শ্রেষ্ঠ জালিয়াত রাগীব আলী: যে কোন সময় সপরিবারে গ্রেপ্তার
বাংলা সংলাপ ডেস্ক:রাগীব আলী । সিলেটের দানব খ্যাত এই রাগব বোয়ালের জালিয়াতির শেষ নেই । তার অর্জিত প্রায়ই সম্পদও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জন করা । কোনটা জাল দলিল বানিয়ে আবার কোনটা নিরীহ গরিব লোকদের কাছ থেকে জোর পূর্বক দখল করে অর্জন করা ।এতো দিন রাগীব আলীর এই দানবীত্বের কোন প্রতিবাদ কেউ করতে পারেনি ভয়ে । কারন তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা দিয়ে যে কারোর বিরুদ্ধে দু কলম লিখে দিতে পারেন ।
সিলেট বিভাগ জুড়ে নানা কারণে আলোচিত সমালোচিত একটি নাম রাগীব আলী। নিজ অনুসারী আর সুবিধাভোগীরা তার নামের পূর্বে সর্বদা দানবীর বিশেষণটি জুড়ে দেন। তার প্রয়াত স্ত্রীর নামের আগে যুক্ত হয় মহিয়সী নারী। সিলেট বিভাগে এই দম্পতির নাম যুক্ত সাইনবোর্ড একেবারেই সহজলভ্য। এমনকি প্রতিষ্ঠান আর রাস্তার নামকরণেও তুষ্ট না থেকে শতবর্ষের প্রাচীন একটি গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ‘রাগীবনগর’ করে ফেলেছেন তার অনুসারীরা। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আন্দোলনও হয়েছে। রাগীব আলীকে নিয়ে যত কবিতা প্রবন্ধ লেখা হয়েছে তা কোন কোন জাতির মহানায়কদের জন্যও ঈর্ষনীয়। এসবের জন্য নাকি তার কিছু ‘গৃহপালিত’ লেখক বুদ্ধিজীবিও রয়েছেন।
সিলেটে জালিয়াতির মাধ্যমে দেবোত্তর সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত তারাপুর চা-বাগান দখল করে হাজার কোটি টাকার ভূমি আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগের দুটি মামলায় রাগীব আলী ( সিলেটের দানব) , তাঁর ছেলেমেয়েসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
বুধবার দুপুরে সিলেট মহানগর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ওই মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দাখিল করা অভিযোগপত্র উপস্থাপন করা হলে শুনানি শেষে বিচারক মো. সাইফুজ্জামান হিরো সব আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আদালত ২৩ আগস্ট এ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখ ধার্য করেছেন বলে জানিয়েছেন মহানগর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) মাহফুজুর রহমান।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামিরা হলেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির মামলার আসামি রাগীব আলী (৭৫) এবং তাঁর একমাত্র ছেলে আবদুল হাই (৪৫), প্রতারণার মামলায় ওই দুজন ও রাগীব আলীর মেয়ের জামাই আবদুল কাদির (৫৫), মেয়ে রুজিনা কাদির (৪৮), রাগীবের আত্মীয় মৌলভীবাজারের রাজনগরের বাসিন্দা দেওয়ান মোস্তাক মজিদ (৫৫) এবং তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত পংকজ কুমার গুপ্ত। গত ১০ জুলাই পিবিআইয়ের দাখিল করা অভিযোগপত্রে তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
অভিযোগপত্রে রাগীবের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ২০০৬ সালের ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করায় তাঁকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছিল। অভিযোগপত্র গ্রহণকালে আদালত ওই সুপারিশ মঞ্জুর করেন।
আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ২৫ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তদন্তে তারাপুর চা-বাগানের জায়গায় বিধিবহির্ভূতভাবে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে সংসদীয় উপকমিটি চা-বাগানে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। উপকমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সিলেট সদর ভূমি কমিশনার এস এম আবদুল কাদের বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা করেন। মামলায় রাগীব আলীসহ আসামিরা হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এ মামলা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিত করা হয়। পরে পুলিশ তদন্ত করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল।
গত ১৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা-বাগান পুনরুদ্ধারের রায় দেন। এতে ওই দুটি মামলা সক্রিয় করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক সাইফুজ্জামান হিরো মামলা দুটির তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে তিন দফা সময় বাড়ানোর পর সর্বশেষ পর্যায়ে আদালত পিবিআইকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এর এক মাস আগেই গত ১০ জুলাই দুটি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই।
