,“ জানিয়েছিলেন সিতারা দেবী।

‘মুঘল-এ-আজম’-এ এত ভালো অভিনয় সত্ত্বেও মধুবালা সেবছর সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পান নি। ‘ঘুঙ্ঘট’ ছবির জন্য সেবছর সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছিলেন বীণা রায়।

মুঘল-এ-আজম : মূল ছবিটি সাদাকালোয় হলেও পরে রঙ্গীন করা হয়েছে
মুঘল-এ-আজম : মূল ছবিটি সাদাকালোয় হলেও পরে রঙ্গীন করা হয়েছে

মধুবালা ও দিলীপ কুমারের প্রেম

তার আত্মজীবনী ‘দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ্যাডো’-এ দিলীপ কুমার লিখেছেন যে “একজন শিল্পী এবং একজন নারী দুই হিসাবেই আমি মধুবালার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তিনি ভীষণই প্রাণবন্ত নারী ছিলেন। আমার মতো লাজুক ও অন্তর্মুখী লোকের সঙ্গেও আলাপ জমাতে তার কোনো সমস্যা হয়নি।“

কিন্তু মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খানের জন্য ওই প্রেম কাহিনী বেশিদূর এগোতে পারেনি। মি. খানের মতামত ছিল যে দিলীপ কুমার মধুবালার থেকে অনেক বড়। মধুবালার জীবনী ‘আই ওয়ান্ট টু লিভ – দ্য স্টোরি অফ মধুবালা’-তে খাতিজা আকবর লিখেছেন, “নয়া দৌড় ছবির শুটিংয়ের সময় দিলীপ কুমার এবং আতাউল্লাহ খানের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। ওই ছবিতে বি আর চোপড়া প্রথমে মধুবালাকে নায়িকা হিসেবে নেন। মি. চোপড়া যখন ছবির আউটডোর শুটিং করার পরিকল্পনা করছেন, তখন আতাউল্লাহ খান এতে তীব্র আপত্তি জানান।

“বিআর চোপড়া শুধু যে মধুবালার বদলে বৈজয়ন্তীমালাকে নিয়ে নিলেন তা নয়, চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার জন্য মধুবালার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। পরে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয় এবং মামলা তুলে নেওয়া হয়,“ লিখেছেন খাতিজা আকবর।

মধুবালার ছোট বোন মধুর ভূষণের কথায়, “দিলীপ কুমার সাহেব একবার দিদিকে বলেন, চলো আমরা বিয়ে করে নিই। জবাবে মধুবালা বলেন, আমি অবশ্যই বিয়ে করব, তবে আগে তুমি আমার বাবাকে সরি বলো। কিন্তু দিলীপ কুমার তাতে রাজি হননি। আমার বোন এমনকি এটাও বলেছিল তাকে যে অন্তত বাড়ির ভেতরেই বাবাকে আলিঙ্গন করে বিষয়টা মিটিয়ে নিতে, সেটাও করতে রাজি হন নি দিলীপ কুমার। সেই থেকেই দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।“

মধুবালা ও কিশোর কুমার
মধুবালা ও কিশোর কুমার

কিশোর কুমারকে বিয়ে করলেন মধুবালা

মধুবালা যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে দিলীপ কুমার তাকে বিয়ে করবেন না, তখন তিনি কিশোর কুমারকে বিয়ে করেছিলেন। তার এটা প্রমাণ করার ছিল যে তিনি যে কোনও পুরুষকে বিয়ে করতে পারেন।

যদিও সেই সময়ে দুজনে একে অপরকে বিশেষ চিনতেন না। বিয়ের আগেই মধুবালার অসুস্থতার কথা জানতেন কিশোর কুমার।

কিশোর কুমারের জীবনী ‘কিশোর কুমার দ্য আল্টিমেট বায়োগ্রাফি’-তে অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য এবং পার্থিব ধর মধুবালার ছোট বোন মধুরকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, “ডাক্তার যখন কিশোরকে বললেন যে মধুবালার হাতে খুব বেশি দিন আর নেই, তখন তিনি তাকে কার্টার রোডের ফ্ল্যাটে সরিয়ে দেন, সঙ্গে একটি চালক সহ গাড়িও দিয়ে দেন তিনি। চার মাসে একবার মধুবালার সঙ্গে দেখা করতেন কিশোর কুমার। এমনকি মধুবালার ফোনও রিসিভ করতেন না গায়ক।“

তবে কিশোর কুমারের ছেলে অমিত কুমার এর ঠিক বিপরীত বয়ান দিয়েছেন মধুবালা আর তার বাবার সম্পর্ক নিয়ে।

