হামাস যেভাবে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে তা কেউ ভাবতেই পারেনি

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ ঘটনার সময় বেশিরভাগ ইসরায়েলি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন।

শনিবার দিনটি ছিল ইহুদিদের পবিত্র উৎসবের একটি দিন সাব্বাত ছিল। এই দিনে ইসরায়েলিরা বাড়িতে বসে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করছিলেন। কেউ কেউ সিনাগগ কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও আড্ডা দিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক রকেটের হামলার মুখোমুখি হন তারা। যা ছিল একপ্রকার নজিরবিহীন হামলা।

অনেক বছর ধরে ফিলিস্তিনের শহর গাজা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিল ইসরায়েল। কিন্তু গত শনিবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের সেই সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

হামাস গাজা থেকে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় হামলা কীভাবে চালিয়েছে, তা জানতে স্থানীয় লোকজন ও সশস্ত্র যোদ্ধাদের করা ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।

হামলার সূচনা হয়েছিল রকেট নিক্ষেপের মাধ্যমে

স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রকেট আসতে শুরু করে।

ইসলামী সশস্ত্র সংগঠনটির (হামাস) হাতে গাজার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যারা যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। তারা মাঝেমধ্যেই রকেট ছুড়ে ইসরায়েলে হামলা চালায়।

প্রথম প্রথম হামাসের ছোড়া রকেট ইসরায়েলের উন্নত আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু গত শনিবার খুব অল্প সময়ের মধ্যে হামাসের ছোড়া হাজার হাজার রকেট তা প্রতিহত করতে পারেনি।

হামলার ভয়াবহতা দেখে মনে হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পনা করে অস্ত্র মজুত রাখা হয়েছিল। হামাস বলছে, প্রথম দফার তারা অন্তত ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে। তবে ইসরায়েলের দাবি, এই সংখ্যা অর্ধেক।

গাজা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিব ও পশ্চিম জেরুজালেমে রকেট ছোড়া হয়েছিল। এ সময় সাইরেন বাজিয়ে সতর্ক করা হয়। হামলার পর ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে।

রকেট ছোড়ার পাশাপাশি গাজা সীমান্তে শক্তিশালী সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে হামাস যোদ্ধারা।

২০০৫ সালে গাজা থেকে সেটেলার ও সেনাদের প্রত্যাহার করেছিল ইসরায়েল। কিন্তু তারপরেও সেখানকার আকাশ, সমুদ্র ও সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতেই রয়েছে।

এছাড়া গাজা সীমান্তে ইসরায়েলি সেনারা নিয়মিত টহল দেয়। সীমান্তের কোথাও কোথাও কংক্রিটের দেয়াল, কোথাও আবার বেড়া রয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ক্যামেরা ও সেন্সরও স্থাপন করা হয়েছে সেখানে। কিন্তু সব কিছু ফাঁকি দিয়ে

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দফায় দফায় এসব সুরক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলা হয়।

হামাস কীভাবে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ল?

কিছু কিছু হামাস যোদ্ধা বিকল্প উপায়ে সীমান্ত পার হয়েছেন। অনেকেই প্যারাগ্লাইডিং করেছে ইসরায়েলে ঢুকেছে (ফুটেজে দেখা গেছে অন্তত ৭ হামাস যোদ্ধা এভাবে ইসরায়েলে ঢুকেছে)। আবার কেউ কেউ নৌকা নিয়ে ইসরায়েলের ভেতরে প্রবেশ করেছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা সৈকত দিয়ে দুই দফায় হামাসের অনুপ্রবেশের চেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছে।

স্থানীয় সময় সকাল ৫টা ৫০ মিনিটে হামাসের সামরিক শাখা টেলিগ্রাম চ্যানেলে হামলার প্রথম ছবি প্রকাশ করে। স্থানটি ছিলো গাজা ক্রসিংয়ের সর্বদক্ষিণে কেরেম শালম। ওই ছবিতে একটি চেকপোস্ট দিয়ে হামাস যোদ্ধাদের ইসরায়েলে

ঢুকতে দেখা গেছে। এ সময় অন্তত দুজন ইসরায়েলি সেনার লাশ মাটিতে পড়ে ছিল।

আরেকটি ছবিতে দেখা গেছে, পাঁচটি মোটরসাইকেলে চেপে সশস্ত্র যোদ্ধারা কাটাতাঁরের বেড়া পার হয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করছে। জায়গাটি আগেই কেটে রাখা হয়েছিল। প্রতিটি মোটরসাইকেলে দুজন যোদ্ধা ছিল। তাঁদের কাঁধে রাইফেল দেখা গেছে।