সিলেট নগরের পাঠানটুলার উপকণ্ঠে ৪২২ দশমিক ৯৬ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা তারাপুর বাগানটি দেবোত্তর সম্পত্তি। ১৯৯০ সালে ভুয়া সেবায়েত সাজিয়ে বাগানটির দখল নেন রাগীব আলী। গত ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায় বাস্তবায়ন করতে উচ্চ আদালত থেকে সিলেটের জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়ায় গত ১৫ মে চা-বাগানের বিভিন্ন স্থাপনা বাদে ৩২৩ একর ভূমি সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন। রায়ের পরবর্তী নির্দেশনা বাস্তবায়নে সিলেটের জেলা প্রশাসন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতালসহ সব অবৈধ স্থাপনা ১৩ আগস্টের মধ্যে সরাতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি এলাকাবাসীর: তারাপুর চা-বাগান দখলের পর প্লট তৈরি করে অবৈধভাবে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা ও কেনাবেচার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর জন্য রাগীব আলীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়ার দাবিতে সভা করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। মঙ্গলবার রাতে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত তারাপুর মৌজার বাসিন্দাদের উদ্যোগে আয়োজিত সভায় এ দাবির পাশাপাশি রাগীব আলীর বিচারেরও দাবি করা হয়।
এদিকে কথিত ‘দানবীর’ সিলেটের শিল্পপতি রাগীব আলীর জালিয়াতির জাল রাজধানীতেও বিস্তৃত থাকার খবর মিলেছে।
এবার তার বিরুদ্ধে জাল দলিল দিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা গুলশানের ২২ কাঠা জমি ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ভুয়া দলিলের মাধ্যমে মূল্যবান ২২ কাঠা ২ ছটাক জমি বিক্রি করে দেওয়া। এই সম্পত্তি কিনেছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বেসরকারি ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। অথচ জমিটি অগ্রণী ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেওয়া।
গুলশানের ৩৬ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর বাড়ির ওই জমির মূল মালিক এ আর এ জুট ট্রেডিং করপোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানটির নেওয়া ঋণের বিপরীতেই অগ্রণী ব্যাংকের কাছে জমিটি বন্ধক রয়েছে। আর এ অবস্থাতেই জাল দলিল দিয়ে ওই সম্পত্তি বেচাকেনা করেছেন প্রভাবশালী ওই দুই ব্যবসায়ী। অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক, সুপ্রিম কোর্ট এবং অগ্রণী ব্যাংক থেকে পাওয়া বিভিন্ন চিঠি ও স্মারকলিপি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে এই জমি এখন অগ্রণী ব্যাংক এখন নজরুল ইসলাম মজুমদারকে জমি পাইয়ে দিতে নানা ধরনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশও চাইছে গুলশানের এই দামি সম্পত্তি নজরুল ইসলাম মজুমদারেরই হোক। যদিও সর্বোচ্চ আদালত থেকে বলা হয়েছে জমির দলিলটাই জাল। দলিল জাল করার কাজটি করেছেন ‘সেই’ রাগীব আলী।
২০০৪ সালে ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় গুলশানের জমিটি বিক্রির জন্য রাগীব আলীর সঙ্গে চুক্তি করে এ আর এ জুট ট্রেডিং। কিন্তু বন্ধক রাখা জমি বিকিকিনিতে আপত্তি জানিয়ে অগ্রণী ব্যাংক তখন রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই মামলায় শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টেও হেরে যান রাগীব আলী, ফলে বাতিল হয়ে যায় জমির দলিল। ওই জমিকে রাগীব আলী নিজের সম্পত্তি দেখিয়ে নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে তা বিক্রি করে দেন।
এ বিষয়ে জমির ক্রেতা নজরুল ইসলাম মজুমদারের দাবি, রাগীব আলীর কাছ থেকে তিনি জমি কিনেছি ৭০ কোটি টাকায়। এই জমি নিয়ে যে ব্যাংকের সঙ্গে মামলা আছে তা জমির বিক্রেতা রাগীব আলী গোপন রাখে।
গুলশানের এ জমির মালিকানা নিয়ে ২০০৪ সাল থেকেই রাগীব আলীর বিরুদ্ধে অগ্রণী ব্যাংকের করা মামলা চলমান আছে। মামলা চলাকালে জমি কেনাবেচা কীভাবে করা হলো এর কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রাগীব আলীর সম্পত্তি দখল করা নতুন কোনো ঘটনা নয়। সুপ্রিম কোর্টের অন্য এক রায়েও তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ একটি বেঞ্চ গত ১৯ জানুয়ারি এক রায়ে বলেছেন, নিজের নামে চা-বাগানের সম্পত্তি ইজারা দেখাতে রাগীব আলী ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শাহ ইমদাদুল হকের স্বাক্ষর জাল করে প্রায় এক যুগ সিলেটের তারাপুর চা-বাগান (দেবোত্তর সম্পত্তি) দখলে রাখেন। চা বাগান এলাকায় তিনি রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ৩৩৭টি প্লট তৈরি করে জমি বিক্রি করেন। সম্প্রতি উচ্চ অাদালতে নির্দেশে তারাপুর থেকে রাগীব আলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।