এক সাক্ষাৎকারে অমিত কুমার বলেন, “আমি দশ বছর বয়সে প্রথমবার মধুবালাকে দেখেছিলাম। আমার বাবা ব্রান্দ্রায় ফ্ল্যাট নিয়ে তার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। ছুটির দিনে আমিও সেখানে থাকতাম। ‘ঝুমরু’-র সেটে যখন ওকে দেখতাম তখন ওকে দেখতে খুব সুন্দর লাগতো কিন্তু পরের দিকে তার শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছিল।

“একটা সময়ে বান্দ্রায় একা থাকতে শুরু করেন মধুবালা। আমার বাবা প্রতিদিন তাকে দেখতে যেতেন। বাবাকে খেয়ে যাওয়ার জন্য জোর করতেন তিনি। এর ফলে আমার বাবাকে দুবার ডিনার করতে হত, একবার মধুবালার সঙ্গে আর একবার আমার মায়ের সঙ্গে,” জানিয়েছিলেন অমিত কুমার।

মুঘল-এ-আজম ছবির একটি দৃশ্যে মধুবালা
মুঘল-এ-আজম ছবির একটি দৃশ্যে মধুবালা

‘আমার রাজকুমার তার রাজকন্যা খুঁজে পেয়েছে’

সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস মনে করতেন যে মধুবালার থেকে মৃদুভাষী এবং মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আর কোনও নারীকে তিনি দেখেন নি।

বিখ্যাত সাংবাদিক বি কে করঞ্জিয়ার লেখায়, “আমার এখনও মনে আছে মধুবালা কীভাবে আমার মেয়ে রতনের সঙ্গে কোয়েটা টেরেসে আমাদের ফ্ল্যাটে লুকোচুরি খেলতেন। একবার আমার মেয়ে মেডো স্ট্রিটের ক্রিম বান খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। পরের দিন, মধুবালার ড্রাইভার আমাদের বাড়িতে ক্রিম বানের একটি বিশাল বাক্স উপহার হিসাবে পৌঁছিয়ে দিয়ে যায়।“

দিলীপ কুমার যখন সায়রা বানুকে বিয়ে করতে চলেছেন, তখন মধুবালা দিলীপ কুমারকে একটি বার্তা পাঠান যে তিনি একবার দেখা করতে চান।

মধুবালার শরীর তখন খুবই দুর্বল।

খুব নিচু স্বরে তিনি দিলীপ কুমারকে বললেন, “আমার রাজকুমার তার রাজকন্যা খুঁজে পেয়েছে। আমি খুব খুশি।“

মুঘল-এ-আজম: দিলীপ কুমার ও মধুবালা
মুঘল-এ-আজম: দিলীপ কুমার ও মধুবালা

কবরে একটা ফুল রাখলেন দিলীপ কুমার

মধুবালা তখন ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে মৃত্যুর দিন গুনছেন। বি কে করঞ্জিয়াই সম্ভবত শেষ ব্যক্তি, যার সঙ্গে মধুবালার দেখা হয়েছিল।

মি. করঞ্জিয়া লিখেছেন, “মধুবালাকে তখনও সুন্দর লাগছিল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল এবং তার নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো ছিল। আমাকে দেখে তিনি হাসলেন। আমার হাতটা ধরলেন তিনি। আমরা চুপচাপ একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

“নার্স আমাকে মাত্র পাঁচ মিনিট তার কাছে বসার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু মধুবালা আমার হাত ছাড়তেই চাইছেন না। তার চোখ জলে ভরে উঠেছিল। আমি ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম আর দুহাতে ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরলাম। তারপর আমি নীচু হয়ে ওর ঠান্ডা কপালে একটা চুমু দিলাম। আমার চোখে জল এসে যাচ্ছিল, তাই এক ঝটকায় হাতটা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। নার্স ধীরে ধীরে মধুবালার ঘরের দরজা বন্ধ করে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। ফিসফিস করে বললেন, প্রার্থনা করো।“

পরের দিন, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯, তার ৩৬ তম জন্মদিনের ঠিক নয়দিন পরে মধুবালা এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

সেদিন মাদ্রাজে শুটিং করছিলেন দিলীপ কুমার।

তিনি বোম্বে পৌঁছানোর আগেই মধুবালাকে সমাহিত করা হয়েছিল। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কবরস্থানে গিয়েছিলেন দিলীপ কুমার।

মধুবালার কবরে একটা ফুল রেখে গিয়েছিলেন দিলীপ কুমার।


Spread the love

Leave a Reply