এক জায়গায় বুলডোজার দিয়ে বেড়া ভাঙতে দেখা গেছে। এ সময় সেখানে কয়েক ডজন নিরস্ত্র মানুষ ছিলেন। বেড়া ভেঙ্গে ফেলার পর খোলা জায়গা দিয়ে তারা দৌঁড়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েন।

কেরেম শালম থেকে ৪৩.৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইরেজ নামের গাজা ক্রসিংয় দিয়ে দল বেঁধে হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে ঢোকেন।

হামাসের প্রচার শাখার একটি চ্যানেলে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে একটি কংক্রিটের প্রাচীর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। যেকোনো হামলার আগেই ইসরায়েলের ওই চেকপোস্ট থেকে বার্তা দেওয়া হতো।

ভিডিওতে দেখা গেছে, একদল যোদ্ধা বিস্ফোরণ স্থলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। রাইফেল হাতে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পড়া আটজন যোদ্ধাকে সেদিকে দৌঁড়ে যেতে দেখা যায়।

একপর্যায়ে চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরে চেকপোস্টের মেঝেতে ইসরায়েলি সেনাদের দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

হামাস যোদ্ধারা একটার পর একটা কক্ষ টার্গেট করেছিল। ভিডিও দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, তারা অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত।

গাজায় সাতটি ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে। আর বাকি ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ মিশরের হাতে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের ঢোকার রাস্তা বের করে ফেলে।

ইসরায়েলের অনেক ভেতরে হামলা চালানো হয়েছে

হামাস যোদ্ধারা গাজার সবগুলো ক্রসিং দিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করেছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, তারা অন্তত ২৭টি স্থান থেকে হামলা চালিয়েছে। তারা চোখের সামনে যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে।

তারা গাজা থেকে সাড়ে ২২ কিলোমিটার দূরে ওফাকিম শহরেও হামলা করেছে। তারা যেসব এলাকায় হামলা চালিয়েছে, নিচের ম্যাপে তা তুলে ধরা হলো:

গাজা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ইসরায়েলের শহর এসদেরতে হামলা করেছে হামাস। একট পিকআপ ট্রাকে করে শহর চষে বেড়িয়েছে তারা।

ভেঙ্গে ফেলা ইরেজ ক্রসিংয়ের উত্তরে অবস্থিত আশকেলন শহরের খালি রাস্তায় অন্তত এক ডজন যোদ্ধাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।

একই দৃশ্য দেখা গেছে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভিন্ন শহরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে হামাস যোদ্ধারা।

রেইম শহরের কাছে একটি সংগীত উৎসবে বন্দুকধারীরা গুলি চালায়। মরুভূমিতে আয়োজিত ওই সংগীত উৎসবে একদল তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছিল।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেছেন যে, কীভাবে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি ভ্যানে করে তিন ঘণ্টা হামাস যোদ্ধারা শহর চষে বেড়িয়েছে। এ সময় তারা হামলা করার জন্য ইসরায়েলিদের খুঁজছিল।

সেনা ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা হয়েছে

সংগীত উৎসব ও অন্যান্য স্থান থেকে ইসরায়েলিদের জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। ইসরায়েল জানিয়েছে, ১০০ সেনা ও সাধারণ মানুষ অপহরণ করা হয়েছে।

বেরি শহরের একটি ফুটেজে দেখা গেছে চারজন সাধারণ মানুষকে হামাস যোদ্ধারা জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঘটনার সত্যতা যাচাই করেছে বিবিসি।

এছাড়া, অনলাইনে আরও অনেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে দেখা গেছে,গাজার ব্যস্ত সড়ক দিয়ে গুরুতর আহত ইসরায়েলিদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ইসরায়েলি সাধারণ মানুষকে টার্গেট করার পাশাপাশি জিকিম ও রিমে দুটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেছে হামাস।

রিম শহরের কাছের একট সামরিক ঘাঁটিতে হামলার ভিডিওতে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া বেশ কিছু গাড়ি সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গোলাগুলিতে কতজন আহত হয়েছে সেটি অবশ্য জানা যায়নি।

হামাসের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চ্যানেল থেকে একের পর এক ইসরায়েলি সেনার মরদেহের ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে ছবিগুলো আসল কি না, সেটি যাচাই করে দেখতে পারেনি বিবিসি।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার রকেট হামলায় শত শত ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। কেউ ভাবতেই পারেনি যে, এমন হতে পারে। প্রাণঘাতি ও দ্রুত এই হামলার ইসরায়েলকে হতবাক করেছে।

এর কয়েকে ঘণ্টা পরেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, ‘আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি’।


Spread the love

Leave a Reply