ঋষির সাথে সুর মিলিয়ে বাইডেনও বললেন, পুতিন কিংবা হামাস কাউকে জিততে দেবেন না

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট জো বাইডেন ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তুলনা করে বলেছেন, তিনি এদের কাউকে জিততে দেবেন না। বৃহস্পতিবার ওভাল অফিস থেকে জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশন ভাষণে মি. বাইডেন আরও বলেছেন, হামাস এবং পুতিন তাদের প্রতিবেশি গণতান্ত্রিক দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।

“হামাস ও পুতিন আলাদা হুমকি হলেও তাদের মধ্যে মিল হচ্ছে, তারা দুইজনই প্রতিবেশি একটি গণতান্ত্রিক দেশকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়,” বলেন মি. বাইডেন।

মি. বাইডেন মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেন ও ইসরায়েলের জন্য সহায়তা হিসেবে কয়েক বিলিয়ন ডলারের তহবিল চাইবেন। তার মতে, মার্কিন মিত্রদের পরিত্যাগ করাটা ‘ঠিক’ হবে না।

একই সাথে তিনি ইসরায়েলি নেতাদের ৯/১১ হামলার পর মার্কিন নেতাদের করা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘রাগে অন্ধ’ না হয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

ইসরায়েলে ঝটিকা সফর এবং ত্রাণ সরবরাহ গাজায় প্রবেশ করতে দেয়ার বিষয়ে মিশরের সাথে একটি চুক্তির পর দেশে ফিরে এই ভাষণ দেন তিনি।

গাজা এখনো অবরুদ্ধ রয়েছে। ইসরায়েল গাজায় পানি, বিদ্যুৎ, খাবার এবং জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।

কয়েক দশক ধরে চলা ইসরায়েল-গাজা সংঘাতের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ঘটনাটি ঘটে গত ৭ই অক্টোবর। সেদিন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১৪০০ এর বেশি মানুষকে হত্যা করে।

এরপর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৭০০ মানুষ নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই তথ্য জানিয়েছে।

যা বলেছেন মি. বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার ভাষণে ইউক্রেন ও ইসরায়েল চলমান সংঘাতের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি কংগ্রেসকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে দুই দেশের সহায়তায় তহবিল পাসের আহ্বান জানান।

মি. বাইডেন কী পরিমাণ অর্থ অতিরিক্ত তহবিল হিসেবে চাইছেন তা উল্লেখ না করলেও ধারণা করা হচ্ছে এর পরিমাণ প্রায় একশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

তার ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে:

  • “হামাস এবং পুতিন ভিন্ন ধরণের হুমকি, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি মিল রয়েছে: তারা দুজনই প্রতিবেশী একটি গণতন্ত্রকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।”
  • “আমরা যদি পুতিনের ক্ষমতা এবং ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে সে ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।”
  • মি. বাইডেন বলেন, হামাস দুনিয়াতে “শয়তানের কর্মকাণ্ড” উন্মোচিত করেছে এবং তিনি জোর দিয়ে বলেন, “জিম্মি আমেরিকার নাগরিকদের নিরাপত্তা ছাড়া আর কোন কিছুই আমার কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে না।”
  • তিনি তার ভাষণে বলেন, “ইসরায়েল এবং ইউক্রেনের জয় নিশ্চিত করাটা আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি তার ভাষণে সবশেষে বর্ণনা করেছেন যে, ইসরায়েল এবং ইউক্রেনকে সহায়তা হিসেবে শত বিলিয়ন ডলার দেয়াটা আমেরিকার জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ ।

রিপাবলিকানদের প্রতিক্রিয়া

মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরল ওভাল অফিসের ভাষণের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কয়েক জন রিপাবলিকান সদস্য।

ওহাইয়োর সেনেটর জেডি ভ্যান্স যিনি ইউক্রেনে আরো বেশি ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর বিরোধী, তিনি ভাষণের সমালোচনা করেন এবং একে “জঘন্য” বলে উল্লেখ করেন।

তিনি তার টুইটে বলেন, “তিনি(বাইডেন) তার বিপর্যয়কর ইউক্রেন নীতি আমেরিকানদের কাছে বিক্রি করতে ইসরায়েলের মৃত শিশুদেরকে ব্যবহার করছেন।”

“তারা একই দেশ নয়, তাদের সমস্যাও একরকম নয় এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ইসরায়েলকে ব্যবহার করাটা অন্যায়।”

টেনিসির সেনেটর মার্শ ব্ল্যাকবার্ন এক্স(টুইটার) এর এক পোস্টে বলেন: “ইসরায়েলের ত্রাণ সহায়তাকে, সীমান্ত বা ইউক্রেনের ত্রাণ সহায়তার সাথে এক করে ফেলাটা তার উচিত নয়।”

মি. বাইডেন তার ভাষণে ইরান বিষয়ে আরো বেশি গুরুত্ব না দেয়ার কারণে হতাশা প্রকাশ করেছেন আরকানসাসের সেনেটর টম কটন।

তিনি তার এক পোস্টে বলেন: “বাইডেনের তাৎক্ষণিকভাবে ইরানকে হুশিয়ার করে বলে উচিত, আমেরিকানদের বিরুদ্ধে তাদের ছায়া সংগঠনের যেকোন হামলাকে ইরানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের উপর হামলা হিসেবে দেখা হবে এবং এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হবে।”