রাগীব আলীর কাছে তার নামে কিছু স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে গেলে পয়সার জন্য আর চিন্তা করতে হয় না প্রস্তাবকারীকে। তা স্কুল কলেজ মাদ্রাসা রাস্তা- যাই হোক। এর উল্টোটাও শোনা যায়Ñ যে কোন জায়গায় অনুদান করার পূর্বে তাতে নিজের কিংবা নিজ দম্পতির নাম সংযুক্তির নিশ্চয়তাটুকু আদায় করে নিতেন তিনি। রাগীব আলীকে সম্বর্ধনা প্রদান করলে অর্থযোগের নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখা দেয় উদ্যোক্তাদের। তো এই ‘দানবীর’ আর শিল্পপতি রাগীব আলীর অর্থের উৎস নিয়ে সব সময়ই একটা জল্পনা কল্পনা ছিলো সিলেট তথা দেশ জুড়ে। সিলেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার সম্পত্তির স্তুপ নিয়েও রয়েছে নানা বির্তক।
একাধিক তদন্তে প্রমানিতও হয়েছে তা। বিশেষত দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান নিয়ে জালিয়াতির ঘটনায় তিনি এখন ফেঁসে যাচ্ছেন। রহস্যজনক কারনে সবসময়ই রাগীব আলী থেকে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওয়ান ইলেভেনের সময় রাগীব আলী পালিয়ে যান লন্ডনে।
গত ১৯ জানুয়ারি সুপ্রীম কোর্টের আপিল ডিভিসনের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, রাগীব আলী ও তার পুত্র আব্দুল হাই বহুল আলোচিত তারাপুর চা বাগানের কেউ নন। জাল জালিয়াতির মাধ্যমে তারাপুর চা বাগান তারা অবৈধ দখলে রেখেছেন। তাছাড়া রাগীব আলী বা তার পুত্র দেবোত্তর এই সম্পদের মালিক অথবা উত্তরাধীকারী হতে পারেন না। কারন হিন্দু ধর্মের সেবায়েত কখনো অন্য ধর্মাবলম্বী হওয়ার বিধান নেই। দীর্ঘ ৯৯ বছরের লিজের কথা বলে বাগানটি অবৈধ দখলে নিয়ে চা রফতানির মাধ্যমে আয়কৃত টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা বৈধ সেবায়েতের ব্যাংক একাউন্টে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রীম কোর্টে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।
রায় অনুযায়ী রাগীব আলী ও তার পুত্র আব্দুল হাইয়ের অবৈধ দখলে থাকা তারাপুর চা বাগান থেকে তাদের মালিকানাধীন রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ সকল স্থাপনা অপসরাণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেই লক্ষ্যে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সুবিধাজনক স্থানে স্থানান্তর করতে বলা হয়েছে। এ জন্য ভাড়াসহ প্রয়োজনীয় সকল ব্যয় রিটকারীদের ব্যাংক একাউন্ট এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থেকে খরচ করতে হবে। তাই তাদের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করারও নির্দেশ দেয়া হয়। সকল স্থাপনা উচ্ছেদে সময় দেয়া হয়েছে ৬ মাসের। এসব স্থাপনা অপসারনের পর উচ্ছেদকৃত স্থানে পুনরায় চা বাগান সৃজন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও রাগীব আলীর বিরুদ্ধে দায়ের করা আরো দু’টি মামলা দ্রুত পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৪৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে ১৭টি নির্দেশনা ও মন্তব্য রয়েছে উচ্চ আদালতের। রাগীব আলীর পুত্র আব্দুল হাই বাগানের মালিকানা দাবি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে রিট করলে শুনানীর পর সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ এই রায় দেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকের সমন্বয়ে গঠিত ফুল বেঞ্চ এই রায় দেন। গত ১২ ও ১৯ জানুয়ারি শুনানী শেষে ১৯ জানুয়ারি বহুল আলোচিত এ রিটের রায় ঘোষণা করা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পূবপশ্চিমের হস্তগত হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, হিন্দু দেবতার সেবায়েত দাবি করে রাগীব আলী সরকারের কোষাগার থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ টাকা ২০ পয়সা উত্তোলন করেন, যা অবৈধ ও এখতিয়ার বহির্ভূত। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে এই টাকা বৈধ সেবায়েতের একাউন্টে অথবা উক্ত হিন্দু দেবতার একাউন্টে জমা দিতে বলা হয়েছে।
আদালতের ১৭ দফা নির্দেশনা
