মিয়ানমারে ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ এর উত্থান এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য উগ্র রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপই দায়ী!

Spread the love

মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুল কারন হিসেবে ধরে নেয়া যায়  সেখানকার উদ্ভট এবং ন্যক্কারজনক নাগরিকত্ব আইন। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের যে কায়দায় হত্যা এবং উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাকে বিশ্বের অন্যতম বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং গনহত্যা    হিসেবেও গন্য করা যায়।  মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করার পর থেকে তাদের উচ্ছেদপ্রক্রিয়া শুরু হয়। পরিকল্পিত এই আইন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে তাদেরই গণ্য করা হবে, যারা বা যাদের পূর্বপুরুষেরা ১৮২৩ সালের আগে মিয়ানমার তথা বার্মার বাসিন্দা ছিল বলে প্রমাণিত হবে। এর কারণ হিসেবে ১৮২৪ সালে অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যায়। ওই যুদ্ধে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈনিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। তারা তৎকালীন বার্মা শাসকদের কাছ থেকে আসাম, মণিপুর, কাছার, জয়ন্তিয়া এবং তৎকালীন আরাকান প্রদেশ দখল করেছিল। পরে আরও দুটি যুদ্ধের মাধ্যমে পুরো বার্মা দখল করে ১৮৮৭ সালের মধ্যে বার্মাকে ব্রিটিশ ভারতের শাসনাধীনে আনা হয়। যেহেতু এই নাগরিকত্ব আইনে ১৮২৪ সালের পূর্ব থেকে যারা বা যাদের পূর্ব পুরুষেরা বার্মার বাসিন্দা ছিল শুধু তাঁদেরকেই নাগরিকত্ব দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে আর সেই সুত্রের নীল নকশা অনুযায়ীই মুলত আরাকানে ‘ইথনিক ক্লিঞ্জিং’ চালানো হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।

রাখাইন তথা আরাকানের অন্যতম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ইতিহাস হাজার বছরের হলেও বার্মার শাসকদের প্ররোচনায় সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদেরকে তাদের  মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে বছরের পর বছর। সামরিক বাহিনীর সরাসরি মদদে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তাঁদেরকে  জোরপূর্বক দেশ থেকে বিতাড়িত করতে বাধ্য করেছে। শত  শত ঘরবাড়ী জালিয়ে দেয়া হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে এবং নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে শত শত নিরীহ মানুষকে।

২০১৭ সালের অগাস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল। আর ২০২২ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩।  এর আগে ২০১৬ সালে অক্টোবরে রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। এরও আগে থেকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত–অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ  রোহিঙ্গার উপস্থিতি ছিল। ২০১৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন তথ্যসুত্রে বাংলাদেশ মোট ১১ লাখ  রোহিঙ্গা শরণার্থী ছিল বলে জানা যায়। এছাড়া প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু  জন্মগ্রহণ করছে। এই হিসাবে বিগত ৬ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১.২ মিলিয়ন বা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

আমি এই কলামটি লিখার সময় পর্যন্ত সারাদিনে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আরও  দেড়শতাধিক সদস্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। ১১ মার্চ সোমবার সকালে ২৯ জন আসার পরে বিকাল পর্যন্ত বাকিরা এদেশে প্রবেশ করেছেন। এ নিয়ে মঙ্গলবার (১১ মার্চ) ১৭৯ জন জান্তা সেনা প্রবেশের ঘটনা ঘটলো।  

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যেকার তুমব্রু ঘুমধুম সীমান্তের তিনটি স্থান দিয়ে গত ফেব্রুয়ারী   মাসের শুরুর দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি-র সদস্যরা। এখন পর্যন্ত ৩৩০ জন প্রবেশের তথ্য দিয়েছে বিজিবি সদর দপ্তর। তাদের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিপি), সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন সদস্য, পুলিশসহ তাদের পরিবারের সদস্যও রয়েছেন বলে বিবিসি বাংলা সুত্রে জানা যায়। তাদের মধ্যে অন্তত দুই জন নারী ও ৩ জন শিশুও রয়েছে।

ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়ানের সদস্যরা, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের প্রথমেই কর্ডন ও অস্ত্র আলাদা করনসহ তাদেরকে নিরাপদ স্থানে রেখেছেন। মিয়ানমারে বাংলাদেশ সীমান্ত-ঘেঁষা এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সে দেশটির সেনাবাহিনীর যুদ্ধ এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে মিয়ানমারের বাহিনী। এতদিন এই যুদ্ধকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা হলেও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সে দেশের একের পর এক সীমান্তরক্ষী বা সেনা সদস্যর অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এ ব্যাপারে প্রতিনিয়ত সজাগ দৃষ্টি রাখছে।