কত সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে বেশি মার্কিন সামরিক সহায়তা পায় ইসরায়েল।

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সরকারি নীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস এর তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এবং সামরিক তহবিল হিসেবে ১৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছে।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সামরিক অর্থায়নের জন্য ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সরিয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের সময় স্বাক্ষরিত ১০ বছর মেয়াদী একটি চুক্তির অংশ এই অর্থ। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত দশ বছরে ইসরায়েলকে ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সামরিক সহায়তা দেয়ার কথা রয়েছে।

জার্মানির একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিয়েল ইন্সটিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমি এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জো বাইডেনের প্রশাসন এবং মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনকে মানবিক, আর্থিক এবং সামরিক সহায়তা হিসেবে ৭৫ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে।

এই অর্থের অন্তত ৬০ শতাংশই অস্ত্র এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার মতো সামরিক কার্য সম্পাদনের জন্য।

যা বলছেন বিশ্লেষকরা

বিবিসির উত্তর আমেরিকা বিষয়ক সম্পাদক সারাহ স্মিথ বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বে গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানোটা আমেরিকার দায়িত্ব- তার নিজের দায়িত্ব।

মি. বাইডেনের ভাষণ নিঃসন্দেহে আন্তরিক, হৃদয়গ্রাহী এবং আবেগপ্রবণ ছিল। তার কথাগুলো সব সময় আমেরিকান ভোটারদের সম্পৃক্ত না করলেও তিনি বিশ্ব জুড়ে যারা সংঘাতের শিকার তাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাতে বেশ কার্যকর।

তিনি তার ভাষণে আমেরিকার নাগরিকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, এটা কেন তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য ভাল। কেন হাজার হাজার মাইল দূরে বিদেশি কোন সংঘাতের বিষয়ে তাদের মাথা ঘামানো উচিত। এবং তার বিদেশি নীতি এগিয়ে নিতে কেন আমেরিকান করদাতাদের অর্থ বিদেশি পাঠানো উচিত।

তার ভাষণের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, ইসরায়েল ও ইউক্রেনের সহায়তায় তার অনুরোধকৃত ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল পাস করতে কংগ্রেসের উপর চাপ সৃষ্টি করা।

তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ভ্লাদিমির পুতিন এবং হামাসকে প্রতিরোধ করতে এখন যে অর্থ ব্যয় করা হবে তা হবে স্মার্ট বিনিয়োগ যা আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য আসছে বছরগুলোতে লাভজনক হবে।

ইসরায়েল তার সফরের বিষয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি সতর্কতার সাথে গাজায় থাকা ফিলিস্তিনি মানুষের দুর্দশার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি হামাসের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইসরায়েলি ও আমেরিকানদের পরিবারের সাথে দেখা করার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন।

আমেরিকা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় সহায়তার জন্য অস্ত্র পাঠাচ্ছে। কিন্তু মি. বাইডেন বলছেন যে, তিনি বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের ঘটনা যাতে না ঘটে তার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে আলোচনা করেছেন।

তিনি হামাসের “খাঁটি শয়তানি কর্মকাণ্ডের” নিন্দা জানিয়েছেন এবং একই সাথে বলেছেন যে, তারা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না।

এছাড়া তিনি গাজায় ত্রাণ পাঠানোর বিষয়ে করা চুক্তির কথাও তুলে ধরেন তিনি।

মি. বাইডেন হামাসের নৃশংস কৌশল এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আচরণের মধ্যে সংযোগ দেখিয়েছেন। স্বাধীনতার মতো আমেরিকার প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতি তুলে ধরে, এই দুই সংঘাতেই আমেরিকার কেন যুক্ত হওয়া উচিত তার পক্ষে সাফাই দিয়েছেন।

গাজায় যা হচ্ছে

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অধিকৃত পশ্চিম তীরের নূর শামস শরণার্থীদের সাথে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৬ জন নিহত হয়েছে।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা একটি “সন্ত্রাসী দলকে” লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে।

মিশর এবং গাজা সীমান্তে খাবার, পানি এবং ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা নিয়ে শতাধিক ট্রাক অপেক্ষা করছে।

গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় মিশরের সাথে একটি চুক্তি সই হয়েছে। যার আওতায় ২০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে দিতে রাজি হয়েছে মিশর। দেশটির সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, শুক্রবারের আগ পর্যন্ত মিশর-গাজা সীমান্ত পারাপারটি খুলবে না।

গাজায় ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, “হামাসকে লক্ষ্য করে” বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে দেশটি।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, স্থল অভিযানের আগে সীমান্তে জড়ো হওয়া সেনাবাহিনী গাজাকে “ভেতর থেকে” দেখার জন্য “প্রস্তুত” রয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব জুড়ে থাকা আমেরিকার নাগরিকদের জন্য সহিংস হামলার বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। একই সাথে তিনি সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে আলোচনা করতে দেশটিতে গিয়েছেন।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েন এই সংঘাতের কারণে একটি “বাস্তব” বিপদের বিষয়ে সতর্ক করেছেন যা প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

জাতিসংঘের ত্রাণ বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডাব্লিউএ এর কমিশনার জেনারেল বিবিসি নিউজকে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য “নরকের দ্বারপ্রান্তে” রয়েছে এবং তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “বিশ্ব এখন তার মানবতা হারাচ্ছে।”


Spread the love

Leave a Reply