আদালতের ১৭ দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ধর্মীয় উপাসনালয় বা ট্রাস্ট যখন গঠন হয় তখন তা উৎসর্গ হয় দেবতার নামে। তারাপুরে হিন্দু দেবতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই হিন্দু দেবতার সেবায়েত কখনো অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে পারেন না, যদিও তিনি কো-ট্রাস্টি। অতএব আপাত দৃষ্টিতে দেবতাই সম্পত্তির মালিক।
সেবায়েতের অফিস ধর্মীয় কাজেই ব্যবহৃত হবে। প্রতিষ্ঠিত দেবতা অন্য ধর্ম বিশ্বাসীরা সেবা করতে পারেন না। ফলে দেবতার নামে দানপত্র অভিযুক্ত সেবায়েত কর্তৃক ৯৯ বছরের লিজ প্রদান অবৈধ। নির্দেশনায় বলা হয়েছে যেহেতু কথিত লিজ গ্রহিতা ও সেবায়েত বৈধ নন, তাই আগামী ৬ মাসের মধ্যে মেডিকেল কলেজ-হাসপাতাল, ছাত্রাবাস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, হাউজিংসহ সকল স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে সুবিধাজনক ভালো একটি স্থানে স্থানান্তর করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের কোন অসুবিধা না হয়। এর প্রয়োজনীয় সকল খরচ রিট পিটিশনারদের ব্যাংক একাউন্ট ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে নিতে হবে।
এ জন্য তাদের ব্যংক একাউন্ট জব্দ করতে হবে। তারাপুর চা বাগান থেকে মেডিকেল-হাসপাতাল, বাসা-বাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন, হাউজিং উচ্ছেদ করে সেখানে নতুন করে চা গাছ সৃজন করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পূর্বাবস্থায়। এছাড়া দাতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হিন্দু দেবতা আগের স্থানে স্থাপন করতে হবে, যদি তা সরানো হয়ে থাকে। উচ্চ আদালতের এই রায় রিটপিটিশনার আব্দুল হাইয়ের হাতে পৌছানের এক মাসের মধ্যে তারাপুর চা বাগান হিন্দু দেবতার প্রকৃত সেবায়েতের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
এসব নির্দেশনা অনুযায়ী বাগানের মালিকানা হস্তান্তর ও স্থাপনা সরিয়ে নেয়া না হলে দেবতার সেবায়েত, পুলিশ প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশনকে যৌথভাবে উচ্ছেদ পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উচ্ছেদ সংক্রান্ত সকল ব্যয় রিটপিটিশনার আব্দুল হাই ও তার পিতা রাগীব আলীর কাছ থেকে আদায়ের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হিন্দু দেবতার বৈধ সেবায়েতের অনুপস্থিতি থাকলে সিলেট শহরের ১০ জন যাজকের মতামত নিয়ে একজন সেবায়েত নিযুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসককে বলা হয়েছে। এ সকল নির্দেশনা পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে সিলেটের জেলা প্রশাসককে। রিট কারীরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই আদেশ মানতে ব্যর্থ হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় রিটপিটিশনারদের বিরুদ্ধে সিলেট কোতোয়ালী মডেল থানায় ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ও একই বছরের ২ নভেম্বর দায়েরকৃত জালিয়াতি মামলা দু’টি দ্রুততার সাথে চালিয়ে যাওয়ার জন্য জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
সচল হচ্ছে জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলা
সিলেটের ‘দানবীর’ নামধারী ‘দানব’ রাগীব আলীর বিরুদ্ধে অতীতে দায়ের করা দুটি মামলা ফের সচল হচ্ছে। জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে দায়ের করা দুটি অভিযোগই ছিল সরকারের ভুমি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তার। পরে দুটি অভিযোগই উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়ে যাওয়ায় আর এগুতে পারেনি। দীর্ঘদিন পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের প্রেক্ষিতে এই দুটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা এসেছে। দুটি অভিযোগে তথ্য প্রমাণসহ তুলে ধরা হয়েছে রাগীব আলী ও তার জালিয়াত চক্রের জাল-জালিয়াতির বিস্তারিত তথ্য। অভিযোগ পত্রে দেখা যায়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৮নং শাখা থেকে ১৪-০৮-২০০৫ তারিখে তারাপুর সংক্রান্ত কোন পত্রই ইস্যু করা হয়নি। অথচ রাগীব আলী ও তার পুত্র আব্দুল হাই ওই তারিখের ভূ:ম:/শা-৮/খাজব/৩১৯/৯১/১৭০ স্মারকের চিঠিটি জাল সৃজন করেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই স্মারকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র্যাব-২) কে ঢাকা জেলায় ৭ একর খাস জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাগীব আলী এবং আব্দুল হাই ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শাহ ইমদাদুল হকের স্বাক্ষর এবং উক্ত পত্র জাল করেছেন। স্মারক