স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলমান থাকলেও, এবারের সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা।

বিশেষ করে অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করা শান রাজ্যের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একজোট হয়ে চালানো একের পর এক হামলা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ক্ষমতায় থাকা দেশটির সামরিক বাহিনী।

বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ হারানো ও প্রতিবেশী দেশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে আশ্রয় নেবার খবর প্রতিদিনই উঠে আসছে গণমাধ্যমে।

১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হবার পর থেকেই সে দেশে সংঘাত চলছে। ১৯৬২ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।

এরপর দীর্ঘ সময় ধরে জান্তা বাহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকলেও ২০১৫ সালের এক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি), যার নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি।

তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা সামরিক শাসকদের কাছে হুমকি মনে হওয়ায় ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয় সামরিক বাহিনী।

তবে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি দেশটির সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে কঠোর হাতে তাদের দমন শুরু করে সামরিক বাহিনী।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সারা দেশে ক্র্যাকডাউন চালায়।

এতে ১৬ হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে নির্বিচারে গ্রেফতার এবং পুলিশ হেফাজতে ২৭৩ জনের মৃত্যুর তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়াও গণহত্যা, গ্রেফতার, অত্যাচার, যৌন সহিংসতাসহ অন্যান্য নিপীড়নের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সামরিক জান্তার নতুন করে ক্ষমতা দখলের প্রথম আড়াই বছর সামরিক বাহিনী দমন-পীড়নের মাধ্যমে যতটা সহজে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে, পরে সে দৃশ্য অনেকটাই বদলে গেছে।

২০২১ সালের এপ্রিলেই ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা  এনইউজি নামে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে যোগ দেয়।  সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে এবং সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করে ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’। সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সক্রিয় থাকলেও এটি নতুন মাত্রা পায় উত্তরাঞ্চলের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনীর এককাট্টা হয়ে আক্রমণ শুরুর পর।

২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে হামলা চালায় দেশটির উত্তরের জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনীর নেতৃত্বাধীন  ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’।  ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ে এই জোট গঠন করা হয়। তারা একে নাম দেয় ‘অপারেশন ১০২৭’। সামরিক বাহিনীকে এই মুহূর্তে নানা ধরনের হামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর তা কেবল একটি জায়গাতেই না, বরং সারা দেশব্যাপী।

বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার মুখে চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর  পশ্চাদপসরণ অব্যাহত রয়েছে। দেশটির থিংক ট্যাংক ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি এন্ড পলিসি (আইএসপি) মিয়ানমারের তথ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ৪৩ শতাংশেরও বেশি জায়গা হারিয়েছে।

থাইল্যান্ড ভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম ইরাবতীতে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারিতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী এর মধ্যে সারা দেশে ৩৩টি শহরের দখল হারিয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে চিন, সাকাই, কিয়াং প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের শান এবং শিন রাজ্য উল্লেখযোগ্য।

গত অক্টোবরে হামলা শুরু হবার পর থেকে হাজার হাজার সৈন্য তাদের সরঞ্জাম নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সারা দেশে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে সেনাবাহিনী ৪০০রও বেশি সীমান্ত চৌকি হারিয়েছে।  রাস্তায় অতর্কিত হামলা থামাতে ব্যর্থ সামরিক বাহিনী তাদের সীমিত সংখ্যক হেলিকপ্টারের উপর নির্ভর করে ঘাঁটিগুলোতে রসদ পাঠাচ্ছে।  এ পর্যন্ত সামরিক  বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার এবং একটি যুদ্ধ বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কাচিন রাজ্যের বিদ্রোহীরা। এর আগেও দেশটির অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে গৃহযুদ্ধ চলমান থাকলেও এবারের সংকট নজিরবিহীন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে মিয়ানমারের সংকট গভীর হবার প্রধান কারণ হচ্ছে অভ্যুত্থানের  বিরুদ্ধে জনসাধারণের সক্রিয় প্রতিবাদ।

২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক উপায়ে এনএলডি ক্ষমতায় এলেও দেশের ওপর সার্বিক ক্ষমতা ছিল না দলটির। আর তার কারণ ২০০৮ সালের সংবিধান। এই সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির সংসদের অন্তত ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকবে।