জাল করে সৃজন করা চিঠি সঠিক দাবি করে তারাপুর চা বাগানের সমুদয় সম্পত্তি নামজারী করে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছেন রাগীব আলী। অনুরূপভাবে ভূমি মন্ত্রনালয়ের শাখা-৮ থেকে ১২-১০-১৯৮৯ তারিখের ভু:ম:/শা-৮/খাজব/৫৩/৮৯/৪৪৬নং স্মারকে সহকারী সচিব এম এ মালেক-এর স্বাক্ষরে পাবনা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। এই স্মারক নম্বরটিও জাল করে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার ও দেবোত্তর প্রায় ২হাজার কোটি টাকার ভু-সম্পদ আত্মসাতের সহায়ক দলিল সৃজন করেন রাগীব আলী ও তার জালিয়াত চক্র। আইনজ্ঞরা বলছেন, জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে অভিযুক্তদের। সাবেক পিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, স্বাক্ষর জাল, জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামীদের সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড হওয়ার বিধান রয়েছে।
রাগীব আলীসহ জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণসহ এই দুটি অভিযোগ করেছিলেন এস এম আব্দুল কাদের। সিলেট সদরের ভুমি কমিশনার থাকাবস্থায় ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ও ২ নভেম্বর দুটি অভিযোগ করেন তিনি। বর্তমানে তিনি ভূমি মন্ত্রনালয়ে কর্মরত। সিলেট কোতোয়ালী থানায় এজাহার দায়েরের সময় সরকারী দপ্তরের স্মারক জাল করে ভুয়া চিঠি সৃজনসহ জালিয়াতির ৪টি প্রমাণপত্রও জমা দেন মামলার বাদি। মামলার এজাহারের অনুলিপি প্রদান করা হয়েছিল ভুমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিলেট সদরের উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই বৈকুন্ঠ চন্দ্র গুপ্ত পিতা মৃত লাল চন্দ্র গুপ্ত তারাপুর চা বাগানসহ তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ জিউ দেবতার নামে রেজিষ্ট্রি দানপত্র করে একটি দলিল সম্পাদন করেন। তখন থেকে সম্পত্তিটি দেবোত্তর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
পরবর্তীকালে নানা জাল-জাীলয়াতির মাধ্যমে রাগীব আলীর পুত্র আব্দুল হাই-এর নামে ৯৯ বছরের বন্দোবস্তের দলিল সৃজন করা হয়। দলিলে স্বাক্ষর করেছেন রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জনৈক দেওয়ান মোস্তাক মজিদ। অভিযুক্ত রাগীব আলী ও তার জালিয়াত চক্রের দাবি, শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ দেবতার পক্ষে সেবাইত শ্রী পংকজ কুমার গুপ্ত ১৯৮৮ সালে ৪২২.৯৬ একর জমি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে রাগীব আলীর পুত্র আব্দুল হাই এর নিকট বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। অথচ সেবায়েত নিজে উক্ত দলিলে স্বাক্ষরই করেননি! তার দ্বারা প্রদত্ত বলে কথিত আমমোক্তার নামা রাগীব আলীর আত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদের মাধ্যমে উক্ত দলিল সম্পাদন করেন।
এতে আমমোক্তার নিয়োগ করা হয় রাগীব আলীর স্ত্রী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, রাগীব আলীর আত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, রাগীব আলীর মেয়ে জামাই আব্দুল কাদির ও রাগীব আলীর মেয়ে রোজিনা কাদির। এই চারজনই রাগীব আলীর পারিবারিক সদস্য ও নিকটাত্মীয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, রাগীব আলীই তার নিজের স্বার্থে জাল আমমোক্তার নামা তৈরি করেছেন। এমন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে রাগীব আলী, পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, আব্দুল হাই, আব্দুল কাদির ও রোজিনা কাদিরকে।
এছাড়াও তারাপুর চা বাগানটি রাগীব আলীর অবৈধ দখল ও আগ্রাসন থেকে রক্ষার জন্য ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি আবেদন পেশ করেন মো. লাবলু মিয়া, হিরণ মিয়া, বশির আহমদ এবং হাশিম মিয়া। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ভূমি মন্ত্রণালয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। উক্ত প্রতিবেদনে তিনি তারাপুর চা বাগান সম্পর্কে নানা রকম অনিয়ম তুলে ধরেন এবং ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেন। এরপর ২০০৫ সালের ২০ আগস্ট সিলেটের জেলা প্রশাসকের দফতরে কথিত একটি চিঠি আসে। ভূমি মন্ত্রনালয়ের ভূম/শা-৮/খাজব/৩৯৯/৯১/১৭০ স্মারকের ওই চিঠিতে অভিযোগকারী মো. লাবলু মিয়া, হিরণ মিয়া, বশির আহমদ এবং হাশিম মিয়ার আবেদনটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এবং সিলেটের অতিরিক্ত কমিশনারের প্রতিবেদনটি অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করা হয়।
চিঠির সাথে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কথিত মতামতের একটি ফটোকপি সংযুক্ত করে তারাপুর চা বাগানের সম্পত্তির নামজারী করে দিতেও বলা হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কথিত চিঠির স্বাক্ষরকারী সিনিয়র সহকারী সচিব শাহ ইমদাদুল হক। কিন্তু স্বাক্ষরের অসামঞ্জস্য দেখে সন্দেহ জাগে সিলেটের জেলা প্রশাসকের। ফলে উক্ত চিঠির সত্যতা যাচাই করার জন্য ভূমি মন্ত্রনালয়ে একটি চিঠি লিখেন। যাচাইয়ের পর ভূমি মন্ত্রণালয় জানায় উক্ত পত্রটি জাল। এর প্রেক্ষিতে রাগীব আলীসহ জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন সিলেটের জেলা প্রশাসক।
দুদকের মামলা
রাগীব আলীর বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন ও সম্পদ গোপন রাখার অভিযোগে মামলা করে দুদক। সিলেট কোতোয়ালী থানায় মামলাটি দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশন সিলেটের সহকারী পরিচালক আর.কে মজুমদার। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২০০৪ এর ২৬(২) এবং ২৭(১) ধারায় দায়ের করা মামলা নং-৯৮/০৯। দুদকের দায়ের করা এজাহারে উল্লেখ করা হয়- রাগীব আলী অসাধু উপায়ে অবৈধভাবে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৫ কোটি ৪৬ লক্ষ ৬৫ হাজার ১৭১ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন এবং প্রদত্ত হিসেবে প্রায় আড়াই কোটি টাকার সম্পদ গোপন রেখেছেন। চা বাগানের ব্যবসা ও অন্যান্য ব্যবসা পরিচালনা করে অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল পরিমান অর্থ উপার্জন করেন বলে উল্লেখ করা হয় এজাহারে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাগীব আলীর একাধিক ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়।
দেবত্তোর সম্পত্তির সেবায়েত মুসলমান
১৯১৫ সালের ২ জুলাই বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত তার তারাপুর চা বাগানসহ সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউড় দেবতার নামে রেজিষ্ট্রি দানপত্র করে দলিল করেন। তখন থেকে এ সম্পত্তিটি দেবোত্তোর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তারও পূর্বে এ বাগানটি তৎকালীন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত জনসন এন্ড কোম্পানীর নিয়ন্ত্রাধীন ছিলো। বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর রাজেন্দ্র লাল গুপ্ত এ দেবোত্তোর সম্পত্তিটির সেবায়েত হিসেবে নিযুক্ত হন। যুদ্ধকালীন সময়ে রাজেন্দ্র গুপ্ত প্রাণ হারালে তার পুত্র পঙ্কজ কুমার গুপ্ত এই বাগানটির সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। পরবর্তীকালে পঙ্কজ কুমার গুপ্ত ভারত চলে গেলে কথিত পাওয়ার অব এটর্নি মূলে দেবোত্তোর সম্পত্তিটির সেবায়েত বনে যান রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার বালিদিঘীর পাড়ের আব্দুল ওয়াছের পুত্র দেওয়ান মোস্তাক মজিদ। দেওয়ান মোস্তাক মজিদ দৈনিক সিলেটের ডাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক দেওয়ান তৌফিক মজিদ লায়েক ও রাজনগর উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমীর দেওয়ান মিছবাহুল মজিদ কালামের ভাই। একজন মুসলমান ব্যক্তিকে দেবোত্তোর সম্পত্তির সেবায়েত করা হয় ‘পাওয়ার অব এটর্নি’ জালিয়াতি করে। পরবর্তীতে এই মোস্তাক মজিদ রাগীব আলীর পুত্র আব্দুল হাইকে ৯৯ বছরের লিজ প্রদান করেন বাগানটি।
লোভাছড়ার পর তারাপুর
রাগীব আলীর আগ্রাসী থাবার কবলে পড়েছিল সিলেটের সীমান্তবর্তী লোভাছড়া চা বাগান। পরে অনেক লড়াইয়ের পর লোভাছড়ার দখল ছাড়তে বাধ্য হন রাগীব আলী। অনুরূপ তারাপুর বাগানটিও রয়েছে তার অবৈধ দখলে। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দেবোত্তর এই সম্পত্তি দখলে নেয়ার চা বাগান ধ্বংস করে প্লট বিক্রি, বহুতল ভবন নির্মাণ, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ নানা অপকর্ম করে যাচ্ছেন। রাগীব আলী তার পক্ষের কেউ তারাপুর চা বাগানের মালিক নন এই মর্মে আদালত রায় দিলে রাগীব আলীর পুত্র আব্দুল হাই সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে রিট করেন। মালিকানা দাবি করে করা রিটের শুনানীর পর উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তারাপুর বাগানের মালিক রাগীব আলী বা তারপুত্র আব্দুল হাই নন বলে রায় দেন। উচ্চ আদালতের এই রায়ের পর সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্রে সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ভুমি দখল করে রাগীব আলীর মালিকানায় মধুবন সুপার মার্কেট নির্মাণের প্রসঙ্গটিও আলোচনায় উঠে এসেছে।