সংসদে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্মতি ছাড়া সংবিধানের অন্যান্য ধারা ও আইন পরিবর্তন করা গেলেও ২০০৮ সালের সংশোধনীসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা পরিবর্তন করতে হলে অন্তত একজন সামরিক বাহিনীর সদস্যের সম্মতি থাকতে হবে।

তবে ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’ তৈরি হবার ফলে সামরিক বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ অনেকখানি বেড়ে যায়। সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করা ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্সে’ অংশ নেয় জনসাধারণ। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে।

সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক সংগঠিত হামলায় দেশটির অভ্যন্তরে উত্তেজনা বেড়েছে।  সামরিক শাসক মিন অং হ্লাইং এর, ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’গুলোর সঙ্গে কোনও ধরনের  আলোচনা নয়’ এমন উক্তি সংকট আরও গুরুতর করে দিচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।

অন্যদিকে সামরিক জান্তা-বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীও সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে কোনোভাবেই তারা সামরিক শাসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি না।

ফলে সামরিক শাসকের ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া ছাড়া এই সংকট নিরসনের কোনও সুযোগ আপাতত দেখা যাচ্ছেনা বলে অনেকে মনে করেন।

থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বিদ্রোহীদের উত্তর শান রাজ্যের বিশাল এলাকাসহ অন্যান্য অঞ্চল   দখল সামরিক জান্তাকে একটি শক্ত ম্যাসেজ দিয়েছে যে তারা দ্রুতগতিতে রাজধানীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। জোটের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী এখন চীনের সাথে সীমান্তের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সম্প্রতি মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতোয়া অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছে।

বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটারের মতো দূরত্বে এই এলাকাটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সীমান্তের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে শত শত সৈন্য সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছে। যুদ্ধ না করেই হাজার হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে নতুন করে ২৭৮ জন মিয়ানমারের সেনা ভারতের মিজোরামে পালিয়ে গেছে।

গত নভেম্বর থেকে দফায় দফায় প্রায় ৬০০ জন সেনা সদস্য এভাবেই মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে। অনেককে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার পরে তাদের মধ্যে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের ৭৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন।

নিজভূমি থেকে উৎখাত হয়ে মিয়ানমার তথা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আগমন দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং স্থানীয়দের নিপীড়নের কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সীমান্তসংলগ্ন রাজ্য আরাকান (পরিবর্তিত নাম রাখাইন) থেকে বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়। পরিবর্তিতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। দেড় বছরের মাথায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।  এরপরও বিভিন্ন সময়ে সামরিক জান্তার নিপীড়নের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তবে ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর আবার নিপীড়ন শুরু হয়। ওই সময় প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা ভিটামাটি ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছিল। দুই বছর চেষ্টার পর একটি অংশকে ফেরত পাঠানো হয়।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় আকারের আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালে। কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকার আশ্রয়শিবিরগুলোয় তারা এখনো অবস্থান করছে। সেই ঘটনার পর সাত বছর কেটে গেছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন ১২ থেকে ১৪ লাখ বলে অনুমান করা হয়। কারণ, সাত বছরে রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। কুতুপালং বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীশিবির বলে চিহ্নিত।

১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারির পর প্রথম রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতির বিষয়টি অস্বীকার করা হয়, তবে ভোটাধিকার সরকারিভাবে কেড়ে নেওয়া হয়নি। কিন্তু ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হওয়ার পর তারা সে সুযোগও হারিয়েছে।

মিয়ানমার তথা রাখাইনের সর্বশেষ জনগণনার মধ্যেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রাখা হয়নি। কাজেই রাখাইনে কত রোহিঙ্গা রয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। শেষ গণনা বিবেচনায় নিয়ে অনুমান করা যায় যে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আবাস রাখাইন রাজ্যে। এই জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ বসবাস করে বাংলাদেশসংলগ্ন কালাদান নদীর উত্তরে, উত্তর রাখাইনে।

অনুমানের ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে উত্তর ও দক্ষিণ রাখাইন মিলে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ক্যাম্পে ভিটামাটিহারা প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় শরণার্থী হিসেবে রয়েছে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা। যার মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রায় দেড় লাখ এবং ভারতে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রেও বেশ কিছু রোহিঙ্গা রয়েছে। এককথায় জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গারা শুধু রাষ্ট্রহীনই নয়, তাদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হওয়ার পথে।  রোহিঙ্গারা প্রথম ব্যাপক নিপীড়নের মুখে পড়ে যখন ১৯৪২ সালে সাময়িকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরাকান জাপানিদের দখলে চলে যায়। ওই সময়ে রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ বাহিনীর ‘ভি’ ফোর্সের প্রধান শক্তি ছিল। ওই সময়ই রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ বাহিনীর চর হিসেবে জাপানিদের সহযোগী স্থানীয় আরাকানি বৌদ্ধদের রোষানলে পড়ে। দাঙ্গার ঘটনায় রোহিঙ্গারা গণহত্যা ও ধর্ষণের শিকার এবং ব্যাপকভাবে বাস্তুচ্যুত হয়। অধিকাংশই দক্ষিণ আরাকান থেকে উত্তরে, বর্তমান বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়।

বর্তমানে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) ভবিষ্যৎ সরকার এবং সংবিধানে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এনইউজি সরকার নেতৃত্বে এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) জান্তাবিরোধী অন্য জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারে বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের বৃহত্তর অংশ এখন জান্তাবিরোধীদের দখলে। এনইউজি ভবিষ্যতে মিয়ানমারকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র করার পক্ষে এবং সেখানে জান্তাবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দিতে আগ্রহী।

এমন একটি বাস্তবতায় রাখাইনে যুদ্ধরত আরাকান আর্মির আক্রমণে জান্তা বাহিনী দুর্বল ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আইন করেছে। এর বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। হাজার হাজার তরুণ দেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। সামরিক বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীগুলো থেকেও পক্ষত্যাগের ঘটনা বাড়ছে।

রাখাইনের আরাকান আর্মির অবস্থান জোরদার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার অস্থায়ী বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রোহিঙ্গা যুবকদের নাগরিকত্বের প্রলোভন দেখিয়ে ও জোর করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের স্থানীয় আরাকান আর্মির সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে। বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের আইন রোহিঙ্গাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, আইন অনুযায়ী তারা নাগরিকই নয়। আর নাগরিকত্ব দিতে হলে শুধু আইনই নয়, সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে।

বর্তমানে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের অতর্কিত হামলায় কোনঠাঁসা অবস্থায় আছে আর এ থেকে উত্তরনের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার অনীহা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের  জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক খবর অনুযায়ী রাখাইনে কোণঠাসা জান্তা বাহিনী রাখাইন রাজ্যের চিয়াক তালোন অঞ্চলের একটি অভ্যন্তরীণ রোহিঙ্গা অন্তরীণ ক্যাম্পে থাকা প্রায় ১৫০ জন যুবককে ধরে নিয়ে গেছে। দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যা জান্তা সরকারের আরেকটি নীলনকশার বহিঃপ্রকাশ বলে অনেকে মনে করছেন।

রোহিঙ্গাদের এ যুদ্ধে যোগ দিতে প্ররোচনার আসল উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) বিরুদ্ধে দাঁড় করানো। লক্ষণীয় যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেওয়ার রাজনৈতিক ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছে আরাকান আর্মি। রাখাইন অঞ্চলের বেশ কিছু রোহিঙ্গা আরাকান আর্মি, বিশেষ করে ইউএলএর সঙ্গে কাজ করছে বলে জানা যায়। রোহিঙ্গারা যদি জান্তা বাহিনীর এই প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়, তা হবে আত্মঘাতী।

জান্তা সরকারের বিদায়ের পর আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের শাসনের চরিত্র বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যদি তারা ক্ষমতা দখল করতে পারে এবং নাগরিকত্ব আইন যদি সংশোধন করা হয় তাহলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘এথনিক ক্লিঞ্জিং’ এর অংশ হিসেবে চলমান রোহিঙ্গানিধন এবং নির্যাতন বন্ধ হবে বলে আশা রাখা যায়।

মিয়ানমারের দীর্ঘদিন ধরে চলমান সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বার্থপর মনোভাব, সমন্বয়হীনতা, উদ্ভট রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা, সামরিক বাহিনীর একঘুয়েমী, ক্ষমতার প্রতি সামরিক নেতৃত্বের লোভলালসা ও অযোচিত হস্তক্ষেপ এবং সর্বোপরি সেদেশের উগ্র রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপই দায়ী। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সহনশীল রাজনৈতিক মনোভাব, জনস্বার্থে উগ্র মনোভাবাপন্ন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার সহ পারস্পরিক  আলোচনার বিকল্প নেই।

ডক্টর আনিছুর রহমান আনিছ

সাংবাদিক, আইন গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী

Email: anisphd@yahoo.com

 


Spread the love

Leave a Reply