আলোচিত হচ্ছে অর্থ-বিত্ত, প্রভাবের জোরে দক্ষিণ সুরমার ঐতিহ্যবাহী তালেবপুরের নাম বদলে রাগীব আলীর নামানুসারে রাগীবনগর করার পাঁয়তারার বিষয়টিও। উচ্চ আদালতের রায়ে কথিত ‘দানবীর’ রাগীব আলীর মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার পর হয় প্রসঙ্গটি এখন ‘টক অব দ্য টাউন’। রায়ের খবর প্রকাশের পর তোলপাড় চলছে সিলেটে। তবে রাগীব আলী বলে কথা, এখনও কেউ কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন কথিত ‘দানবীর’র জাল, জালিয়াতির ব্যাপারে। তবে অনেকেই উচ্চ আদালতের এই রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করে দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।
রক্ষকের নামে ভক্ষক
ভুমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী তারাপুর চা বাগানের মুল মালিক ছিলেন বৈকুন্ঠ চন্দ্র গুপ্ত। ১৯১৫ সালে তিনি ৪২২ একরের এই সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জীউ দেবতার নামে লিখিতভাবে উৎসর্গ করেন। এরপর মৃত্যু পর্যন্ত দেবতার মন্দিরের সেবাইত ছিলেন বৈকুন্ঠ চন্দ্র গুপ্ত। তিনি মারা যাওয়ার পর উত্তারিধার সুত্রে পুত্র রাধালাল গুপ্ত মন্দিরের সেবাইত হন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাধালাল গুপ্তসহ তাদের পরিবারের ৭জন শহীদ হন। তবে রাধালাল গুপ্তের পুত্র পংকজ গুপ্ত বেঁচে যান। ফলে উত্তরাধিকার সুত্রে পংকজ গুপ্ত মন্দিরের সেবায়েত হন। সর্বশেষ শহীদ পরিবারের একমাত্র এই উত্তরাধিকারী ভু-সম্পদ, বাগান, মন্দির ফেলে প্রাণ রক্ষার্থে দেশত্যাগে বাধ্য হন।
বর্তমানে তিনি ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে পংকজ গুপ্ত দাবি করেছেন প্রাণ রক্ষার্থে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন এবং রাগীব আলী জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে নানা কাগজপত্র সৃজন করেছেন। সংশ্লিষ্ট সুত্রের দাবি, পরিবারের সবাই শহীদ হলে অনেকটা একা হয়ে পড়েন পংকজ গুপ্ত। তাছাড়া পড়াশোনায় ব্যস্ত। তখন বাগান ও মন্দির দেখাশুনার নামে গ্রাস করেন রাগীব আলী। পরে রক্ষকই ভক্ষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হন।
উচ্ছেদ আতংকে বাসিন্দারা
সিলেটে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে তারাপুর চা বাগানে কথিত ‘দানবীর’ রাগীব আলীর গড়ে তোলা অবৈধ রাজ্যের বাসিন্দারা এখন উচ্ছেদ আতংকে। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছেন তারা। সরেজমিনে তারাপুর চা বাগানে গিয়ে বাসিন্দাদের সাথে আলোচনাকালে তাদের আতংকের বিষয়টি উঠে আসে। উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তারা বলেন, রায় বাস্তবায়ন হলে শতশত ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সহ¯্রাধিক মানুষ বেকার হয়ে যাবে। আদালত হাসপাতাল অন্যত্র সরানোর নির্দেশ দিলেও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নেননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১১ সালের সদর উপজেলা ভূমি অফিসের তদন্ত প্রতিবেদনে ৭ টি মৌজার বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে ৩৩৭ টি প্লটের হিসাব পাওয়া গেছে। এসব প্লট যাদের কাছ থেকে ক্রয় করে তারা দখলে নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন গোপাল ঘোষ, প্রদীপ কুমার ঘোষ, গোপেষ ঘোষ, আব্দুল হাই চৌধুরী, ঈশান চন্দ্র ঘোষ, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, আব্দুল মুছব্বির, জৈতুন্নেছা, নূর ই এলাহি, আব্দুর রহমান, আব্দুল লতিফ, খালিদ চৌধুরী, পঙ্কজ কুমার দত্ত, নুনু মিয়া, তারা মিয়া, লাল মিয়া, সুরুজ খান, সৈয়দ আলীর ছেলে, মমতাজ আলী, কালাই মিয়া, পুলক কবির, আতাউর, আব্দুল রশিদ, ছাদ, হাফিজ আবু নসর, গউছ উদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দ মোজাফ্ফর আলী, শরীফ চৌধুরী, শামসুন নেছা খানম, রাধা লাল গুপ্ত, মুহিদুর রহমান, কাপ্তান মিয়া, আব্দুল হাই।
অভিযোগ রয়েছে সিলেটের জাল-জালিয়াতির কারিগর বলে পরিচিত কথিত ‘দানবীর’ রাগীব আলী তার ঘনিষ্ট এসব মানুষকে বিভিন্নভাবে মালিক সাজিয়ে তাদের মাধ্যমে অন্যের কাছে বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ৭ টি মৌজার মধ্যে তারাপুর টি গার্ডেন মৌজার জেএল নং ৭৬ এ রয়েছে ২২৫ টি প্লট। আঙ্গাউড়া মৌজার জেএল নং ৫২ এ রয়েছে ৭০ টি প্লট। মিউনিসিপ্যালিটি মৌজার জেএল নং ৯১ এ রয়েছে ১২ টি প্লট। কুমারগাঁও মৌজার জেএল নং ৮০ এ রয়েছে ১০ টি। ব্রাহ্মণশাসন মৌজার জেএল নং ৭৮ এ রয়েছে ১৯ টি প্লট।
রায় বাস্তবায়নের দাবি
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, যুগান্তকারী এ রায়ের মাধ্যমে সিলেটবাসী তথা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে। সত্য ও ন্যয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আইনের শাসন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। এই রায় তারই প্রতিফলন। রায় বাস্তবায়নে দায়িত্বশীলরা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন বলে আমার বিশ্বাস। এতে সকল মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের রায়, সেহেতু সংশ্লিষ্টদের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ দ্রুত যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অবলম্বন করা উচিত। সিপিবির সভাপতি অ্যাডভোকেট বেদানন্দ ভট্টাচার্য বলেন, এ রায় একটি যুগান্তকরী রায়। বড় বড় লুটপাটের ঘটনা এ রায়ের ফলে নিরুৎসাহিত হবে।
১৯৭৩ সালের ৮নং আইনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আইন বাতিল করে দেয়ার ফলে দেবোত্তর সম্পত্তি পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও আইনহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে উত্তরণের একটি নির্দেশনা এ পাওয়া গেল। রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী এ রায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে যেকোন দেবত্তোর কিংবা জনগণের প্রতিষ্ঠান লুপাট হওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় ভূমিখোর পরিচালক বা সেবায়েতের একাংশ এবং জেলা প্রশাসনের মধ্যে একধরনের অসৎ স্বার্থের যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। সর্বোচ্চ আদালতের এ যুগান্তকারী রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন পরিস্থিতি যাতে না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা সরকার, সরকারি দল এবং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর হবে। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন, বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আলোচ্য রায় থেকে ১৭টি নির্দেশনা এসেছে।
তার মধ্য দিয়ে সিলেটের মানুষ বিশেষ করে চা-রাবার শ্রমিক, পরিবেশবাদীদের প্রত্যাশা ও আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়েছে। সুপ্রীম কোর্টে ছিদ্রহীন এ রায় শিগগিরই বাস্তবায়ন হবে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি অভিযোগ করেন, শহরতলীর সকল চা বাগান বিশেষ করে মালনিছড়া, লাক্কাতুড়া, আলী বাহার, বড়জান, খাদিম এবং কালাগুল বাগানগুলোর চা ভূমি অধিক মূল্যে আবাসন প্রকল্পসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে অপব্যবহার করা হচ্ছে। সেগুলোও এ রায়ের আলোকে পুনরুদ্ধার করা উচিত বলে মনে করি। বড়জান বাগানের ভূমিতে দিগন্ত আবাসিক এলাকা নামে বাণিজ্যিক প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। খাদিম বাগানেও সুখতারা নামে একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃত্যুঞ্জয় ধর ভোলা এই রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করে বলেন, এর মাধ্যমে সারা দেশে বেদখল হওয়া দেবোত্তর সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারাপুর চা বাগানের বেদখল হওয়া দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারে তিনি সকল মহলের সহযোগিতা কামনা করেন। পাশাপাশি আদালতের নির্দেশ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
একই দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পুজা উদ্যাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ। দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষায় এই রায়ের আলোকে দেশের সকল বেদখলকৃত দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানান তারা। বিবৃতি দাতারা হচ্ছেন, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা বিরাজ মাধব চক্রবর্ত্তী মানস, কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃত্যঞ্জয় ধর ভোলা, জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট নিরঞ্জন কুমার দে, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রজত কান্তি ভট্টাচার্য, যুগ্ম সম্পাদক প্রদীপ কুমার দেব, মহানগর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত দেব, সহ-সভাপতি মলয় পুরকায়স্থ, কৃপেশ পাল, ও সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত।